::::নিজস্ব প্রতিবেদক::::
অবৈধভাবে বনভূমিতে অনুপ্রবেশ করে মাটি খনন, বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা ও বন দখলের ঘটনায় সীতাকুণ্ডে ইউনিটেক্স গ্রুপের পরিচালক (লিগ্যাল অ্যান্ড এস্টেট) ফারহান আহমেদসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে বন আদালতে অভিযোগ করা হয়েছে। গত ২৫ জুলাই চট্টগ্রাম বন আদালতে এ সংক্রান্ত পিওআর (প্রসিকিউশন অফেন্স রিপোর্ট) দাখিল করা হয়েছে উপকূলীয় বন বিভাগের পক্ষ থেকে।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন- ইউনিটেক্সের এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার (এস্টেট-ল্যান্ড) গোলাম মাওলা (৫০), বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের মিয়াজী পাড়ার সিরাজুল হকের ছেলে জাহেদুল করিম (৪৫), একই এলাকার ফসিউল আলমের ছেলে মেহেদী হাসান (৩০), দক্ষিণ মাহমুদাবাদের আমিনুল হকের ছেলে মো. মাসুদ (৪০) ও মো. খোকনের ছেলে মো. নয়ন (৩২)। এছাড়াও মামলায় আরও অজ্ঞাতনামা ১০-১২ জনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলায় ইউনিটেক্স গ্রুপের পরিচালক ফারহান আহমেদসহ আসামিদের বিরুদ্ধে ১৯২৭ সনের (২০০০ সালে সংশোধিত) বন আইনের ২৬(১ ক) ধারা ও (ঙ) ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
এতে বলা হয়, ১ ও ২ নম্বর আসামির নেতৃত্বে অন্যান্য আসামিরা অবৈধভাবে দলবদ্ধ হয়ে বনভূমিতে অনুপ্রবেশ করে মাটি খনন, বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা ও বন দখলের চেষ্টা করে। এ লক্ষ্যে আসামিগণ গত ৬ জুন সকাল দশটায় সীতাকুণ্ড উপজেলার বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের নড়ালিয়া মৌজার বাঁশবাড়িয়া বিটের উলানিয়া খালের উত্তর পাশের সংরক্ষিত বনে ইউনিটেক্স গ্রুপ ১০-১২ জন লোক দিয়ে বনে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে স্কেভেটর দিয়ে বনের মাটি খনন শুরু করে। অপসারিত মাটি দ্বারা উঁচু বাঁধ নির্মাণ করে। এতে বিশাল বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়। ফলে নড়ালিয়া মৌজার (জেএল নং-৩৮) আরএস খতিয়ান নং-৬৬২ এবং আরএস দাগ নং-২৬০৩, ২৬০৪, ২৬০৫, ২৬০৬, বিএস খতিয়ান নং-৩৭৪ এবং বিএস দাগ নং-২০০৪, ২০০৬,২০০৭,২০০৮,২০০৯ এর ৩ হাজার ৫০০ ঘনফুট মাটি লুট হয় এবং পরিবেশের ২ লক্ষ টাকা পরিমাণের ক্ষতি হয়।
ওইদিন ঘটনাস্থলে সীতাকুণ্ড উপকূলীয় বন বিভাগের বাঁশবাড়িয়া বিট কর্মকর্তা মো. আব্দুস সালাম সরদার পৌঁছালে আসামিরা মালামাল নিয়ে পালিয়ে যায়। বন কর্মকর্তারা তাদেরকে ধাওয়া করলেও জনবল কম থাকায় আটক করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করে তাদেরকে চিহ্নিত করা হয়।
মামলার বাদী মো. আব্দুস সালাম সরদার বলেন, সেদিন অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বনের জায়গা দখল করার চেষ্টা করে। স্কেভেটর দিয়ে মাটি কেটে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হচ্ছিল এবং চারপাশে উঁচু বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছিল। বনের জায়গায় কেন এসব করা হচ্ছে জানতে চাইলে কর্মরতরা ইউনিটেক্স গ্রুপের নির্দেশে তারা কাজ করছেন বলে জানান আমাকে।
তিনি আরও বলেন, বন দখলে জড়িত আসামিরা আমাকে নানাভাবে হুমকি-ধামকি ও ভয়ভীতি দেখিয়েছেন। তাদের হাতে গামছায় মোড়ানো দেশিয় অস্ত্র ছিল। পরক্ষণে আমি বন পাহারাদার টহল দল নিয়ে শক্ত অবস্থানে গেলে এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করলে সন্ত্রাসীরা পিছু হটে। একপর্যায়ে তারা আমাকে ইউরো গ্যাসের অফিসে যেতে চাপ প্রয়োগ করেন। পরে সীতাকুণ্ড উপকূলীয় রেঞ্জ বন কর্মকর্তা বিষয়টি সীতাকুণ্ডের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আশরাফুল আলমকে জানালে তিনি ভূমি অফিস থেকে সার্ভেয়ার পাঠিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেন ।
সীতাকুণ্ড উপকূলীয় বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ইউনিটেক্স গ্রুপ নড়ালিয়া মৌজার সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় বেশ কয়েক বছর আগে সেখানে ইউরো গ্যাস নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে ওই এলাকায় গেড়ে বসে৷ আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ম্যানগ্রোভ বন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা গ্রাস করা শুরু করে। ২০২১ সালের শেষের দিকে তারা সমুদ্র উপকূলে লাল সাদা খুঁটি স্থাপন করে জায়গাগুলো তাদের বলে দাবি করে। ওই জায়গাগুলো চর প্রকৃতির ও সবুজ ঘাস বিস্তৃত। যেখানে একসময় কেওড়া বন ছিল বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ২০২২ সালের শুরুর দিকে বিস্তৃত বনের কেওড়া, বাইন, গেওয়াসহ হাজার হাজার গাছপালা নির্বিচারে ধ্বংস করে দেয় ইউনিটেক্স, ক্যাপিটালসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। সে বছরের এপ্রিলে বন বিভাগের সঙ্গে ইউনিটেক্সের বিরোধ প্রকাশ্যে আসে। ৩০ একর বনভূমি জবরদখলের অভিযোগ পেয়ে ১২ এপ্রিল চট্টগ্রামের সহকারী বন সংরক্ষক সাইফুল ইসলাম, সীতাকুণ্ড রেঞ্জ বন কর্মকর্তা ও বাঁশবাড়িয়া বিট কর্মকর্তাসহ বন বিভাগের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে গেলে ইউনিটেক্সের মুখোমুখি হয়। সে সময় ইউনিটেক্স গ্রুপের পরিচালক (লিগ্যাল অ্যাণ্ড এস্টেট) ফারহান আহমেদ ৫ নং বাড়বকুণ্ড ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছাদাকাত উল্লাহ মিয়াজী ও তার কোম্পানির অন্যান্যদের সঙ্গে নিয়ে সমুদ্র উপকূলে হাজির হন।
ওইদিন বন কর্মকর্তারা ফারহান আহমেদের কাছে কেন অবৈধভাবে সমুদ্র উপকূলে অসংখ্য খুঁটি স্থাপন করা হয়েছে তা জানতে চান। উত্তরে ফারহান আহমেদ জায়গাগুলো তাদের কোম্পানির নামে নামজারি আছে বলে দাবি করেন। কিন্তু সেদিন তিনি সঙ্গে কোনো কাগজপত্র আনেননি এবং বন কর্মকর্তাদের দেখাতেও ব্যর্থ হয়েছেন। সেসময় ফারহান আহমেদ জায়গাগুলো ব্যক্তির নামে রেকর্ড আছে এবং তারা কিনে নিয়েছেন বলেও দাবি করেন।
ফারহান আহমেদের সুর ধরে বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছাদাকাত উল্লাহ মিয়াজী বলেন, জায়গাগুলো তাদের মৌরসী সম্পত্তি। যদিও বন কর্মকর্তারা ফারহান আহমেদের কথাকে পাত্তা দেননি। বরং অবৈধভাবে স্থাপিত তাৎক্ষণিক খুঁটি অপসারণ শুরু করে। এমন অবস্থায় ইউনিটেক্স গ্রুপের কর্মকর্তা ফারহান আহমেদ স্বপ্রণোদিত হয়ে সীতাকুণ্ডের এসিল্যাণ্ড মো. আশরাফুল আলমকে মুঠোফোনে কল করেন। পরে এসিল্যাণ্ড বন কর্মকর্তাদের পরদিন ভূমি অফিসে আসতে বলেন। পরবর্তীতে উপকূলীয় বন বিভাগের পক্ষ থেকে উপজেলা ভূমি অফিসে নামজারি বাতিলের আবেদন (মিছ মামলা) করা হয়।
এসিল্যাণ্ড অফিস সূত্রে জানা যায়, দুই দফায় এসিল্যাণ্ড অফিসে শুনানি অনুষ্ঠিত হলেও উপযুক্ত কাগজপত্র দেখাতে পারেনি ইউনিটেক্স। সর্বশেষ গত ২৩ মে অনুষ্ঠিত শুনানিতেও জমির মালিকানা সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে ইউনিটেক্স।
বন কর্মকর্তারা জানান, দফায় দফায় থানায় অভিযোগ ও এসিল্যাণ্ডের পক্ষ থেকে কাজ বন্ধ রাখতে বলা হলেও কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছে না তারা। প্রায় সময় রাতের আঁধারে ইউনিটেক্স বন বিভাগের জায়গাটি অল্প অল্প করে দখলে নিচ্ছে। কখনও মাটি অপসারণ করছে, কখনও বাঁধ নির্মাণ করছে। আবার কখনও সীমানা পিলার স্থাপন করছে তারা। ২০২২ সালের ২ নভেম্বর ইউটেক্সকে নোটিশ করা হলেও জবাব মেলেনি। পরে ৩ নভেম্বর থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। সর্বশেষ গত ৬ জুনের ঘটনায় ৭ জুন সীতাকুণ্ড থানায় ফের ইউনিটেক্সের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বন বিভাগ। পরে বন আদালতে মামলার প্রক্রিয়া শুরু করে উপকূলীয় বন বিভাগ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপকূলীয় বন বিভাগের দায়িত্বশীল সূত্র বলেন, বন দখল ও বনে অনুপ্রবেশ করে বাঁধ নির্মাণের চেষ্টার ঘটনায় জড়িত আসামিদের বিরুদ্ধে বন আদালতে মামলা হয়েছে। আসামিরা যত বড় রাঘববোয়াল হোক না কেন বন দখলের কোন সুযোগ দেওয়া হবে না।। সরকারি সম্পত্তি রক্ষায় আমরা কঠোর অবস্থানে আছি।বনভূমি সরকারী সম্পত্তি । বনের জায়গায় বেআইনিভাবে প্রবেশও নিষিদ্ধ। সেখানে মাটি খনন, বাঁধ নির্মাণ ও অন্যান্য কাজ তো গুরুতর অপরাধ। আসামিদের বিরুদ্ধে পিওআর দাখিল করা হয়েছে বিজ্ঞ আদালত। আগামীকাল মঙ্গলবার পিওআর গ্রহণ করে আসামিদের বিরুদ্ধে সমন জারি করবেন আদালত।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আইনি লড়াই চালিয়ে যাব। সরকারি সম্পত্তি উদ্ধার ও রক্ষায় আমরা অনড়।’
এইবাংলা/ হিমেল