নাদিরা শিমু, চট্টগ্রাম :::
দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালীর পর্যটন খাতে পরিবর্তনের সুদিন ফিরেছে উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে। পারকি সৈকতকে ঘিরে ৭৯ কোটি টাকার পর্যটন প্রকল্প ;
বদলে দিতে পারে দক্ষিণ চট্টগ্রামের পর্যটনের মানচিত্র।শুধু পার্কি সমুদ্র সৈকত নয়, বাঁশখালীর প্রত্যন্ত এলাকায় পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে প্রকল্প নিয়েছে সরকার।
বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় দুই শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। ইতোমধ্যে পর্যটন বিশ্বের বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর এক-তৃতীয়াংশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস পর্যটনশিল্প। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রায় ১০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ তাদের জীবন-জীবিকার জন্য এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল।
অঘোষিতভাবে বঙ্গোপসাগর পাহাড়বেষ্টিত বাঁশখালীর খানখানাবাদ থেকে বাহারছড়ার কয়েক কিলোমিটার সমুদ্রসৈকত ঘিরে গড়ে উঠেছে পর্যটন স্পট। যা দেশের অন্যতম পর্যটন এলাকা কক্সবাজারকেও হার মানিয়েছে আয়তনের দিক থেকে। বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ সৈকত আর নদীর ঘেরা ঘনসবুজ অরণ্য বেষ্টিত দক্ষিণ চট্টগ্রামজুড়ে পর্যটনের হাতছানির মূল কারণ হচ্ছে উপকূলজুড়ে ভাঙন ঠেকাতে গড়ে তোলা হচ্ছে টেকসই বেড়িবাঁধ। আর এই বিস্তীর্ণ বেড়িবাঁধকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের বাঁশখালী সৈকত ঘিরে ভ্রমণপিপাসুদের আনাগোনা প্রতি বছরই বাড়ছে। বাঁশখালীতে গড়ে উঠেছে আরেকটি মায়াবী ইকোপার্ক, সাগর কূলে গড়ে উঠছে দেশের অন্যতম বৃহত্তম কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্লান্ট, কর্ণফূলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের কাজ রয়েছে শেষ পর্যায়ে।
জানতে চাইলে বাঁশখালীর সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘ বাঁশখালীতে ইকো টুরিজম নিয়ে প্রকল্প গ্রহন করা হয়েছে। সরকার পর্যটন খাতকে সম্মৃদ্ধ করতে পর্যটন এলাকায় যোগাযোগ অবকাঠামোতে সবচেয়ে গুরুত্বের সাথে দেখছে। পর্যটকদের সুবিধার্থে বিআরটিসি বাস দেবার প্ল্যান আছে আমাদের। ইকো টুরিজমকে অগ্রাধিকার দিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহন করা হবে। এ দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে পর্যটনশিল্প বড় নিয়ামক হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বহুমাত্রিক পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা রয়েছে শুধু কক্সবাজারে। বহুমাত্রিক পর্যটনে সাংস্কৃতিক, ইকো, স্পোর্টস, কমিউনিটি ও ভিলেজ ট্যুরিজম ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক।’
‘ বাঁশখালীতে ইকো টুরিজম নিয়ে প্রকল্প গ্রহন করা হয়েছে। সরকার পর্যটন খাতকে সম্মৃদ্ধ করতে পর্যটন এলাকায় যোগাযোগ অবকাঠামোতে সবচেয়ে গুরুত্বের সাথে দেখছে। পর্যটকদের সুবিধার্থে বিআরটিসি বাস দেবার প্ল্যান আছে আমাদের। ইকো টুরিজমকে অগ্রাধিকার দিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহন করা হবে। এ দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে পর্যটনশিল্প বড় নিয়ামক হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বহুমাত্রিক পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা রয়েছে শুধু কক্সবাজারে। বহুমাত্রিক পর্যটনে সাংস্কৃতিক, ইকো, স্পোর্টস, কমিউনিটি ও ভিলেজ ট্যুরিজম ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক।’
অপরদিকে চট্টগ্রামের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা কর্ণফুলী নদীর পূর্ব প্রান্তে, বঙ্গপোসাগরের আনোয়ারা প্রান্তে কয়েক কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে পার্কি সমুদ্র সৈকত। একই উপজেলার রাঙ্গাদিয়ায় রয়েছে এশিয়ার অন্যতম দুটো বৃহৎ ইউরিয়ার সার কারখানা ও দেশের সর্ববৃহৎ কোরিয়ান ইপিজেড। অপর দিকে আনোয়ারায় গড়ে তোলা হচ্ছে বৃহৎ পরিসরে চায়না ইকোনোমিক জোন, কাজ চলছে চট্টগ্রাম দোহাজারী কক্সবাজার রেল প্রকল্প স্থাপনের। প্রক্রিয়াধীন রয়েছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীত করণের কাজ। ফলে দক্ষিণ চট্টগ্রামে প্রতিবছরই বহুগুণে বৃদ্ধি পাচ্ছে মানুষের আনাগোনা।
পর্যটন খাতে বিনিয়োগকারী, রুপসী বাংলা রেস্তোরাঁর চেয়ারম্যান নুরুল আনোয়ার বাহার চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পে বেসরকারি বিনিয়োগ ধীরে ধীরে বাড়ছে। পর্যটকদের আবাসন সুবিধা বৃদ্ধির অভিপ্রায়ে কক্সবাজারে রাজধানী নগরী ঢাকা থেকেও বেশি হোটেল-মোটেল গড়ে উঠেছে। সব পর্যটনকেন্দ্রেই বেসরকারি উদ্যোগের কারণে অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের আকর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখযোগ্য হারে। চট্টগ্রামের সাথে কক্সবাজারের রেল যোগাযোগ স্থাপন যুগান্তকারী ঘটনা। বাংলাদেশ সরকার পর্যটনশিল্পের বিকাশ ও উন্নয়নকে গতিশীল করতে বহু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। করোনা-পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। সম্প্রতি সরকার পর্যটনশিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন ও বিকাশের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের লক্ষ্যে একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।’
বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড এ শিল্পের উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। মহাপরিকল্পনার অংশ হিসাবে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী পর্যটন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে।২০২৫ সালের মধ্যে পর্যটনশিল্পের সর্বোচ্চ বিকাশে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে।
বৃটিশ বাংলাদেশ বিজনেস ক্লাবের চেয়ারম্যান শেখ নুরুল ইসলাম জিতু বলেন, ‘ পুরো দেশকে আটটি পর্যটন জোনে ভাগ করে প্রতিটি স্তরে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা উচিত । এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হলে দেশের পর্যটন শিল্পে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ বাড়বে। কক্সবাজার নিয়ে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে বসবাসরত ব্যবসায়ীদের আগ্রহ আছে৷ ‘
এরই মধ্যে কক্সবাজারে পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণে ২৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলোয় প্রায় প্রত্যক্ষভাবে বিনিয়োগ হবে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। পরোক্ষভাবে বিনিয়োগ হবে ১ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া সরকারের প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন, আধুনিক হোটেল-মোটেল নির্মাণ, মহেশখালীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, সোনাদিয়াকে বিশেষ পর্যটন এলাকা হিসাবে গড়ে তোলা, ইনানি সৈকতের উন্নয়ন, টেকনাফের সাবরাংয়ে ইকো ট্যুরিজম পার্ক নির্মাণ, শ্যামলাপুর সৈকতের উন্নয়ন, ঝিলংঝা সৈকতের উন্নয়ন, চট্টগ্রাম কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ, কুতুবদিয়ায় বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের সম্প্রসারণ, চকরিয়ায় মিনি সুন্দরবনে পর্যটকদের গমনের জন্য যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, ডুলাহাজরা সাফারি পার্কের আধুনিকায়ন প্রভৃতি।
পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, আরও চারটি নতুন প্রকল্প নিতে যাচ্ছে সরকার। এসব বাস্তবায়ন হলে আগামী দিনে দেশের পর্যটন খাত আরও চাঙা হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও পিপিপির মাধ্যমে বিনিয়োগ করা হবে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের নব নির্বাচিত মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, পর্যটনশিল্প-বিকাশে অবারিত সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশে। বিদেশি পর্যটক ছাড়াও দেশের পর্যটকদের নিরাপত্তা, যোগাযোগের সুবিধা ও আকর্ষণীয় অফার দিলে মানুষ আগ্রহ নিয়ে দেশ ঘুরে দেখতে চাইবে। ১৬ কোটির বেশি মানুষের মধ্যে গড়ে ১০ শতাংশও যদি প্রতিবছর দেশ ঘুরে দেখে, তাহলে বিশাল অঙ্কের অর্থনৈতিক তৎপরতা সৃষ্টি হবে। দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন এসেছে পর্যটনশিল্প বিকাশের ফলে। ২০০৯ থেকে ২০১৭ এ আট বছরে ৬ হাজার ৬৯৯ দশমিক ১৬ কোটি টাকা পর্যটনশিল্পের মাধ্যমে আয় হয়েছে। বিভিন্ন উৎসবকালীন মানুষের ঘুরে বেড়ানোর যে প্রবণতা, তা এ অর্থনৈতিক বিকাশ আরও বাড়িয়ে দেবে। ‘
বৃটেন থেকে নিয়মিত বাংলাদেশে বেড়াতে আসেন স্টিফেন মার্কস। তিনি জানালেন, বাংলাদেশের সৌন্দর্যে যুগ যুগ বহু পরিব্রাজক ও ভ্রমণকারী মুগ্ধ হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা অপরিসীম। বাংলাদেশের রয়েছে সুবিশাল সমুদ্রসৈকত, পাহাড়, জলপ্রপাত, প্রত্নতত্ত্বের প্রাচুর্য, ঐতিহাসিক নিদর্শনসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান; যা পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য যথেষ্ট। ‘
নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি বাংলাদেশ পরিণত করেছে একটি বহুমাত্রিক আকর্ষণসমৃদ্ধ অনন্য পর্যটন গন্তব্যে। চট্টগ্রামসহ সারাদেশের পর্যটন এলাকায় সম্ভাবনার সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে পর্যটন শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।
এইবাংলা/নাদিরা শিমু