33 C
Dhaka
Sunday, May 19, 2024
More

    সরকারী হাসপাতালে ‘প্রাইভেট চেম্বার’ আগ্রহ নেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের

    আরও পড়ুন

    :::রাহাত আহমেদ :::
    আগামী বুধবার (১ মার্চ) থেকে দেশের সরকারি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা অফিস সময়ের বাইরে সরকারি হাসপাতালেই প্রাইভেট  চেম্বারে রোগী দেখা শুরু করার কথা । চিকিৎসক প্রত্যেক রোগীর কাছ থেকে সর্বোচ্চ ফি ৩০০ টাকা এবং সর্বনিম্ন ১৫০ টাকা নিবেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত এ সংক্রান্ত কমিটির নীতিমালায় এসব প্রস্তাব করা হলেও দেশের বিভিন্ন জেলার চিকিৎসকদের বড় একটি অংশই এমন উদ্দ্যেগে আগ্রহী নন ।

    এরআগে সরকারী হাসপাতালে বিশেষত চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বার চালুর বিষয়ে গত ২২ জানুয়ারি একটি কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সাইদুর রহমানকে সেই কমিটির প্রধান করা হয়। প্রথমে ২০ জনকে কমিটির সদস্য করা হয়। পরে আরও ৬ জনকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

    কমিটির প্রধান সাইদুর রহমান বলেন, ‘ আগামী ১ মার্চ থেকে সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিস চালু হবে। রোগীদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতেই সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

    খোঁজ নিয়ে জানা যায় চট্টগ্রাম, ঢাকা, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা বিভাগীয় শহরে কর্মরত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা নিজেদের ব্যক্তিগত চেম্বারকেই রোগী দেখার জন্য প্রাধান্য দিচ্ছেন। বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানান, সরকারি হাসপাতালের সবচেয়ে বড় সমস্যা পরিবেশ। পরিবেশ উন্নত করতে না পারলে – সেখানে ‘প্রাইভেট চেম্বার’ সোবপ্রত্যাশীদের ভীড় বাড়াবে। কারণে রোগীদের বড় একটি অংশই বিভিন্ন চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে চিকিৎসা নিয়ে অভ্যস্ত। সরকারি হাসপাতালে সকাল ৮ থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত রোগী দেখেন চিকিৎসকরা। এ সময়টাতে দেশের সব সরকারি হাসপাতালে রোগীদের দীর্ঘ লাইন থাকে। এরপরও অনেকেই চিকিৎসকের দেখা পান না। এসব ঝামেলার কারণে বিত্তবানরা বেসরকারি হাসপাতালকেই বেছে নেন। সমস্যা হয় সাধারণ মানুষের।

    সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা সেবায় কিছুটা স্বস্তি দিতে সরকারি হাসপাতালেই এবার চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা করছে সরকার। এমন উদ্দ্যেগের ফলে নিম্মবৃত্তের রোগী চিকিৎসা বঞ্চিত হবার সম্ভাবনা আরও বাড়তে পারে। তবে কিছু বিভাগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা নগন্য। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে,  দেশে ক্যানসার চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ২২৮ জন; অথচ আরও পাঁচ হাজার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দরকার।

    স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, চেম্বারের সময় বেলা ৩ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হয়। জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকের ফি ৩০০ টাকা। কনিষ্ঠ চিকিৎসকের ফি ১৫০ টাকা। ৩০০ টাকা ফি থেকে জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক পাবেন ২০০ টাকা। তার সহায়তাকারী পাবে ৫০ টাকা এবং বাকি ৫০ টাকা সরকারি তহবিলে জমা হবে। ১৫০ টাকা ফি থেকে কনিষ্ঠ চিকিৎসক পাবেন ১০০ টাকা, চিকিৎসকের সহায়তাকারী পাবেন ২৫ টাকা। বাকি ২৫ টাকা জমা হবে সরকারি তহবিলে। সরকারের এমন উদ্দ্যেগে আগ্রহী দেখা যাচ্ছে না অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের।

    স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র আরও জানায়, ১ মার্চ উপজেলা পর্যায়ে ৫০টি, জেলা পর্যায়ে ২০টি, বিভাগীয় পর্যায়ে ৮টি ও বিশেষায়িত ৫টি সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট চেম্বার চালু হবে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল ঠিক করা হয়েছে রোগীর উপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে। যেসব হাসপাতালে রোগী বেশি আসে, সেখানে এ সেবা চালু করা হবে। আগামী আগস্টের মধ্যে দেশের সব সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট চেম্বার চালুর পরিকল্পনা করছে মন্ত্রণালয়।

    প্রাইভেট চেম্বারে কনসালটেশন, ডায়াগনস্টিক, ল্যাবরেটরি, রেডিওলজি, ইমেজিং ও সার্জিক্যাল সেবা দেয়া হবে। চিকিৎসকেরা পালা করে রোগী দেখবেন। একজন অধ্যাপক সপ্তাহে দুই দিন, সহযোগী অধ্যাপক দুই দিন, সহকারী অধ্যাপক দুই দিন রোগী দেখবেন। চিকিৎসক যদি রোগীকে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেন, রোগী চাইলে তা সরকারি হাসপাতালে করতে পারবেন। আবার বেসরকারি হাসপাতালেও করতে পারবেন। সুত্রমতে  বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার চিকিৎসকদের বড় অংকের কমিশন দিয়ে থাকে ; সেকারণে সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের অনীহা রয়েছে।

    এবিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, নিজ হাসপাতালে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত প্রাইভেট প্র্যাকটিসের পর কোনো চিকিৎসক যদি অন্য কোথাও গিয়ে রোগী দেখেন, সেটি তার নিজস্ব বিষয়। চিকিৎসক চাইলে তা করতে পারবেন। কিন্তু একজন চিকিৎসক দিনের ১২ ঘন্টা হাসপাতালে, বাকি সময় আবার পূর্বের চেম্বারে রোগীর দেখতে হবে। বিষয়টি চিকিৎসার মানগত সমস্যা তৈরি করতে পারে।

    এবিষয়ে কমিটির সদস্য ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে  কিছুটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই শুরুতে সীমিত আকারে বিশেষজ্ঞ  চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বার হয়তো শুরু করবো। পর্যায়ক্রমে এর পরিধি বাড়ানো হবে। ‘

    এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) যখন এই সেবা চালু হয় তখন সবারই ব্যাপক আগ্রহ ছিলো। এর পর সিনিয়র অধ্যাপকরা জুনিয়র মেডিকেল অফিসারদের বসিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত চেম্বারে চলে যান। এটার তদারকিতে আর কেউ থাকেন না। বিএসএমএমইউতে যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে সরকারি হাসপাতালগুলোর চিত্র কেমন হবে? তবে সরকার কঠোর হলে সবই সম্ভব।

    স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক পরিকল্পনার অভাবে দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক  তৈরি হচ্ছে না। তাদের মতে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট নিরসনে সরকারকে শিগগিরই উদ্যোগ নিতে হবে। জানা গেছে বর্তমানে বিভিন্ন খাতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র ৬ হাজার ৮৩৭ জন। ফলে  দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর  বড় একটি অংশই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত। চিকিৎসা শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা জানান, চিকিৎসা শিক্ষায় অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজি, ফরেনসিক মেডিসিন, ফার্মাকোলজি ও প্যাথলজিকে মৌলিক বিষয় বলা হয়। এ সাতটি মৌলিক বিষয়ের দু’একটি ছাড়া অধিকাংশ বিষয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস বা অন্য কোনো উপায়ে অর্থ উপার্জনের সুযোগ না থাকায় জুনিয়র ডাক্তারদের কেউ আর এখন এসব বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে শিক্ষকতা পেশায় আসতে চাইছেন না। ফলে এসব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট রয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বার এই সংকট আরও বাড়াবে।

    এবিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ মনে করেন , চিকিৎসক হিসেবে শূন্য পদগুলোতে নিয়োগ দেয়া জরুরি। একই সাথে বিভিন্ন বিষয়ে  বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরির বিষয়টি ভাবা উচিত।  চিকিৎসকদের বিকেলে রোগী দেখার জন্য রোস্টার তৈরির পাশাপাশি তাদের ব্যক্তিগত চেম্বার করারও সুযোগ দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বৈকালিক চেম্বারকে মডেল হিসেবে ধরে ধাপে ধাপে এটি চালু করলে হয়তো ভালো ফল পাওয়া যাবে।

    খোঁজ নিয়ে জানা যায়,  বর্তমানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কেউই তিনশ টাকা ভিজিটে রোগী দেখেন না। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ভিজিট একহাজার টাকা। ফলে বেসরকারি হাসপাতালে  ‘ প্রাইভেট চেম্বার ‘ আর চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখায় বৈষম্য তৈরি হতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের রোগী দেখার ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি চালু করা উচিত। বর্তমানে  বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বড় একটি অংশ  রাত দুইটা পর্যন্ত রোগী দেখেন। আবার একই সময়ে কিছু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চেম্বার খালিও দেখা যায়।

    দেশের সরকারি হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকের সংখ্যা ও মোট জনসংখ্যা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতি ৬৫৭৯ জন মানুষের জন্য একজন সরকারি চিকিৎসক আছেন। তবে সরকারি চাকরির বাইরে চিকিৎসকসহ এই অনুপাত করলে দেখা যায়, ১ হাজার ৮৪৭ জনের জন্য একজন চিকিৎসক আছেন।

    চিকিৎসক আর জনসংখ্যার অনুপাতের যে তথ্য পাওয়া গেছে তার তুলনায় ভয়াবহ চিত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ক্ষেত্রে। দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট কতটা প্রবল তা বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়।

    এছাড়া বাংলাদেশের প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে শিশু-কিশোরের সংখ্যা ৪০ শতাংশ। সে হিসাবে মোট শিশু-কিশোরের সংখ্যা ৬ কোটি ৪০ লাখ। এদের মধ্যে জন্মগত হৃদরোগীর সংখ্যা ৬ লাখ ৪০ হাজারের মতো বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।  এসব রোগীর মধ্যে যারা চিকিৎসার আওতায় আসে তাদের ২০ থেকে ৪০ শতাংশ বিলম্বিত চিকিৎসার কারণে মারা যান। অথচ দেশে শিশু কার্ডিয়াক সার্জনের সংখ্যা মাত্র আটজন, শিশু কার্ডিওলজিস্ট আছেন ২০ জনের মতো।দেশে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ৬৭ শতাংশ মৃত্যু হচ্ছে অসংক্রামক রোগে। এর মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় মোট মৃত্যুর ৩০ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সরকারি হাসপাতালে ‘ প্রাইভেট চেম্বার ‘ করার বিষয়টির চেয়ে  কিছু কিছু ক্ষেত্রে  বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট নিরসন।


    দেশে বিভিন্ন রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চরম সংকট রয়েছে।  শিশু কার্ডিয়াক সার্জনের সংখ্যা মাত্র আটজন, শিশু কার্ডিওলজিস্ট আছেন ২০ জনের মতো।দেশে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ৬৭ শতাংশ মৃত্যু হচ্ছে অসংক্রামক রোগে।


     

    - Advertisement -spot_img

    সবশেষ খবর