সায়েক এম রহমান
বাংলাদেশ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের বাকি মাত্র দুই মাস। সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশ এক কঠিন সময়ে উপনীত । একাত্তরে যে দেশটির জন্ম হয়েছিল আমাদের পূর্ব পুরুষের লাখো শহীদের বিনিময়ে। স্বাধীন হওয়ার মূলে ছিল ভোটের অধিকার, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ত্ব, গণতন্ত্র, সাম্য ও মানবিকতা। পরিতাপের বিষয় আজ ৫২ বৎসর পরও নেই ভোটের অধিকার, নেই স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র, নেই সাম্য ও মানবিকতা। এ সবই যেন আজ নির্বাসিত।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে স্বাধীন বাংলাদেশ একটি চরম বিপদগ্রস্ত দেশ। আজ আমাকে কিছু ইতিহাসের পিছনে যেতে হবে। ইতিহাস বলে,”২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর মঈন ফখরুর শাসন আমলকে বৈধতা দিয়েই তাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা মোতাবেক নীল-নকশার নির্বাচনের মাধ্যমে একক ক্ষমতার মালিক হয়েছিলেন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অতঃপর এক এক করে চললো ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রাখার বিভিন্ন কূটকৌশল। তারই ধারাবাহিকতায় সরকার ক্ষমতায় আসার প্রথম তিন মাসের ভিতরেই পিলখানায় ঘটানো হলো পৃথিবীর নিকৃষ্টতম হত্যাকান্ড। এখান থেকেই মূল খেলা শুরু। এরপর বিভিন্ন বিরোধী মত ও পথের হেভিওয়েট নেতাদেরকে মানবধিকারের দোহাইয়ে বিচারের সন্মুখীন করা এবং একে একে ফাঁসিতে ঝুলানো। গ্রামীন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ডঃ মোহাম্মদ ইউনুস’কে গ্রামীন ব্যাংকের শীর্ষ পদ থেকে অপসারণ করা এবং বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে তার স্মৃতি বিজরিত ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা। বিভিন্ন জঙ্গী হামলার নাটক করে অসংখ্য শিশু – নারী -পুরুষকে হত্যা করা। সরকারের অধিকাংশ নীতিনির্ধারক, রাজনীতিবিদ ও সুশীলরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্হার পক্ষে থাকার পরও শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়কের বিরুদ্ধে থাকায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে( যদিও আরো ২/৩ টা ট্রাম চালুর রাখার ব্যবস্হা ছিলো) তারপরও বিদায় করা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্হা। হেফাজতে ইসলামের অসংখ্য আলেম উলেমাকে শাপলা চত্বরে ষ্ট্রিট লাইট অফ করে হত্যাকান্ড ঘটিয়ে জায়গা মতো বসিয়ে দেয়া। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভোটার বিহীন তামাশার নির্বাচনের মাধ্যমে স্বৈরাচারী কায়দায় বিরোধী মত ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বন্ধ করে দিয়ে, গৃহপালিত একটি বিরোধী দলকে নিয়ে আবারও ক্ষমতায় আসা !
বিরোধী দলের মহাসচিবসহ প্রায় সব সিনিয়র নেতা ও বিভিন্ন দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীদেরকে অন্যায় ভাবে বিভিন্ন দুর্ণীতি ও নাশকতা মামলায় জড়িয়ে সাজা প্রদান করা এবং নেতাকর্মীদেরকে নির্যাতন, জেলজুলুম , খুন , গুম তো আছেই। জিয়া বিমান বন্দর থেকে শুরু করে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নামে নির্মিত প্রতিষ্ঠানের নামকরন বদলে ফেলা। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে পরিকল্পিত সাজানো মামলায় সাজা দিয়ে জেলে রাখা এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দুইটি বানোয়াট মামলায় সাজা দেয়া। নিরাপদ সড়কের দাবীতে ছাত্র আন্দোলন, যে আন্দোলন পুরো বাংলাদেশের প্রশংসা কুড়িয়েছে, পুরো বাংলাদেশকে ঐক্যবদ্ধ করিয়েছে, তাদেরকেও রেহাই দেয় নি। জেল জুলুম বিভিন্ন প্রকার নির্যাতনের মাধ্যমে তাদেরকেও রাজপথ থেকে ঘরে পাঠানো হয়েছিল। এসবই সুদূর প্রসারি প্ল্যান। এগুলো একদিনে দুই দিনে হয় নি। শাষকদল এসব কূট-পরিকল্পনা করতে অনেক সময় পেয়েছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদেরন মতে বিএনপির অনেক ভুল রয়েছে। যাক, সেতিকে এখন যাবো না। সব মিলে এ যেন স্বৈরাচার আইয়ুব ইয়াহিয়াকেও হার মানিয়ে দিয়েছে।
এ ছাড়া, ব্যাংক -বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুট করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ফান্ড থেকে রিজার্ভের এ পর্যন্ত সরকারের স্বীকারকৃত ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার লোপাট হওয়া, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সোনা তামা হওয়া, কয়লা নাই হওয়া, শেয়ার বাজার, ডেসটিনি, হলমার্ক, সোনালী, রুপালী, জনতা ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি সহ রাষ্ট্রয়াত্ত ব্যাংকগুলোর হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করা। পাঠক এমন সব ঘটনার সমষ্টিতে প্রতিয়মান ” বাংলাদেশকে টাকা রপ্তানীর দেশে পরিণত করা ‘ । বিভিন্ন গনমাধ্যমে প্রকাশিত হাসিনা সরকারের আমলে গত দশ বৎসরে প্রায় সাড়ে ছয় লক্ষ কোটি টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। বড় বড় ব্যাংকগুলা যখন বলছে তারা ফোকলা হয়ে গেছে। মনে করিয়ে দেই এক সময় সরকারি দলের সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাঁর দলের নেতাকর্মীদের হুুসিয়ার করে বলে দিলেন,” আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে,টাকা পয়সা নিয়া পালাতে হবে। কাদের সাহেব এই কথায় কি বুঝালেন? যাক! ভারতের আনন্দ বাজার পত্রিকায় প্রখ্যাত কলামিস্ট অমিত বসু বাংলাদেশের ব্যাংক লুট প্রসঙ্গে তাঁহার এক আর্টিকেলে লিখেছিলেন,,” দরজা জানালা খোলা রেখে এসি চালালে কি লাভ? ঘড় ঠান্ডা তো হবেই না বরং মধ্য পথে হুু হুু করে শুধু কারেন্টই জ্বলবে! তার মানে কি দাঁড়ায়? তার মানে কি আওয়ামী লীগ সরকার আবারও দেশকে বটমলেস বাস্কেটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে?
পাঠক, জাতি অবগত ২০১৮ সালে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন কাহিনী। সেদিন বিএনপির চেয়ারপার্সন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ প্রায় ৭০ হাজারের অধিক নেতাকর্মীদের পরিকল্পনা অনুযায়ী বন্দী রেখে এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকেও সাজা দিয়ে, এ ছাড়া হাজার হাজার তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাথায় গায়েবী মামলার হুুলিয়া জারি রেখে, বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের সংলাপের টেবিলের ৭ টি দফার একটিও না মেনে, শুধু বঙ্গবন্ধুর কণ্যার জবান বলে, নির্বাচন মাঠকে পাহাড় সম ব্যবধান রেখেই, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ পৃথিবীর সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে, পার্লামেন্ট বহাল রেখে,পুরো একটি রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ, সি়ভিল প্রশাসনসহ, লক্ষাধিক আইন শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ে, সর্ব ক্ষমতায় ক্ষমতাবান হয়ে, সরকারি সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা ভোগ করে, দিনের ভোট রাতে করে, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ বাংলাদেশে একটি ভোট ডাকাতির নির্বাচন করে বিশ্ব ইতিহাসে ‘শেখ হাসিনা’ এক কালো অধ্যায় হয়ে আছেন।
দৃশ্যপট বলছে, শাসকদল ২০১৪ ও ২০১৮ এর দিকে ই হাঁটছে। তার প্রমান দলের মহাসচিব থেকে শুরু করে প্রায় সব কেন্দ্রিয় নেতাদের জেলে দেয়া। প্রতিদিন প্রায় হাজার খানেক তৃণমূল নেতাকর্মী গ্রেফতার করা। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা পরিস্কার করে বলছেন। ২০১৪ ও ২০১৮ কে ২০২৩ এর সাথে কোনভাবেই মিলানো যাবে না। তবে বিএনপি এবং যোগপৎ আন্দোলনকারী দলদেরকে ইস্পাত কঠিন অবস্থায় মাঠে থাকতে হবে। এবার দৃশ্যপট আসলেই ভিন্ন। বহিঃ বিশ্বের চাপ রয়েছে অবিরত। এ চাপের মাত্রা বিভিন্ন ভাবে বারতেই থাকবে।
মূল কথায় চলে আসি, বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মাস, নবেম্বর ও ডিসেম্বর মাস। আন্দোলনের মাস, বিজয়ের মাস। এখানে বাংলাদেশের রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট। শাষকদল ক্ষমতার জন্য উম্মাদ হয়ে গেছে। তাদের কারও কথাবার্তা এখন আর রাজনৈতিক কোন শিষ্টাচারের ভিতরে নয়। আমলাসহ বিভিন্ন বাহিনীকে পদোন্নতি ও গাড়ি বাড়ি দিয়ে পদোন্নতির জোয়ারে দেশ ভাসাচ্ছে। সংবিধানের দোহাই দিচ্ছে। সংবিধানের দোহায় অতীতে সব স্বৈরাচারাই দিয়েছে। আইয়ুব ইয়াহিয়ারাও দিয়েছে। আমি আমার অনেকগুলি লেখায় বলেছি , আজ ও বলছি, ইতিহাস বলে যখন গনতন্ত্রের নিয়মতান্ত্রিক সব পথ বন্ধ হয়ে যায় এবং অন্যায় যখন নিয়ম হয়ে যায়, তখন আর নিয়ম নীতি মেনে জনতার দাবী আদায় করা যায় না। তখন নিজের বিবেককে প্রশ্ন করতে হয়, আইন কার জন্যে? তখন আপনার বিবেকই বলে দিবে আইন তো মানুষের ই জন্যে। মানুষই তৈরি করবে মানুষের আইন। মানুষের অধিকার, মানুষের স্বাধীনতা, মানুষের সার্বভৌমত্ব, মানুষকে বুক উচিয়ে দেখিয়ে আদায় করতে হয়। ইতিহাস আমাদের আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে,, ৪৭, ৫২, ৭১ ও ৯০ এ সেই স্বৈরাচারদের আইন মানলে আমাদের কোন বিজয় ই আসতো না।
অতএব,,এই মহুুর্তে দেশ মুক্তির জন্য, ভোটের অধিকারের জন্য, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্য, আমার ভোট আমি, আপনার ভোট আপনি, যাকে ইচ্ছে তাকে দেয়ার জন্য, গণতন্ত্র ও মানবধিকারের জন্য দলমত নির্বিশেষে নারী-পুরুষ ছাত্র শিক্ষক কৃষক শ্রমিক ও প্রজম্ম তরুন যুব সম্প্রদায়কে ঐক্য বদ্ধ হয়ে, দেশকে স্বৈরাচার মুক্ত করার জন্য, দেশকে মুক্ত করার জন্য ইস্পাত কঠিন হরতাল অবরোধ প্রয়োজনে অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। বাংলাদেশ মুক্তির জন্য প্রয়োজন আরেকটি মুক্তি যুদ্ধ। নইলে তাদের টার্গেট অনুযায়ী ২০৪১ সাল পর্যন্ত স্বৈরাচার সরকারের অধীনেই থাকতে হবে।।
বাংলাদেশের সব অর্জন ধুলিমাখা হয়ে যাবে।। অতএব আরেকটি মুক্তি যুদ্ধ এখন অনিবার্য।।।
লেখকঃ
সায়েক এম রহমান, লেখক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য