দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরপরই নতুন রুপে জন্ম নেয় জাতিসংঘের অন্যতম সর্ববৃহৎ অর্জন ” বিশ্ব মানবাধিকার দিবস “। যে দিনটিকে অতি গুরুত্ব সহকারে ১৯৪৮ সাল থেকে জাতিসংঘের নির্দেশনায় প্রতি ১০ ডিসেম্বর বিশ্বের সকল দেশ পালন করে আসছে “বিশ্ব মানবাধিকার দিবস” হিসাবে। বিজয়ের মাসে ” বিশ্ব মানবাধিকার দিবস ” কে সামনে রেখে আজকের আমার এই নিবন্ধ।
এক :: বাংলাদেশের মানুষের মানবেতর জীবন উপর ২৮ নভেম্বর ২০২৩ ঢাকা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনে গুম খুন, হামলা মামলা এবং গ্রেপ্তারকৃত মানুষের এবং গ্রেপ্তারকৃত মানুষের স্বজনদের ক্রন্দনে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে আসছিলো।সেদিন মানববন্ধনে কেউ এসেছিলেন প্লেকার্ড ব্যানার নিয়ে, কেউ এসেছিলেন কান্না জড়িত কন্ঠে অবুঝ সন্তান ও কোলের শিশু নিয়ে। তাদের সবাই ই বিরোধী মত ও পথের মানুষ অর্থাৎ বিএনপির নির্যাতিত নেতাকর্মীদের স্বজন। তাদের কেউ কেউ শিকার হয়েছেন গুম খুনের, কেউ কেউ করাগারে, আবার কেউ কেউ পলাতক।
সবার মুখে একই কথা- স্বজনদের মুক্তি চাই। এখানে সবাই-ই বিভিন্ন ভাবে নিপীড়িত নির্যাতীত। এখানকার নিপীড়ত নির্যাতিত স্বজনরা এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশ্য বললেন,” যদি আমার এবং আমার পরিবারের বাঁচার অধিকার না থাকে, তা হলে আমাদের সবাইকে এক সাথে মেরে ফেলুন। দয়া করে একজন একজন করে কষ্ট দিয়ে মারবেন না। বিএনপির মতপথের রাজনীতি করে অপরাধ করেছি, আমরা পুরো পরিবার এক সাথে মরতে চাই।
এখানে সহজে অনুমেয় একটি পরিবার, একটি মত ও পথ, কতটুকু অত্যাচারিত লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত হলে এমন সব কথা জনসম্মুখে বলা যেতে পারে। তাই বলছি কোথায় মানবতা, কোথায় মানবিকতা ও সুশীলরা?
তবে তার মধ্যে সেদিন সবচাইতে বেদনাদায়ক এবং লোমহর্ষক ছিলো দাদা- দাদীর হাত ধরে পুরান ঢাকা থেকে আসা দুই অবোঝ শিশু বর্ষা ও নূরী! সেইদিন মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে দুই অবুঝ শিশু কান্না জড়িত কন্ঠে চিৎকার দিয়ে হাজার হাজার মানুষের সামনে বলেছিলো, ” আমার মাকে ছেড়ে দেন! আমার পরিক্ষা! আমি মাকে ছাড়া স্কুলে যেতে পারি না। সেই দিন বিশ্ব মিডিয়া সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবোঝ শিশু বর্ষা ও নূরীর আর্ত চিৎকারে ঢাকা প্রেসক্লাবের আকাশ বাতাস ভারী হয়ে গিয়েছিলো। প্রায় সবকটি গণমাধ্যম ফলাও করে প্রচার করেছে। এখনো জানি না তাদের মায়ের মুক্তি হয়েছে কি না? হায়রে মানবতা! হায়রে বর্বরতা!
এখানেই শেষ নয়। পাশে বসা বয়োবৃদ্ধ দাদী বললেন,” আমার ছেলে আবদুল হামিদকে না পেয়ে, আমার ছেলের বউ পুতুলকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পুলিশ। আজ চারদিন ধরে বউমার সাথে দেখাও করতে পারছি না। এদিকে দুটি দুধের শিশু কে আমি সামলাতে ও পারছি না। এর মধ্যে সারা রাত ঘুমাতেও পারি না। দাদি নাতিন এভাবে যখন কথা বলছিলেন তখন অঝোর ধারায় কান্না জড়িত কন্ঠে কাঁদতেছিলো ছোট্ট শিশু নূরী। সেইদিন এই ছোট্ট শিশু নূরীর কান্নার জবাব দেওয়ার ভাষা বুঝি পৃথিবীর কারো ছিল না।
এখানে আমরা একজন নূরীকে দেখতে পাচ্ছি। এভাবে কত হাজার হাজার নূরী ফ্যাসিষ্টের কবলে পড়ে বাংলাদেশের অলিতে গলিতে কাঁদছে। হয়তো আপনি জানেন না, আমিও জানি না। এই নূরী ই আজকের বাংলাদেশ। এই নূরী-ই আজকের বাংলাদেশের মূল চেহারা।
দুই । পাঠক, নূরীর কথা লিখতে গিয়ে মনে পড়ে গেল আদিবার কথা। আপনাদের হয়তো অনেকের মনে আছে। যাদের মনে নেই আমি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।
সেইদিন ছোট্ট আদিবা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে ই কেঁদেছিল ছোট্ট আদিবা! সেদিন শুধু এটুকুই বলতে পেরেছিল,” পাপাকে ( বাবা) ছাড়া একটুও ভাল্লাগে না আমার! ‘
বিশ্বসহ জাতি সেদিন দেখেছে। আদিবার বয়স যখন দুই বছর তখন থেকেই সে তার বাবাকে খোঁজে পাচ্ছে না। এখন তার বয়স ১১বছর। প্রতি দিনই সে তার বাবাকে খোঁজে এবং বিশ্বাস করে এক দিন না এক দিন তার বাবা ফিরে আসবে।
গত গুম দিবসে তার মায়ের হাত ধরে আদিবা হাজির হয়েছিল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে “মায়ের ডাকে” মানববন্ধন অনুস্টানে। সেই দিন সেখানে আদিবার মত ৪২ টি পরিবার সমবেত হয়েছিলো। প্রতিটি পরিবার তাদের প্রিয় মানুষদের খোঁজ পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। উল্লেখ্য আদিবার বাবা পারভেজ হোসেন বংশাল থানা ছাত্র দলের সাধারন সম্পাদক ছিলেন। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে কে বা কাহারা তাকে তুলে নিয়ে যায়।
প্রাণপ্রিয় বাবা পারভেজ হোসেনকে ফিরে পেতে আকুতি জানিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে শিশু আদিবা ইসলাম হৃদি। সেই কান্না গণমাধ্যমে দেখে অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। শিশু হৃদির বাবার স্থানে আমরা নিজেকে দাঁড় করিয়ে উপলব্ধি করলেই বুঝতে পারব, এরকম অবস্থায় আমরা কেউ উপনীত হলে আমাদের পরিবারের অবুঝ সন্তানদের অবস্থা কী হতো?
আদিবার বাবার মতন হাফসার বাবা সাজেদুল ইসলাম নিখোঁজ হন ২০১৩ সালে। তার বাবার কথা বলতে গিয়ে হাফসা মাইক্রোফোনে বলছিলেন,” আমি শুধু একটা কথা বলতে চাই। আমার বাবাকে যদি মেরে ফেলে থাকেন, তা হলে শুধু লাশটা একটু দেখতে দিন। আমি আমার বাবার লাশ দেখতে চাই। কান্না জড়িত ভাবে বললেন,” আমি আমার বাবাকে শেষবারের মত একবার ছুঁয়ে দেখতে চাই।
এদের শান্তনা কে দিবে? কে দিবে তাদের কথার জবাব? কোন ভাষা নেই। এভাবে কত আদিবা, কত হাফসার ক্রন্দনে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কাঁপছে। কিন্তু ফ্যাসিষ্টের জান কাঁপছে না।এটাই আজকের বাংলাদেশ।
এছাড়া আজ মাঠের বিরোধী দল বিএনপির প্রায় এক কোটি মানুষ এই মূহুর্তে বিভিন্ন হামলা মামলায় জড়িত হয়ে ঘরের বাহিরে যাযাবর জীবন যাপন করছে। কারন আওয়ামী লীগ ও পুলিশ যৌথ ভাবে হামলা চালাচ্ছে অহরহ। দলীয় নেতাকর্মীদের না পেয়ে কারো কারো বাবা- মা, কারো কারো ভাই-বোন, কারো কারো স্ত্রীকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সরকার দলের হেমলেট বাহিনীরা বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের আহত করে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছে । অতঃপর পুলিশ এমতাবস্থায় আহত নেতাকর্মীদের আদালতে রিমান্ড চেয়ে অমানবিক নির্যাতন চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে পরিকল্পিত অমানবিক নির্যাতনে কয়েক জনের মৃত্যু ও হয়েছে। অসুস্থ আসামিকে ডান্ডা বেরি লাগিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। মূল কারন হলো ৭ জানুয়ারি ২০২৪ একটি ডামি নির্বাচন সম্পন্ন করা। যা বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্বসহ জাতি দেখছে।
আজ বিশ্ব মানবাধিকার দিবস কে সামনে রেখে বলতে হচ্ছে, ইহাই বাংলাদেশ! কোথায় মানবিকতা? কোথায় মানবতা? কোথায় গণতন্ত্র ? কোথায় সুশীলরা?
তবে আশার কথা মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র কয়েক ডজন লোকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। মানবাধিকার দিবসের আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন এক বিবৃতিতে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ও স্টেট ডিপার্টমেন্ট ১৩টি দেশের ৩৭ জনের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
লেখকঃ
সায়েক এম রহমান
সহ সভাপতি
বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার সমিতি