::: ওয়াহিদ জামান :::
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৯০ এর দশক থেকে বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা করেছেন বিভিন্ন দেশের নেতারা । সমালোচকের সমালোচনা এড়িয়ে ১৯৯৮ সাল থেকে ২০ টিরও বেশি দেশের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মুক্তমতের পৃথিবীতে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ক্রমবর্ধমানভাবে আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতির উদ্দেশ্যসমুহ সম্পূর্ণ পরিসরে বিস্তৃত বা প্রচারের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রায়শই নিষেধাজ্ঞাগুলি মার্কিন পছন্দের অভিব্যক্তির চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতির কারণ হচ্ছে ; যা অন্তর্নিহিত লক্ষ্যের আচরণকে পরিবর্তন না করে আমেরিকান অর্থনৈতিক স্বার্থকেও আঘাত করছে।
২০২৩ সালের মে পর্যন্ত, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা পাওয়া দেশ বা অঞ্চলগুলো (একতরফাভাবে বা আংশিকভাবে) হলো- আফগানিস্তান, বলকান, বেলারুশ, বার্মা, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, কিউবা, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো, ইথিওপিয়া, হংকং, ইরান, ইরাক, লেবানন অন্তর্ভুক্ত , লিবিয়া, মালি, নিকারাগুয়া, উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া, সোমালিয়া, সুদান, দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া, ইউক্রেন, ভেনিজুয়েলা, ইয়েমেন এবং জিম্বাবুয়ে, বাংলাদেশ।
মার্কিন সরকার যুগে যুগে ক্রমবর্ধমানভাবে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাগুলিকে মার্কিন স্বার্থের হুমকি মোকাবেলার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। উদাহরণস্বরূপ, বলা যায় মার্কিন সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক অবৈধ বলে মনে করা ভেনিজুয়েলার শাসনকে সমর্থন করার জন্য কোম্পানিগুলিকে অনুমোদন দিয়েছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত নিকারাগুয়ান ও ইরানী কর্মকর্তাদেরও তালিকাভুক্ত করেছে ৷দেখা যাচ্ছে, নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগুলি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যতটুকু উদ্বিগ্ন, তারচেয়ে বেশি উৎসাহী নিষেধাজ্ঞার আওতা বিস্তৃত করতে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার সাধারণ কার্যকারিতায় অনেক দেশের অর্থনীতি রুগ্ন হয়ে পড়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে জি-৭, অস্ট্রেলিয়া এবং অন্যান্য অংশীদারদের সাথে সমন্বয় করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে অবৈধ যুদ্ধের জন্য রাশিয়ার উপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। সেই নিষেধাজ্ঞার পদক্ষেপগুলি জি-৭ নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনে করা নতুন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করে এবং ইউক্রেনে তার ক্রমবর্ধমান নৃশংসতার জন্য রাশিয়াকে জবাবদিহি করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ সংকল্পকেই স্পষ্ট করেছে। এই নিষেধাজ্ঞাগুলি দেশটির নিষেধাজ্ঞা এবং রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাসমুহ ফাঁকি দিয়ে যারা ইউক্রেনের ক্রেমলিনকে সহায়তা করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার অংশীদারদের প্রতিশ্রুতিকে আরও শক্তিশালী করেছে।
এই কার্যক্রমের অংশ হিসাবে, স্টেট ডিপার্টমেন্ট ২০০ টির বেশি সত্ত্বা, ব্যক্তি, জাহাজ এবং বিমানের উপর অবরুদ্ধ সম্পত্তি হিসাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বা চিহ্নিত করছে৷ আওতাভুক্ত কার্যকলাপের মধ্যে রয়েছে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা এবং সংশ্লিষ্ট উপাদান, প্রযুক্তি, ধাতু এবং খনির খাত জুড়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ। রাশিয়ার ভবিষ্যত শক্তি উৎপাদন ও ক্ষমতা সম্প্রসারণের সাথে জড়িত সত্তা এবং ব্যক্তিদের নামকরণও এই নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। তবে ইতিবাচক দিক হচ্ছে ক্রমাগত লক্ষ্যবস্তু হওয়া দেশ বা ব্যক্তি যারা ইউক্রেনের শিশুদের নিয়মতান্ত্রিক এবং বেআইনিভাবে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। সেইসাথে ইউক্রেন থেকে শস্য চুরি এবং সেসব চুরি করা শস্য পরিবহনে জড়িত।
নিষেধাজ্ঞাগুলি হল একটি দেশ কর্তৃক অন্য দেশের উপর আরোপিত শাস্তি। সাধারণত একটি দেশের আক্রমনাত্মক আচরণ করা বা আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করার প্রবণতা বন্ধ করার জন্য নিষেধাজ্ঞার ব্যবহার করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কঠিন পদক্ষেপগুলির মধ্যে এমন সব শর্ত থাকে, যা বিভিন্ন দেশ নিতে পারে না। যেমন, যুদ্ধে যেতে পারে না। খুব অল্প সময়ের নোটিশে আরোপ করা হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয় যুক্তরাজ্যও নিষেধাজ্ঞাকে ভূ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। যেমন, রাশিয়া থেকে হীরা আমদানি নিষিদ্ধ করেছে যুক্তরাজ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত বছর রাশিয়ান হীরা নিষিদ্ধ করার অনুরূপ পরিকল্পনা সেট করেছিল এবং পরে ইইউ এটি বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।
উদার পররাষ্ট্রনীতির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এসব নিষেধাজ্ঞা অনেক সময়ই দ্বিমুখী আচরনের মতো গণ্য হচ্ছে । এইকারণে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কৌশল হিসেবে , নিষেধাজ্ঞাগুলি কম একতরফা এবং গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার উপর বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার। কংগ্রেস এবং এক্সিকিউটিভ শাখাকে নিষেধাজ্ঞাগুলিকে গ্রহণ করার আগে এবং তারপরে নিয়মিতভাবে উভয় ক্ষেত্রেই নিষেধাজ্ঞাগুলির আরও কঠোর তত্ত্বাবধান স্থাপন করা উচিত। যাতে প্রত্যাশিত সুবিধাগুলি সম্ভাব্য খরচের চেয়ে বেশি হয়। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বিকল্প বৈদেশিক নীতির সরঞ্জামগুলির চেয়ে আরও বেশি কিছু অর্জন করতেই দেয়া হলেও নেপথ্যে মোড়লীপনা।
এমনকি বিনীয়োগ, আমদানি-রপ্তানি, ক্রয় বাণিজ্য বা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়েও তাদের নজরদারি ও খবরদারি উন্নয়নশীল বিশ্বের বহু দেশের জন্য প্রতিবন্ধকতার কারণ হয়ে উঠেছে। বিষয়টি সাধারণ মানুষ খুব উপলব্ধি না করলেও শাসনক্ষমতায় সংশ্লিষ্টরা হাড়ে হাড়ে টের পান।
গত ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট তথা যুক্তরাষ্ট্র সরকার স্পেশালি ডেসিগনেটেড ন্যাশনালস অ্যান্ড ব্লকড পারসনসের তালিকায় বাংলাদেশের সাবেক র্যাবের মহাপরিচালক ও বর্তমান পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ সাতজন কর্মকর্তার নাম অন্তর্ভুক্ত করেছিলো।
ট্রেজারি বিভাগের ওই নিষেধাজ্ঞায় ভিসা না দেওয়া, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত অর্থ-সম্পদ বাজেয়াপ্তসহ বেশ কিছু অবলিগেশনের সম্মুখীন হতে হয়। র্যাব ছাড়াও এই আদেশে বেশকিছু ব্যক্তির নামও রাখা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এই নির্বাহী আদেশের ক্ষত না শুকাতেই বাংলাদেশের নাগরিকদের উপর চাপানো হয়েছে নতুন ভিসা নীতি । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যারা ঘনিষ্ঠতম মিত্র, সেটা কানাডা থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পর্যন্ত সবার চোখে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে একই ধরনের পলিসি ঘোষণার চিন্তা মাথায় এলে বাংলাদেশের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। যদিও মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশের নির্বাচন কোনভাবেই হুমকি হয়।
এ বছরের জানুয়ারি মাসে ঢাকা সফরে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু। ওই সফরকালে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিলেন তার মধ্যে র্যাবের ওপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, মানবাধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, সুষ্ঠু নির্বাচন এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ইত্যাদি বিষয়ও ছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ সফরকালের আলোচনায় সেই বিষয়গুলোরই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।
যদিও শ্রমমান উন্নয়ন, শ্রমিকের নিরাপত্তা বিধান, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার সুনিশ্চিত করা কিংবা মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর ইস্যু, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের মতো ইস্যুগুলো আমাদের স্বার্থেই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হওয়া উচিত। তবে এগুলোর আশু সমাধান নিজস্ব রাজনৈতিক আলোচনা-সমঝোতার মাধ্যমেই অর্জন করতে হবে। কিন্তু এ ধরনের ইস্যুগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের দাদাগিরির অধিকার স্বীকারের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করেছে দেশের সরকারি ও বিরোধী দল।
ইন্দো-মার্কিন জোটকে নিয়ে চীন আদতে কতটা উদ্বিগ্ন, সেটা বোঝা মুশকিল হয়ে পড়েছিলো দেশটির বাকসংযত কূটনীতির কারণে। তবে দেশটি যে নিজস্ব পরিকল্পনা থেকে একচুলও সরতে নারাজ, তা বাংলাদেশ নিয়ে তার নিজ পরিকল্পনায় লক্ষ্যস্থির করে এগোনোর কৌশল থেকেই পরিষ্কার। সেটি আরও পরিস্কার হয়েছে বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি ও নিষেধাজ্ঞার পটভূমিতে।
লেখক : সাংবাদিক