33 C
Dhaka
Sunday, May 19, 2024
More

    কার্ড জালিয়াতিতে হাত পেকেছে অনেক বাংলাদেশীর

    আরও পড়ুন

    ::: তাফসির আহমেদ :::

    বৈশ্বিক মন্দার কারণে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের নাগরিকরা হিমসিম খাচ্ছে মাসের খরচ বহন করতে। এরমধ্যেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির পুরোনো চক্র। যুক্তরাজ্য ইতিমধ্যে ব্যাংকগুলোকে তাদের গ্রাহককে নিরাপদ রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। ইনসাইডার ইন্টেলিজেন্স অনুসারে, বিভিন্ন ধরনের ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি শুরু হয়েছে। যার মধ্যে  কার্ড-নট-প্রেজেন্ট জালিয়াতি,  অনলাইনে জালিয়াতি , ওভার-দ্য-ফোন এবং মেল-অর্ডারে লেনদেনে জালিয়াতি । ইনসাইডার ইন্টেলিজেন্সের তথ্য অনুযায়ী ২০২২  সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আনুমানিক  ৫.৭২  $ বিলিয়ন লোকসানের জন্য কার্ড জালিয়াতি দায়ী।

    বর্তমানে উন্নত বিশ্বে দৈনন্দিন  সংসার  খরচসহ নানা কেনাকাটার নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে ব্যাংকের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড ব্যাপকভাবে চালু রয়েছে।  বড় কোনো বিপদ-আপদেও গ্রাহকরা ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে থাকেন । অনলাইনে কেনাকাটার জন্য ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহারের অপরিহার্য পরিস্থিতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে হ্যাকাররা। এইকারনে ক্রেডিট কার্ড নিয়ে এখন স্বস্তিতে নেই ব্যবহারকারীরা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের সব দেশে সক্রিয় কার্ড জালিয়াত চক্রের হাতে পড়ে অনেকেই সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। অনেককেই পড়তে হচ্ছে আইনী ঝামেলায়।

    সান ফ্রান্সিসকোর ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের মতে, সমস্ত খুচরা লেনদেনের প্রায় ৫১ শতাংশ ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে করা হয় – মাত্র ২৬ শতাংশ নগদ।

    ২০১৯ সালের পর থেকে নিউইয়র্কে ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি ব্যাপক আকার ধারণ করে। স্টোর, অনলাইন অর্ডার, গ্যাস স্টেশন, এয়ার টিকিট, গাড়ি কেনার সময় ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে বর্তমান মন্দা পরিস্থিতিতেও। কৌশলে  জালিয়াত চক্র হাতিয়ে নেয় অনেকের ব্যক্তিগত ক্রেডিট। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্লোন করা হচ্ছে ক্রেডিট কার্ড। সেই কার্ড দিয়ে অনায়াসে শপিং সারছেন এক শ্রেণীর সাইভার দুর্বৃত্তরা।

    একারণে পুলিশ, এফবিআইসহ সব গোয়েন্দা সংস্থা ব্যাপক অনুসন্ধান শুরু করেছে সবখানে। ২০১৮ সালে জালিয়াত চক্রের রাগব-বোয়ালসহ ধরা পড়ার কারণে কিছুদিন স্বস্তিতে ছিলেন গ্রাহকরা । আতঙর এর খবর হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বেশকিছু  বাংলাদেশিও ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির সাথে জড়িত হয়ে পড়েছেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ধরা পড়ার পর  বিচারে বিভিন্ন মেয়াদে  সাজা হয়েছে। এরমধ্যে  কয়েকজনকে সাজা শেষে আমেরিকা থেকে বিতাড়িতও করা হয়েছে।

    সুত্রমতে, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতর মামলা থেকে রেহাই পেতে কেউ কেউ আমেরিকা থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে বা কানাডা চলে গেছেন।এখনো বাংলাদেশি কমিউনিটির এমন কয়েকজন চিহ্নিত ব্যক্তি আছেন যাঁরা ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যদিও শর্ত সাপেক্ষে তাঁরা কারাগারের বাইরে আছেন। তাঁদের পাঁচ বছর ধরে প্রতি মাসে নিয়মিত থানায় হাজিরা দিতে হচ্ছে। মাসিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পুলিশকে অবহিত করতে হচ্ছে। জালিয়াতির জন্য ধরা পড়া অনেকের শরীরেই জিপিএস চিপস লাগানো রয়েছে । তাদের গতিবিধি সার্বক্ষণিক নজরে রাখা হচ্ছে।

    তাদেরই একজন আরিফ আহমেদ আশরাফ। ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি ধরা পরার পর তার শরীরেও জিপিএস চিপস লাগানো হয়৷  নিউইয়র্ক নগরের বাইরে যাওয়ার ওপর বিধিনিষেধ রয়েছে। আরিফ আহমেদ আশরাফ  পুলিশের নজরে থাকলেও তার অর্থবিত্তের দাপট এখনো দেখা যায়। তিনি ফ্লোরিডা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক , কমিউনিটির ডাকসাইটে নেতা।

    সুত্রমতে, যুক্তরাষ্ট্র যারা ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে  অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন তার মধ্যেই অন্যতম এই বিএনপি নেতা। কার্ড জালিয়াতির চক্র এভাবেই একাধিক সুপারমার্কেটের মালিক হয়েছেন। ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন।

    কম যান না যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত চীনারাও। গুয়াং মিং ঝাও, ৩৫ বছর বয়সী চীনের নাগরিক, যিনি কুইন্স, এনওয়াই এ বসবাস করেতেন। তিনি নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক একটি চীনা ভাষার সংবাদপত্র ওয়ার্ল্ড জার্নালের “ক্রেডিট” বিভাগে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন৷ ঝাও বিভিন্ন  ব্যক্তিদের  ব্যাঙ্ক বা ক্রেডিট কার্ড অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ পেতে সহায়তা করার প্রস্তাব দিয়ে ফেঁসে যান। জালিয়াতি প্রমাণিত হবার পর হার্টফোর্ডের মার্কিন জেলা বিচারক রবার্ট এন চ্যাটিগনি তাকে  সাজা দিয়েছেন। ঝাও কারাগারের  তত্ত্বাবধানে মুক্তির জন্য তিন বছর সময় গুনেন।

    দশবছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি চক্র ধরা পড়ে। চক্রের ১১১ জন সদস্যদের মধ্যে বাংলাদেশী বংশদ্ভূতসহ ১৩ জন এশিয়ানও ছিলেন। ৬.৫ মিলিয়ন ডলারের আপলসহ বিভিন্ন ব্যান্ডের মোবাইল ফোন কার্ড জালিয়াতি করে কিনে নেয় বড় সেই চক্র। ২০১৩ সালে একই ধরনের পরিচয় চুরি করে কার্ড জালিয়াতি ধরে ফেলে এফবিআই। ২০০ মিলিয়ন ডলার ফ্রড করে ১৮ জনের গ্যান্ক। তারা প্রায় ৭০০০ ভুয়া ঠিকানা তৈরি করে, কার্ড জালিয়াতি করেছিলেন। সেই জালিয়াতির ঘটনায় অভিযুক্তরা হলেন  নিউ জার্সির বাবর কোরেশী, বেলরুজের মোহাম্মদ শফিক, নিউইয়র্কের ইজাজ ভাট, নিউ ইয়র্কের কায়সার খান,নিউইয়র্কের ফ্লোরাল পার্কের শফিক আহমেদ, নিউইয়র্কের হাবিব চৌধুরী, রনবীর সিং, মোহাম্মদ নাবিদ, খাজা ইকরাম, নিউজার্সির নাসরিন আকতার, নিউইয়র্কের মোহাম্মদ খান, আজহার ইকরাম, শহীদ রাজা,পেনসিলভানিয়ার  বার্নিয়া এডার্মস, নিউজার্সির সাত বার্মা, বিজয় বার্মা, তারসাম লাল, বিনোদ দাদলানী। আটারোজনের মধ্য অধিকাংশই ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বংশদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক।

    সাম্প্রতিক সময়ে নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের বেশকিছু অঙ্গরাজ্যে ক্রেডিট কার্ড জালিয়াত চক্র আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। একারণে ছোট ছোট স্টোর অথবা যেকোনো জায়গায় একাধিকবার ক্রেডিট কার্ড সুইপ না করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কারণ মেশিনে কার্ডটি যতবার কার্ড সুইপ হবে ততবারই চার্জ হবে। মাসের শেষে এমন বিল বাড়াবে ভোগান্তি।

    যুক্তরাজ্যের লন্ডনেও  ইকবাল নামের এক বৃটিশ বাংলাদেশী পুরো বৃটেনে ক্রেডিট কার্ড ইকবাল নামে পরিচিত পান। বেশকিছু কার্ড জালিয়াতির ঘটনায় উঠে আসে অনেক বাংলাদেশী বংশদ্ভূতদের নাম।

    বিশেষজ্ঞদের মতে, যে সব প্রতিষ্ঠান একের অধিকবার ক্রেডিট কার্ড চার্জ করতে বলবে, তাদের অধিকাংশই ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতারণা করছে। কেউ যদি বলে আপনার কার্ড চার্জ হয়নি, সঙ্গে সঙ্গে ক্রেডিট কার্ড কাস্টমার সার্ভিসে কল করলেই জানা যাবে,  ওই স্টোরের চার্জ সম্পন্ন হয়েছে কি না।

    পরিচয় চুরির পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ২০২১ সালটি ছিল রেকর্ডের সবচেয়ে খারাপ বছর। এই বছর পরিচয় চুরির সংখ্যা বাড়তে থাকে। মহামারী প্রতিক্রিয়ায় লেনদেনের গতি ধীর হওয়া সত্ত্বেও সরকারী সুবিধা জালিয়াতি উচ্চতর রয়ে গেছে। প্রায় ৩,৯০,০০০ ব্যক্তি ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির অভিযোগ করেছেন। ব্যাংক জালিয়াতি আকাশচুম্বী, ৩৯%  বৃদ্ধির সাথে প্রায় এক লাখ পঁচিশ হাজার ভুক্তভোগীকে যোগ করেছে।

    যদিও গ্রাহকদের  অনেকেই ক্রেডিট কার্ডের ছোট ছোট চার্জের তেমন খেয়াল করেন না। মনে করেন, পাঁচ/দশ ডলারের বিষয় অথবা বিল আসলে দেখব। কিন্তু মাসের পরে এসব আর স্মরণে থাকে না। যেসব ব্যবসায়ী ইচ্ছা করে এসব করে তারা সুন্দর একটি হাসি দিয়ে বলবে, যদি দুবার চার্জ হয়ে যায় তবে ক্রেডিট কার্ডের বিল নিয়ে আসবেন। আমরা ঠিক করে দেব।এভাবে তারা একজন গ্রাহককে বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। অথচ তার সততা থাকলে মুহূর্তের মধ্যেই সে বিষয়টির সমাধান করে দিতে পারে। ক্রেডিট কার্ড মেশিনে যুক্ত আছে ডিলিটের বোতাম। সে চাপ দিলেই সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু তা না করে অনেক মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে।এ অবস্থায় ক্রেডিট কার্ড কোম্পানিগুলো যেকোনো কেনাকাটায় কার্ড চার্জে কার্ড মালিকদের প্রতি সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলো। প্রতারকচক্রের হাত থেকে বাঁচতে হলে সতর্ক থাকার বিকল্প নেই বলছেন তারা।

    বর্তমানে সেইপটি ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বেশ কিছু ব্যাংকের এটিএম বুথে। ব্যাংকগুলোর অ্যান্টি-কার্ড স্কিমিং প্রযুক্তির কারণে জালিয়াতির চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং স্বয়ংক্রিয় অ্যালার্ম সিস্টেমের মাধ্যমে প্রথমে ব্যাংক ও পরে পুলিশের কাছে প্রায় সাথে সাথেই সেই তথ্য চলে যায়।প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে গত এক-দেড় দশকে উন্নতবিশ্বে ব্যাংকিং কার্যক্রমে গুণগত পরিবর্তন এসেছে। অনলাইন ব্যাংকিং, এটিএম কার্ড, মোবাইল ব্যাংকিং ইত্যাদি সেবার মাধ্যমে ব্যাংকগুলো তাদের ব্যাংকিং সেবাকে গ্রাহকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে।

    এই সমস্ত ক্রেডিট এবং ডেবিট কার্ড লেনদেন প্রতারকদের জন্য ভাল খবর যারা এই অর্থপ্রদানের পদ্ধতিগুলিকে তারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে থাকে।একটি গবেষণায় দেখা গেছে,  ক্রেডিট এবং ডেবিট কার্ড জালিয়াতি বাড়ছে বিশ্বজুড়ে ৷  ২০২১ ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসরণ করে, গবেষণারত দল কমপক্ষে একটি ক্রেডিট কার্ডসহ ১০০০ টিরও বেশি মার্কিন প্রাপ্তবয়স্কদের অভিজ্ঞতা এবং ক্রেডিট কার্ডের অভ্যাস নিয়ে গবেষণা করে। গবেষণা অনুযায়ী , ক্রেডিট কার্ডের ক্ষেত্রে নানা জালিয়াতি ও প্রতারণার ঘটনাও ঘটছে। অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহকদের নানাভাবে বিড়ম্বনার শিকারও হতে হচ্ছে। এসব রোধে ব্যাংকগুলোকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। জোরদার করতে হবে নজরদারি কার্যক্রম। কারণ অনেক সময় ক্রেডিট-ডেবিট কার্ড জালিয়াত চক্রের সঙ্গে ব্যাংকের কর্মচারীদেরও যোগসাজশ থাকে।

    ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত অর্থলেনদেন শিল্পের উপর নজরদারি করে এমন সংস্থা নিলসনের রিপোর্ট  একটি পূর্বাভাস প্রকাশ করেছে যেখানে বলা হয়েছে   কার্ড জালিয়াতি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি আগামী দশ বছরে মোট $ ১৬৫.১  বিলিয়ন হবে, যা প্রতিটি রাজ্যের প্রতিটি বয়সী গোষ্ঠীকে জর্জরিত করবে।

    - Advertisement -spot_img

    সবশেষ খবর