::: ওয়াহিদ জামান ::
পৃথিবীর বহু দেশে গ্যাস, তেল, বিদ্যুৎ এর রাজনৈতিক চাল প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ব্যবহার করা হয়েছে। বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকেও ঘায়েল করার চেষ্টা করা হয়েছিলো। কৌশলের অংশ হিসেবে রান্নার কাজে গ্যাসের ব্যবহার নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটির কেন্দ্রীয় সংস্থা কনজ্যুমার প্রোডাক্ট সেফটি কমিশনের (সিপিএসসি) অন্যতম কমিশনার রিচার্ড ট্রুমকা জুনিয়র বলেছিলেন তারা গ্যাস হাব নিষিদ্ধের বিষয়টি বিবেচনা করছেন। সেসময় এটিকে ‘গোপন বিপদ’ বলেও উল্লেখ করেছিলেন তিনি। কিন্তু তার এই মন্তব্যে ফুঁসে ওঠেন রক্ষণশীলরা। অনেকেই এর জন্য সরাসরি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে দায়ী করেছেন।
এমন রাজনৈতিক দাবা খেলা সম্ভবত বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে। ঘূর্নিঝড় ‘মোখা’ আঘাত হানার আগেই কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্টিবিউশন কোম্পানী পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্যাস সরবরাহের বন্ধ থাকার ঘোষণা দেয়। অজুহাত ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ তাই চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকবে। অজুহাতটি কতখানি যৌক্তিক সেই বিষয়ে তর্ক বিতর্ক আছে। কিন্তু এক সপ্তাহ গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখা হবে এমন বার্তা মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। ফলে চট্টগ্রামে প্রতিটি গ্যাস সিলিন্ডারের দাম এক লাফে ৪০০/৫০০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্যাসের অভাবে ‘রান্নাঘর ‘ বন্ধ এমন সুযোগে প্রেসার কুকারের দাম বাড়ানো হয়েছে। চট্টগ্রামের রেয়াজউদ্দিন বাজারে দুই হাজার টাকার প্রেসার কুকার বিক্রি করা হয়েছে তিন হাজার টাকায়। সাধারণ মানুষের ভোগান্তিকে পুঁজি করে খাবার হোটেলগুলোও সুযোগ ছাড়ে নি। তারাও খাবারের দাম বৃদ্ধি করেছে। রাজনীতির গুটি হিসেবে গ্যাসের মতো জ্বালানি বাংলাদেশে কতখানি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে সেটি সামনেই প্রমানিত হবে।
আমাদের দেশে গ্যাসের চাহিদা মেটানো হয় দুইভাবে।একটি দেশীয় উৎপাদন দিয়ে অন্যটি এলএনজি আমদানি করে৷ দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে দৈনিক প্রায় দুই হাজার তিনশ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়৷ আর আমদানি করা হয় সাতশ থেকে সাতশ ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট৷ এলএনজি আমদানি করা হয় চারশ ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট৷
তবে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় পাঁচশ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি কেনা প্রক্রিয়াটি ঝুঁকিপূর্ণ। কারনে স্পট মার্কেট আনা দুইশ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি দেশে আকস্মিক সংকট কিংবা সরবরাহে বিপর্যয় ডেকে আনবে। সেই আশংকা সত্যি হয়েছে। গত বছরের জুলাই মাস থেকে উচ্চমূল্যের কারণে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ রাখা হয়েছে৷ এই ঘাটতি মেটানোর জন্য দেশীয় কূপগুলো থেকে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমকে জানিয়েছে পেট্রোবাংলা৷
বলছিলাম গ্যাসের রাজনীতি নিয়ে। আবাসিক বা বাণিজ্যিক পর্যায়ে গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে হলে হয় উৎপাদন বাড়াতে হবে নতুবা আমদানি বাড়াতে হবে৷ আমদানি বাড়ানো বেশ কঠিন কারণ বাংলাদেশ এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ডলার সংকটে আছে৷ অন্যদিকে বাংলাদেশে গ্যাসের প্রকৃত মজুত কত, নতুন গ্যাস কূপ খনন কবে সম্ভব হবে তা নিশ্চিত নয় বলেই রাজনৈতিক গুটি হিসেবে ‘গ্যাস’কে ব্যবহার করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
উৎপাদন বাড়ানোর জায়গাটিতে দেশের নিয়ন্ত্রণ খুবই কম। যদিও গ্যাস কূপ খননে বর্তমানে রাষ্ট্রায়াত্ব প্রতিষ্ঠান বাপেক্স এবং রাশিয়ার প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম নিয়োজিত আছে৷
সাধারনত আমাদের দেশে শীতকালে আবাসিক এবং শিল্পকারখানায় গ্যাসের চাপ কমে যায়। একইভাবে শীতে বিদ্যুতের পরিস্থিতি অত খারাপ থাকবে না। তাই বিদ্যুৎ ঠিক থাকবে কিন্তু শীতকালে আবাসিক এবং কলকারখানায় গ্যাসের সরবরাহ কমবে। আন্তর্জাতিক বাজারে যদি দাম কমে, যদি এলএনজি কেনা যায় তাহলেই গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি করা যাবে – এই সত্য কথাটি বলতে না পারাই সরকারের রাজনৈতিক ব্যর্থতা। স্বাভাবিকভাবেই গরমকালে সেই সংকট বেড়েছে।
রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণেই আমাদের দেশে গ্যাস কুপ অনুসন্ধান স্থবির। বলতে গেছে দীর্ঘ বাইশ বছর যাবত গ্যাস উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য কোন প্রাপ্তি নেই। একইভাবে কয়লাকেও রাজনৈতিক গুটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বাংলাদেশে। ২০১১ সালে সরকার ঘোষণা দেয় কয়লা উত্তোলন করা হবে । এরপর থেকে বলা যায় কয়লা উত্তোলন বন্ধ হয়ে আছে। কয়লা উত্তোলন বন্ধ হওয়ার মূল কারণটাও হলো রাজনৈতিক।
একটি রাজনৈতিক মহল আছে যাদের জনগণের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই। প্রান্তিক জনগণের উপবাস, নগরবাসীর সংকট ; তাদের মধ্যে কোন ভাবনা, তাড়না তৈরি করে না। কিন্তু তারা রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে বেশ পটু। দেখা যায় তেল-গ্যাসের ক্ষেত্রে ওই পক্ষটি বিদেশি বিনিয়োগের বিরোধিতা করে আসছে। বলা যায়, তাদের বিরোধিতার কারণেই ১৯৯৯ সালের পর থেকে দেশে আর কোনো বিদেশি কোম্পানি আসেনি। দুই একটা এলেও তেল গ্যাস অনুসন্ধানে কাজ করতে পারেনি। কারণ বিনিয়োগের পরিবেশ নেই। সরকার তাদের জন্য সহায়ক কোন নীতিও গ্রহণ করেনি। যে কারণে নিজস্ব অনুসন্ধান, উৎপাদন, তা কয়লা হোক বা গ্যাস, কোনোটাই আগায়নি। রাজনীতির এমন ছকে বাংলাদেশ বেশি মাত্রায় আমদানিনির্ভর হয়ে গেলাে। গ্যাস সংকটের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে এভাবেই।
রাশিয়া ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন কমানোর চেষ্টা হিসেবে ইউরোপের তেল ও গ্যাস বাজারে তার আধিপত্যকে ব্যবহার করছে। বলা হচ্ছে ইইউ’র গ্যাস ব্যবহারের ৪০ শতাংশের উপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত।
শীতের আগে সেই চাপ বাড়ানোর জন্য, রাশিয়া গতবছরের ৩১ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জার্মানির নর্ড স্ট্রিম (১)পাইপলাইন বন্ধ করে দিয়েছিলো। স্পষ্টতই রক্ষণাবেক্ষণের কথা বলে তারা সেটি করেছিলো। নিষেধাজ্ঞার ত্রাণ নিয়ে ব্রাসেলসের কাছ থেকে ছাড় চাওয়ার চেষ্টা হিসাবে এমন রাজনৈতিক কূটকৌশল নেয় রাশিয়া। এদিকে, একই গ্যাস রাজনীতির বলি হয়েছে যুক্তরাজ্যও । একইভাবে রাজনৈতিক ছক অনুযায়ী রাশিয়া ইউক্রেনে বিপুল পরিমাণ গ্যাস রপ্তানি করে -ইউক্রেনের ভূখণ্ডে সহিংসতার প্রথম পেরেক টুকেছে।
বাংলাদেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, সরকারের নীতি নির্ধারকদের বিবেচনা করতে হবে কিভাবে গ্যাস -তেলের রাজনীতি একটি রাষ্ট্রের জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে তুলে, ভিন্ন দেশের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করে।
লেখক :
ওয়াহিদ জামান, সাংবাদিক