গত বছরের মাঝামাঝি সময়ের কথা । পাঁচ সপ্তাহ স্বপরিবারে বাংলাদেশে কাটিয়ে লন্ডনে ফিরি। ঘরের দরজা খুলতেই মুখোমুখি হলাম একগাদা চিঠির । দেশ থেকে ফিরে প্রথম কাজ হলো চিঠিগুলো খুলে সতর্কতার সাথে দেখা- ভেতরে কী আছে । একটি একটি করে চিঠি খুলছি আর দেখছি ভেতরে কী আছে? বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, মর্গেজ কত কিছু । হঠাৎ একটি খাম খুলে দেখলাম কোর্টের চিঠি।
পূর্ব লন্ডনের স্নেয়ার্সব্রোক ক্রাউন কোর্ট থেকে চিঠিটি এসেছে । কোর্টের চিঠি দেখলে কিছুটা ভয় তো হওয়ারই কথা । প্রথমত: ভাবলাম, গাড়ির কোনো পার্কিং প্যানাল্টি চার্জ হতে পারে । হয়তো ৫ সপ্তাহ লন্ডনে না থাকায় যথাসময়ে জরিমানা পরিশোধ করতে পারিনি, তাই কোর্ট-অর্ডার এসেছে।
কিন্তু চিঠির কিছু অংশ পড়ে বুঝতে পারলাম এটা কোনো জরিমানার কোর্ট অর্ডার নয় । বরং সম্মানের । আমাকে স্নেয়ার্সব্রোক ক্রাউন কোর্ট একটি কেইসের বিচারের জন্য ‘জুরি’ নিযুক্ত করেছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ৯ মে সোমবার সকাল ৯টায় কোর্টে উপস্থিত থাকতে হবে । ওইদিন কেইসের শুনানী শুরু হবে । বিচারকার্য শেষ হতে ১০ থেকে ১১দিন সময় লাগতে পারে। প্রতিদিনই কোর্টে যেতে হবে । একজন বৃটিশ নাগরিকের দায়িত্ব হিসেবে যাওয়াটা বাধ্যতামুলকও।
লস অব আর্নিংস (উপার্জনের ক্ষতি) হিসেবে আমাকে প্রথম ১০দিন, প্রতিদিন যদি চার ঘণ্টার বেশি সময় কোর্টে থাকতে হয় তাহলে প্রতিদিনের জন্য ৬৪ পাউন্ড ৯৫ পেন্স দেওয়া হবে। আর যদি চার ঘণ্টা অথবা এর চেয়ে কম সময় থাকতে হয় তাহলে প্রতিদিনের জন্য ৩২ পাউণ্ড ৪৭ পেন্স করে দেওয়া হবে।
তবে বিচারের শুনানী যদি ১১দিন পর্যন্ত চলে তাহলে প্রতিদিন যদি ৪ ঘণ্টার বেশি সময় কোর্টে অবস্থান করতে হয়, তাহলে প্রতিদিনের জন্য দেওয়া হবে ১২৯ পাউণ্ড ৯১ পেন্স। আর ৪ ঘণ্টা কিংবা তার চেয়ে কম হলে প্রতিদিনের জন্য দেওয়া হবে ৬৪ পাউন্ড ৯৫ পেন্স । তাছাড়া যাতায়াত বাবদ প্রতি মাইল ড্রাইভিংয়ের জন্য দেওয়া হবে ৩১.৪ পেন্স করে। আর দুপুরের খাবার বাবদ দেওয়া হবে প্রতিদিন ৫ পাউন্ড ৭১ পেন্স।
কোর্টের চিঠি। একে তো বাধ্যতামুলক। তাছাড়া এলাউন্সও কম নয়। এরপর বিচারক না হয়েও কোর্টের বিচারকাজে অংশগ্রহণের সুযোগ পাওয়াটা আমার কাছে সৌভাগ্যের মনে হলো। আমি উপস্থিতি নিশ্চিত করতে তাদেরকে ইমেইল পাঠালাম ।
জুরি সার্ভিসে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার পর থেকে আমার মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করছিলো। আমি দিন গুনছিলাম কখন সেই কাঙ্খিত তারিখটি আসবে, যেদিন কোর্টরুমে বিচারকের সামনে বসে বিচারকার্যে অংশগ্রহণ করবো। অর্জন করবো নতুন এক অভিজ্ঞতা । অবশেষে সেই কাঙ্খিত দিনটি এলো। ৯ মে সোমবার।
সকাল ৯টার আগেই কোর্টে গিয়ে পৌঁছলাম। প্রথমদিন গাড়ি ড্রাইভ করে গেলামনা, কারণ কোর্ট প্রাঙ্গনে পার্কিং সুবিধা আছে কিনা জানা ছিলোনা । ট্রেন ধরেই গেলাম। স্নেয়ার্সব্রোক আন্ডার গ্রাউণ্ড স্টেশন থেকে মাত্র ৫মিনিটের দুরত্বে কোর্টের অবস্থান।
কোর্টের রিসেপশনে পৌছলে জিজ্ঞেস করা হলো- আমি কি জুরি সার্ভিসের জন্য এসেছি । এরপর যথারীতি অন্যদের মতোই সিকিউরিটি চেক হলো । অনেকটা এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি চেকের মতোই। মোবাইল ফোন, চাবি, মানি ব্যাগ, বেল্ট সবকিছু একটি ট্রেতে রেখে স্ক্রীনিং মেশিন দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হলো। এরপর আবার মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে পুরো দেহ পরীক্ষা নীরিক্ষা করা হলো । সিকিউরিটি চেক শেষে নিয়ে যাওয়া হলো একটি ওয়েটিং এরিয়ায়। সেখানে গিয়ে দেখলাম, আমার আগেই দুইজন পৌঁছে গেছেন । তাঁদের সঙ্গে হাই-হ্যালো বলে পরিচিত হলাম। তারাও জুরুর হিসেবে এসেছেন। (উল্লেখ্য, যিনি জুরি সার্ভিসে অংশগ্রহণ করেন তাকে ‘জুরুর’ বলা হয়)।
আধঘণ্টার মধ্যে আরো ২০/২৫ জন এসে যোগ দিলেন । এরপর একসময় ভেতর থেকে একজন অফিসার এলেন । আমাদের সকলকে জড়ো করলেন। আমরা তাকে অনুসরন করতে থাকলাম। তিনি আমাদের একটি বড় হল-রুমে নিয়ে গেলেন। হলের প্রবেশ দ্বারের কাছেই গোলাকার গ্লাস বেস্টিত একটি রিসেপশন ডেস্ক দেখলাম। ভেতরে একজন অশ্বেতাঙ্গ নারী ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছেন। তিনি হলেন জুরুর রুমের ম্যানেজার।
আমাদের বলা হলো, বিচার চলাকালে এটাই আমাদের প্রতিদিনের বসা বা অপেক্ষার স্থান । ১০টা বাজার আগেই দলে দলে জুরুররা আসতে থাকলেন । একসময় দেখা গেলো পুরো হলটি বিভিন্ন বর্ণের মানুষে ভরে গেছে । কমপক্ষে ৮০ জন জুরুর এসেছেন। টেবিল ও চেয়ার আছে। পাশে আছে চা-নাশতার কেন্ট্রিন ।
আমাদেরকে হলের কিছু নিয়ম-কানুন বুঝিয়ে দেওয়া হলো। তাছাড়া হলে প্রবেশের জন্য দরজার একটি কোড নম্বরও জানিয়ে দেওয়া হলো, যেন বাইরে বেরুলে পিন টিপে দরজা খুলে প্রবেশ করতে পারি ।
আমরা যার যার মতো করে বসে থাকলাম। কেউ কারো পরিচিত নন। হলের ভেতরে বসে ফোনকল করা নিষিদ্ধ। তবে মোবাইল সাইলেন্সে রেখে ম্যাসেজ চেক করতে বাঁধা নেই । যাওয়ার সময় সঙ্গে একটি বই নিয়ে গিয়েছিলাম। তাই আপাততঃ বইয়ের পাতায় মনোযোগ দিলাম। কোর্টের ডাক কখন পড়বে, কারো জানা নেই।
ছবি: স্নেয়ার্সব্রোক ক্রাউন কোর্ট বিলডিং
আদালতে বসে বিচারকের ডাকের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করাটা সম্ভবত সবচেয়ে বিরক্তিকর । আইনজীবীদের সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা থাকারই কথা । কারণ তাঁরা নিয়মিত তাদের ক্লায়েন্টের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করতে আদালতে হাজির হয়ে থাকেন। বিচারক কখন এজলাসে ওঠেন, আর কখন ডাকেন তার কোনো নিশ্চয়তা থাকেনা । তাই সারাদিনই অপেক্ষায় থাকতে হয়। একজন আইনজীবীকে মামলার শুনানীর তারিখে সকাল ১০টা আগেই আদালতে পৌছতে হয়। কিন্তু দিনশেষে যদি বিকেল ৪টার দিকে এজলাস থেকে ডাক পড়ে তাহলে দীর্ঘ ছয় ঘণ্টাই অপেক্ষা করতে হয়। এই ছয়ঘণ্টা অপেক্ষার সময় খুবই কষ্টের ।
আমরা জুরুর হলে বসে অপেক্ষা করতে থাকলাম। প্রয়োজনেও বের হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ কখন ডাক পড়ে কেউ জানিনা। বইপড়া, খবরের কাগজে চোখ বুলানো, চা-খাওয়া আর মাঝে মাঝে ওয়াশরুমে যাওয়া আসা ছাড়া আমাদের আর কোনো গত্যন্তর নেই। একটি হলরুমে বিভিন্ন বয়স ও জাতীয়তার প্রায় ৮০ জন মানুষ বসে আছেন। কারো সাথে কারো পরিচয় নেই।
আমরা একটেবিলে ৬ জন বসা ছিলাম। আমার পাশেই একজন শ্বেতাঙ্গ নারী ছিলেন। তার হাব-ভাব দেখে আঁচ করতে পারলাম তিনিও ভীষণ কষ্টে আছেন । অপেক্ষার সময় পার হচ্ছেনা। একসময় ‘হ্যালো’ বলে আমার সাথে আলাপ জুড়ে দিলেন। সময় তো পার করতে হবে। আমিও সানন্দে তার আলাপচারিতায় সাড়া দিলাম। তিনি একটি সেকেন্ডারী স্কুলের টিচার। জীবনের প্রথম জুরি সার্ভিসে এসেছেন। তার কাছেও এটি এক নতুন অভিজ্ঞতা। তিনিও এক্সাইটেড। কিন্তু অপেক্ষার প্রহর কাটছেনা।
কথা বলতে বলতে ১টা বেজে গেলো। দুপুরের বিরতি ঘোষনা করা হলো । যারা সাথে প্যাক লাঞ্চ নিয়ে গেছেন তারা স্বস্থানে বসেই খাবার খেতে শুরু করলেন। কেউ কেউ কেন্ট্রিন থেকে খাবার কিনে আনলেন, যেহেতু ৫ পাউন্ড ৭৬ পেন্স খাবারের জন্য বরাদ্দ আছে। তবে ঘর থেকে লাঞ্চ নিয়ে গেলেও কিন্তু খাবারের অ্যালাউন্স দেওয়া হয়।
দুপুরের বিরতি শেষে বিকেল ২টার মধ্যে আমরা ফের জুরুর রুমে ফিরে এলাম। বসে আছি। ছটফট করছি কখন ডাক পড়বে।
কিছুক্ষণ পরপর জুরুর ম্যানেজার গ্লাস বেস্টিত রিসেপশন ডেস্কের ভেতর থেকে এক নাগাড়ে লাউড-স্পিকারে নাম ডাকতে থাকেন। অনেকটা স্কুলের স্টুডেন্টস হাজিরার মতো।
তিনি যখন ডাকেন তখন এক একজন করে ওঠে দাঁড়িয়ে জুরুর ম্যানেজারের গ্লাসবেস্টিত ডেস্কের সম্মুখে দাঁড়ান । এরপর একজন ‘আশার’ (মামলার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে কোর্টরুমে নিয়ে যাওয়া-ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত অফিসার) আসেন । তিনি তাদের সকলকে জড়ো করেন। কিছু সময় ব্রিফ করেন । এরপর দলে দলে কোর্টরুমে নিয়ে যান।
আমরা সারাদিনই অপেক্ষা করলাম। কিন্তু ডাক পড়লোনা। অনেকটা ‘বিনা রশিতে বাঁধা’র মতো অবস্থা আমাদের । বিকেল ৪টায় আমাদের জানানো হলো, আপনারা আজকের মতো মুক্ত। যার যার বাসায় ফিরে যেতে পারেন । তবে কাল মঙ্গলবার সকাল দশটার মধ্যে কোর্টে এসে হাজির হতে হবে।
হল ত্যাগের আগে আরো কিছু নির্দেশনা দেওয়া হলো। বলা হলো, কোর্ট চলাকালিন সময়ে আমরা বিচার সংক্রান্ত ব্যাপারে কারো সাথে কোনো তথ্য শেয়ার করতে পারবোনা। এমনকি নিজের স্ত্রীর সঙ্গেও। করলে সেটা হবে দন্ডনীয় অপরাধ । (চলবে)
লেখক :::
তাইসির মাহমুদ, নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক দেশ, যুক্তরাজ্য