26 C
Dhaka
Thursday, October 2, 2025

এমন বাজেট, কেমন বাজেট

আরও পড়ুন

::: ওয়াহিদ জামান :::

একটি দেশের জীবনযাত্রার মান , বাজার নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রা ভান্ডার সবকিছুই বাজেটের সুতোয় বাঁধা। আমাদের দেশের সরকারগুলো বাজেট প্রনয়ণে কোনটিকেই গুরুত্বের চোখে দেখেনি। দেখেনি বলেই অর্থনৈতিক প্যারামিটারগুলো দিনকে দিন তলানিতে পৌঁছেছে। লোক দেখানো বাজেটেই লুকোনো থাকে  ‘শুভঙ্করের ফাঁকি ‘। সেই ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে সরকার বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি।কার্যকর করার হার, যা ২০১০-১১ সালে ৯৭ শতাংশের মতো উচ্চ ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে প্রায় আশি শতাংশের কাছাকাছি হয়েছে বলে বলা হলেও বাজেট লক্ষ্যগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। গত দশকে, বাংলাদেশে বাজেটের যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা আসলে সংখ্যার খেলা হিসাবেই আবির্ভূত হয়েছে, প্রতিটি বছরের লক্ষ্যমাত্রা আগের বছরের লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। বাজেটের খেলায় প্রকৃত অর্জনের পরিমাণ অর্থনৈতিক প্যারামিটারগুলোর অবস্থা দেখেই অনুমান করা যায়।

করোনা পরবর্তী বাজেটে সেই লোক দেখানোর বিষয়টি মাত্রা অতিক্রম করেছে বলেই অর্থনীতি দূর্বল হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সুসম বাজেট প্রনয়ণ  গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর যা আমাদের দেশে একটি ভাল, দক্ষ, কার্যকর প্রশাসন তৈরিকে প্রভাবিত করতে পারে।  সুসম বাজেট ধারনাটিতে পরিকল্পিত বিক্রয়ের পরিমাণ এবং রাজস্ব, সম্পদের পরিমাণ, খরচ এবং অর্থ, সম্পদ, দায় এবং নগদ প্রবাহ অন্তর্ভুক্ত।

রাজস্ব বাজেটের অংকটি সবসময়  অযৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা হয় সেটি দিন শেষে প্রমাণিত হয়েছে। মুলত সরকারের রাজস্ব প্রাপ্তি (কর রাজস্ব এবং অন্যান্য রাজস্ব) এবং এই রাজস্ব থেকে মেটানো ব্যয় নিয়ে গঠিত। বাজেট  দ্বারা আরোপিত কর ট্যাক্স রাজস্ব বাজেট  এবং অন্যান্য শুল্কের আয় গঠিত। অন্যান্য রাজস্ব মানে সরকারের এমন সব প্রাপ্তি যা প্রধানত সরকার কর্তৃক করা বিনিয়োগের সুদ এবং লভ্যাংশ,  সরকার কর্তৃক প্রদত্ত অন্যান্য পরিষেবার জন্য ফি এবং সেইখাতে প্রাপ্তি।সহজ কথায় রাজস্ব ব্যয় হল সরকারের বিভিন্ন  বিভাগ এবং বিভিন্ন পরিষেবার স্বাভাবিক পরিচালনার জন্য ব্যয়, সরকার কর্তৃক গৃহীত ঋণের সুদ, ভর্তুকি ইত্যাদি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে , চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল পর্যন্ত ) লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা। অথচ এই দশ মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা, আলোচ্য সময়ে আদায় হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। যদিও রাজস্বের এই আহরণ বিগত অর্থবছরের চেয়ে ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ বেশি।এরআগের বাজেট অর্থাৎ  ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতি হয়েছিলো। এবারের বাজেটেও রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা আরও ৬০ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে।সেটির যৌক্তিকতা ঘাটতির পরই বিশ্লেষণ করা যাবে। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) মতে,  চলতি অর্থবছর (২০২২-২৩) বাংলাদেশে রাজস্ব ঘাটতি হবে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এর ফলে বাজেট ঘাটতি নিশ্চিতভাবে আরো বাড়বে।বাজেট ঘাটতি ফলাফল আসলে কি? ফলাফল  হলো একটি দেশের উচ্চ স্তরের ঋণ গ্রহণ, উচ্চ সুদের অর্থপ্রদান এবং কম পুনঃবিনিয়োগ।  যার ফলে পরবর্তী বছরে রাজস্ব কম হবে। তাত্ত্বিকভাবে রাজস্ব ঘাটতি বৃদ্ধি, পুজিপতিদের আরও বেশি অর্থ প্রদানের মাধ্যমে একটি মন্থর অর্থনীতিকে উৎসাহিত  করতে পারে যারা পরবর্তীতে আরও বেশি কিনতে এবং বিনিয়োগ করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী ঘাটতি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। একটি সরকার যখন  রাজস্ব ঘাটতিতে দেশে  চালায় তখন ঋণ বাদ দিয়ে কর এবং অন্যান্য রাজস্ব থেকে আয়ের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করে। আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে এই ব্যবধানটি পরবর্তীতে সরকারী ঋণের মাধ্যমে বন্ধ হয়ে যায়, জাতীয় ঋণ বৃদ্ধি পায়।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন সম্ভব হলে দেশে একটি ভাল,  কার্যকর প্রশাসন তৈরি করাও সম্ভবপর হয়।  বাস্তবতা হলো একটি দেশের জন্য সঠিক বাজেট ছাড়া SDGs অর্জন করা যাবে না। যদিও এটি আগামী বছরের নির্বাচনের আগে শেষ বাজেট।  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য জনপ্রিয়তা  বিচক্ষণ নীতিনির্ধারণের পরীক্ষা এটি।  বৃহস্পতিবার বার্ষিক বাজেটে কর বাড়ানো এবং ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বাজেটের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করা হলেও এবার  আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের নির্দেশনার কারণে ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে। কারণ গেল জানুয়ারিতে আইএমএফ ৪.৭  বিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে।

প্রকট সংকটের মধ্যেও সরকারী ব্যয়ের গুণমান পরীক্ষা-নিরীক্ষার আওতায় এসেছে কম। বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাত-সংক্রান্ত পাবলিক ক্রয়ের ক্ষেত্রে অনিয়ম,বৃহৎ  প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয়ের অসামঞ্জস্যতা। দ্বিতীয়ত, শিল্প উৎপাদন ও উৎপাদন বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ছোট শিল্পগুলি তাদের বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পের তুলনায় পিছিয়ে গেছে। এছাড়া খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে,  অন্যদিকে খাদ্যবহির্ভূত আইটেমের ক্ষেত্রে উল্টোটা হয়েছে।  যদিও রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষেত্রে ইতিবাচক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়েছে, বিদেশী অভিবাসন, মূলধনী পণ্য আমদানি এবং বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহের ক্ষেত্রে উদ্বেগজনক প্রবণতা শংকা তৈরি করেছে। একারণে সংখ্যার খেলায় জনপ্রিয়তা তৈরির চেয়ে ম্যাক্রো-স্তরের সূচকগুলির প্রবনতা বা অবস্থা দেখেই বাজেট প্রনয়ণ জরুরি। আমাদের বাজেট প্রায়ই অর্থনীতির অন্তর্নিহিত মাইক্রো-লেভেল প্রবণতাগুলি ক্যাপচার করতে ব্যর্থ হয়। বিদ্যুৎ হ্রাস, বৈদেশিক মুদ্রার সীমিত ব্যবহার এবং জ্বালানী রেশনিংসহ চলমান পদক্ষেপগুলোর কারণে এখনও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকটে কোন বড় ক্ষত তৈরি করতে না পারলেও  বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি, রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতিকে সঙ্কুচিত করবে।  স্থানীয় মুদ্রার দৈনিক অবমূল্যায়ন এবং একটি তীব্র জ্বালানি সংকট—সামনের অর্থনীতির সুস্বাস্থ্যের জন্য অন্তরায় হবে।

একারণে সংখ্যার খেলায় জনপ্রিয়তা তৈরির চেয়ে ম্যাক্রো-স্তরের সূচকগুলির প্রবনতা বা অবস্থা দেখেই বাজেট প্রনয়ণ জরুরি।

- Advertisement -spot_img

সবশেষ খবর