:: নিজস্ব প্রতিবেদক :::
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেন আপত্তিকর ভিডিও কনটেন্ট তৈরির হাটবাজারে পরিণত হয়েছে। নানা কৌশলে কিশোরী আপত্তিকর ভিডিও সংগ্রহ একটি সংঘবদ্ধ চক্র। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপ্রাপ্ত বয়ক্ষ তরুনীদের আপত্তিকর ভিডিও ফাঁস করে ব্ল্যাক মেইলিং এবং ভিডিও দেশে-বিদেশে ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে জড়িত এই চক্রের মূল হোতাসহ ৯ (নয়) জনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি । মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ২০ হাজার আপত্তিকর ভিডিও কনটেন্ট রয়েছে ‘পমপম’ গ্রুপের কাছে।
আপত্তিকর’ ভিডিও ফাঁস করার ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগে এই নয়জনকে গ্রেপ্তার করে। অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।পুলিশের এই বিশেষ বিভাগটি বলছে, চক্রটি `আপত্তিকর’ ভিডিও ফাঁসের ভয় দেখিয়ে শুধু টাকাই আদায় করত না, এসব ভিডিও দেশে-বিদেশে বিক্রিও করতে।
সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মিয়া মোহাম্মদ আলী বলেন, বছরজুড়ে সিআইডির টিম সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে অনলাইনে নজরদারির পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় অভিযানও পরিচালনা করে। এরই ধারাবাহিকতায় নয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সিআইডি প্রধান অ্যাডিশনাল আইজি মোহাম্মদ আলী মিয়া, বিপিএম, পিপিএম বলেন, সিআইডি’র সাইবার পুলিশ সেন্টার (সিপিসি) এর একটি চৌকষ টিম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তরুণীদের আপত্তিকর ভিডিও ফাঁস করে ব্ল্যাক মেইলিং এবং সেসব ভিডিও দেশ-বিদেশে ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে জড়িত একটি চক্রের মূল হোতাসহ মোট ৯ (নয়) জনকে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও ঢাকার বিভিন্ন স্থান হতে গ্রেফতার করেছে।
গোয়েন্দা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে চক্রটিকে সনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে কাজ শুরু করে সিআইডির সাইবার পুলিশ। ভুক্তভোগিরা অভিযোগ করছিলেন, পমপম নামের একটি টেলিগ্রাম গ্রুপ তাদের গোপন ছবি ও ভিডিও হাতিয়ে নিয়ে তাদের ব্ল্যাকমেইল করছে, অর্থ দাবী করছে। অর্থ দিতে না পারলে ভিডিও কলে এসে আপত্তিকর কর্মকাণ্ড করতে বাধ্য করছে। আর কোনো প্রস্তাবেই সাড়া না দিলে ভিকটিমদের নাম-পরিচয় আর ব্যক্তিগত তথ্যসহ লাখ লাখ সাবস্ক্রাইবারের টেলিগ্রাম গ্রুপগুলোতে ভাইরাল করে দিচ্ছে। চক্রটি ওইসব ভিডিও দেশে-বিদেশে বিক্রি করেও কোটি কোটি টাকা আয় করেছে।
মাসে ১ থেকে দুই হাজার টাকা সাবস্ক্রিপশন ফি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, সিংগাপুর, পর্তুগাল, কানাডা, আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডের মত দেশের অসংখ্য ক্রেতা গ্রুপটির সদস্য হয়েছেন। তারা অল্পবয়সী মেয়েদের আপত্তিকর ওইসব কন্টেন্ট এনা এবং সংরক্ষণ করে থাকেন। চক্রটির নেতৃত্ব দেয় মার্ক-সাকারবার্গ নামের এক ব্যক্তি। মার্ক সাকারবার্গ হল টেলিগ্রাম অ্যাপস্ এ ব্যবহৃত ছদ্মনাম, আসল নাম আবু সায়েম, সে চট্টগ্রামে বসবাস করে। তার একাউন্টে কোটি টাকার অধিক লেনদেন হয়েছে। সে শ্যামলী পলিটেকনিক থেকে ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা পাশ করেছে।
মার্ক সাকারবার্গ ওরফে সায়েমের মোবাইল ফোন ডিজিটাল ফরেনসিক করে মার্ক-সাকারবার্গ আইডিটি লগইন করা অবস্থায় পাওয়া যায় এবং নিশ্চিত হওয়া যায় যে আবু সায়েমই মার্ক সাকারবার্গ।
তাকে জিজ্ঞাসাবাদে পমপম গ্রুপের যতগুলো চ্যানেল এবং গ্রুপ আছে তার এডমিনদের আসল নাম-পরিচয় পাওয়া যায়। এডমিনদের কাজ ছিল মার্কের হয়ে নতুন নতুন কন্টেন্ট যোগাড় করা। নতুন কন্টেন্ট পেতে তারা ফেইক এনআইডি বানিয়ে টার্গেটের ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রাম আইডি হ্যাক করতো এবং কখনো কখনো ভুক্তভোগি তরুণীদের সাবেক প্রেমিকেরাই নতুন নতুন কন্টেন্ট এই গ্রুপকে সরবরাহ করত। অর্থাৎ সুসময়ে প্রেমিকার যেসব অন্তরঙ্গ মুহুর্ত তারা ক্যামেরাবন্দী করেছে, সেগুলোই প্রতিশোধের নেশায় তুলে দেয় মার্ক-সাকারবার্গদের গ্রুপে।
মার্ক তার এডমিনদের দিয়ে সেগুলোতে মিউজিক বসিয়ে, ফেসবুক আইডি থেকে ছবি নিয়ে ৩০-৪০ সেকেন্ডের প্রমো বানিয়ে আপলোড করে তার গ্রুপগুলোতে। প্রমো দেখে যারা ফুল ভার্সন দেখতে চায়, তাদের ১ থেকে ২ হাজার টাকার প্রিমিয়াম সার্ভিস কিনতে হয়।
মার্ক সাকারবার্গ ওরফে সায়েম, অভ্র এবং শাকিলকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তাদের ডিভাইস তল্লাসী করে মার্ক-সাকারবার্গের বিভিন্ন পেজের এডমিনদের আসল পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
দেখা যায়, তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ডিটিআর শুভ ওরফে মশিউর রহমান। মশিউরের দায়িত্ব ছিল গ্রুপ থেকে কৌশলে কন্টেন্ট সেভ করে রাখা এবং নানা প্রলোভনে তরুণীদের অন্তরঙ্গ মূহুর্তের ভিডিও হাতিয়ে নেওয়া। মশিউর চট্টগ্রামের একটি ফিশিং কোম্পানীতে চাকরি করে। অবস্থান নিশ্চিত হয়ে তাকে কর্ণফুলি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় তার সহযোগী জসীমকেও। সায়েম এবং মশিউরকে জিজ্ঞাসাবাদে তাদের দেয়া তথ্যমতে ঢাকা বেইলি রোড এলাকা হতে এডমিন ক্যাকটাস ওরফে কেতন চাকমা, এল ডোরাডো ওরফে শাহেদ, সূর্য ওরফে মারুফ এবং মিঞা ভাই ওরফে নাজমুল সম্রাটসহ এ ঘটনায় এখনও পর্যন্ত সর্বমোট ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি।
মার্ক-সাকারবার্গ এবং তার সহযোগীদের গ্রুপ ও চ্যানেলগুলোয় সাবস্ক্রাইবের সংখ্যা প্রায় সোয়া চার লাখ। আর সেগুলোতে ২০ হাজার আপত্তিকর ভিডিও এবং প্রায় ৩০ হাজার কন্টেন্ট রয়েছে তাদের। অন্যদিকে মাসে ১ থেকে ২ হাজার টাকা ফি দিয়ে তাদের প্রিমিয়াম গ্রুপের সদস্য হয়েছেন দেশ-বিদেশের প্রায় সাড়ে সাতশ মানুষ। এ ঘটনায় ভূক্তভোগি অনেক কিশোরী ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর আত্মাহত্যার চেষ্টা করেছে। ভুক্তভোগী কিশোরীদের এ সময় বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও অভিভাবক সকলেই ভুল বুঝে থাকে।
এইবাংলা/ হিমেল