::: রাহাত আহমেদ :::
নদীমাতৃক বাংলাদেশের পিরোজপুরের বেলুয়া নদীর উপর ভাসমান বাজার গড়ে উঠেছে সেই পঞ্চাশের দশক থেকে। পিরোজপুর জেলা শহর থেকে ৪৩ কিলোমিটার উত্তর দিকে বৈঠাকাটা ‘ নামের এ ভাসমান সবজি বাজারটি গড়ে উঠেছে। ভাসমান এই কৃষি পণ্যের বাজারটি সারা দেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে।
নদী এবং নৌকা – এই দুইয়ের সংযোগে ‘বৈঠাকাটা’ নামের উৎপত্তি। নৌকার বৈঠা থেকে এই বাজারের নাম; যার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে আছে নৌকা।পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার বৈঠাকাটা বাজার সংলগ্ন বেলুয়া নদীতে সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার বসে এই ভাসমান হাট দেশের সবচেয়ে বড় ভাসমান বাজার। অর্ধশত বছর ধরে ভাসমান এই হাট বসছে পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার বৈঠাকাটা বাজার সংলগ্ন বেলুয়া নদীতে। সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার এই হাট পার করেছে ৬৫ বছর। দীর্ঘ সময় ধরে স্থানীয় ২০ থেকে ২৫ গ্রামের কৃষকরা এই হাটে বেচাকেনা করে আসছেন।
গ্রামে সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই বেলুয়া নদীর ঢেউয়ের ওপরে বসে ভাসমান কৃষি পণ্যের এই হাট। নৌকায় নৌকায় বসে শাক-সবজি, ধান, চাল, মাছ, ফল, আখ, নারকেলসহ বিভিন্ন পণ্যের পসরা। সকাল আটটা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত জমজমাট থাকে এই ভাসমান বাজার। স্থানীয়দের মতে, হাটের দিন কোটি টাকার শাক-সবজি বেচাকেনা হয় এখানে।
দৃষ্টিনন্দন এই হাট দেখতে চাইলে যেতে হবে নাজিরপুর উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলেমিটার দূরে বেলুয়া নদীতে। বৈঠাকাটা বাজার ও বেলুয়া মুগারঝোর গ্রামের পাশ দিয়ে বহমান এই নদী।
নৌকার উপস্থিতি এ বিলাঞ্চলের অধিবাসীদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে একাধিক ছোট বড় নৌকা। একারণেই বিস্তৃত হয়েছে বাজারটি। কান্দিবের ও ধাপ চাষসহ (ভাসমান শাক-সবজি উৎপাদন), সকল কৃষি পণ্যের আবাদ, পরিচর্যা, রক্ষণাবেক্ষন, পরিবহন, বাজারজাতকরণ, ব্যবসা- বাণিজ্য, শিক্ষার্থীদের স্কুল-মাদ্রাসায় যাতায়াত, সাধারণ চলাফেরা, বেড়ানো সবকিছুতেই এ ডিজিটাল যুগেও এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা নৌকা নির্ভর।

১৯৫৪ সালে বৈঠাকাটা বাজারের পাশে বেলুয়া নদীতে ভাসমান হাট বসা শুরু করে।তখন নৌকা ছাড়া যাতায়াতের কোন সুযোগ ছিলনা। বাজার প্রতিষ্ঠার পর আশপাশের গ্রামের কৃষকেরা নৌকায় করে তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য হাটে নিয়ে আসতেন। ক্রেতারাও কৃষিপণ্য কেনার জন্য নৌকা করেই হাটে আসতেন। সপ্তাহে শনি ও মঙ্গলবার নৌকা থেকে নৌকায় পণ্যের কেনাবেচা হতো তখন। যাতায়াতের তৎকালীন বৈশিষ্ট্যের কারণে বাজার শুরুর ঐতিহ্য নৌকার সেই ভাসমান হাট শুধু অব্যাহতই নেই তার প্রসার দিনে দিনে আরও বেড়ে চলছে। এখন প্রতি সপ্তাহে তিন দিন লঞ্চ যোগাযোগও রয়েছে বৈঠাকাটা বাজারের সাথে।
বেলুয়া নদীর এই হাটে মিলবে শালগম, বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, বেগুন, মরিচ, আলু, মিষ্টি কুমড়া, শিম, লাউ, করল্লা, কচুসহ নানা জাতের শাকসবজি। এসব কৃষিজ পণ্য লঞ্চে করে পৌঁছে যাচ্ছে সারাদেশে। সবজি ছাড়াও পাওয়া যাবে ফুলের চারা, ধান, চাল, মুড়ি ও নারকেল। এছাড়াও পাওয়া যাবে বিভিন্ন ধরনের মাছ ও মাছ ধরার সরঞ্জাম।
পিরোজপুরের নাজিরপুরে বৈঠাকাটা বাজার সংলগ্ন বেলুয়া নদীতে এবার বসেছে ভাসমান তরমুজের হাট। সপ্তাহে শনিবার ও মঙ্গলবার বসে এই হাট। তবে দাম গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ হলেও জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কিছুটা লোকসান হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে অধিকাংশ চাষীর। প্রতি বছর ক্ষেতে বসেই অধিকাংশ তরমুজ বিক্রি করলেও ভালো দাম পাওয়ার লক্ষ্যে ও লোকসানের হাত থেকে রক্ষা পেতে বৈঠাকাটা ভাসমান হাটে চাষীরাই নিয়ে আসছে তরমুজ।
ভাসমান হাট সংশ্লিষ্ঠরা জানিয়েছেন, এখানে স্থানীয়ভাবে তরমুজের চাহিদা মিটিয়ে অবশিষ্ট তরমুজ বিক্রির জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়। বিশেষ করে, বরগুনার তালতলী, কালাইয়া, কলাপাড়া, মহিপুর, রাঙাবালী, চেংরাতলা, গলাচিপা, ভোলা, চরফ্যাসন তথা দক্ষিণাঞ্চল থেকে নৌকা ও ট্রলার ভর্তি করে চাষিরা এ ভাসমান হাটে তরমুজ বিক্রি করতে আসে। তবে হাটের দিন ছাড়াও এখানে নিয়মিত কম বেশি স্থানীয়ভাবে পাইকারী-খুচরা বেচা-কেনা চলে।

এছাড়াও ঢাকা, গাজীপুর চৌরাস্তা, চাঁদপুর, সিলেট, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন এলাকার বেপারীরা তরমুজ কিনে ট্রাকে ও ট্রলারে করে নিয়ে যান এই সব এলাকায়। জানা যায় হাটের দিনে গড়ে মোট প্রায় কোটি টাকার তরমুজ বেঁচাকেনা হয় এই ভাসমান হাটে।
সরেজমিনে তরমুজের ভাসমান হাট ঘুরে দেখা গেছে, প্রচন্ড রৌদ্রের মধ্যে বিক্রেতারা নৌকায় ও ট্রলারে করে বিভিন্ন আকারের তরমুজের পসরা সাজিয়ে বসে আছে।
বেলুয়া নদীর আশপাশের এলাকার খাল বেয়ে ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় কৃষক সবজি নিয়ে হাটে যাচ্ছেন- এমন দৃশ্য নিত্যকার। সকাল ৭টার মধ্যে হাট সরগরম হয়ে ওঠে । বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা ট্রলার ও বড় নৌকা নিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে কৃষিপণ্য কিনে নিচ্ছেন।হাটে শালগম, বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, বেগুন, মরিচ, আলু, মিষ্টি কুমড়া, শিম, লাউ, করলা, কচু ও নানা জাতের শাকসবজি নিয়ে কৃষকরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দর হাঁকছেন। সবজির পাশাপাশি হাটে বিক্রি হয় শাকসবজি ও ফুলের চারা। হাটের এক পাশে রয়েছে ধান, চাল, মুড়ি ও নারিকেল বিক্রির স্থান।