25 C
Dhaka
Thursday, October 2, 2025

‘ বেগম বদরুন্নেছা’ স্মরণীয় নারী

আরও পড়ুন

::: আফরিন মাহী :::

বেগম বদরুন্নেছা আহমেদ,  তাঁর নামে বেশ কিছু স্কুল কলেজ রয়েছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। তাঁর নামেই নামকরণ করা হয়েছে রাজধানী ঢাকার বদরুন্নেছা কলেজ | বেগম বদরুন্নেসার ঝাপসা হয়ে আসা অতীতে তৃতীয় প্রজন্মের কালির দাগ। ১৯৭৪ সালের ২৫ শে মে  ক্যান্সারে মারা যান  ভাষা আন্দোলন, ছয়দফা আন্দোলন, স্বাধীনতার আন্দোলনের অকুতোভয়  এই নারী।তার ইন্তেকালের পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বকসী বাজার মহিলা কলেজের নাম করন করেন ‘ বেগম বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ’ । তার আরেকটি পরিচয় তিনি  স্বাধীন বাংলাদেশের দুইজন প্রথম নারী প্রতিমন্ত্রীর একজন।

বেগম বদরুন্নেসা আহমদের লেখাপড়ার সূচনা বেগম রোকেয়ার হাতে গড়া ‘ সাখাওয়াত মেমোরিয়াল মুসলিম গার্লস স্কুলে’ । বলা হয়ে থাকে সরাসরি বেগম রোকেয়ার ছায়া পড়েছে তার উপর। কাছাকাছি থেকে বেগম রোকেয়াকে দেখেছিলেন তিনি। ১৯৪২ সালে সেই স্কুল থেকেই তিনি পাশ করেন ম্যাট্রিকুলেশন। ১৯২৪ সালের ৩ রা মার্চ জন্ম নেওয়া বদরুন্নেসার বয়স তখন ১৮।

শহর সিলেট আর বেগম বদরুন্নেসার সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। একটা সময়ে  কেউ বুঝে উঠেনি ‘নূরী’ থেকেই সিলেটের মাটিতেই জন্ম নেবে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম নারী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ‘বেগম বদরুন্নেসা আহমেদে’। যশোর, খুলনা আর চট্টগ্রাম পার হয়ে ১৯৫২ সালে স্বামী  নুরউদ্দিনের পোস্টিং হয় সিলেট। নূরী ততদিনে একাধিক সন্তানের মা। ১৯৫৩ সালে সিলেটের এম.সি কলেজ থেকে মানবিকে স্নাতক পাশ করেন নূরী।  স্বামী নুরউদ্দিন আহমেদ তাকে “নূরী” নামেই ডাকতেন । প্রেমের বিয়ে। ১৯৫২ সালে সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রী থাকা অবস্থায় ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে উত্তপ্ত সিলেট শহরের বিভিন্ন মিছিল ও পদযাত্রায় শরিক হতে থাকেন বেগম বদরুন্নেসা। সে সময়কার অল পাকিস্থান উইমেন্স এসোসিয়েশনের সদস্য হিসাবে বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক কাজে অংশগ্রহনের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি পান “কুইন এলিজাবেথ কারনেশন মেডেল”। মিষ্টভাষী বদরুন্নেসার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছিলো ধীরে ধীরে।

কুষ্টিয়ার নূরউদ্দিনের সাথে নুরীর বিয়ে; সেও এক ইতিহাস। ১৯৪৪ সালে, সদ্য ইন্টারমিডিয়েট পাশ করা ডুমুরগ্রাম সিউড়ি কলকাতার নূরীকে প্রথম দেখেন, কুষ্টিয়ার আমলাপাড়ার ৩২ নম্বর এন.এস.রোডের নুরউদ্দিন। প্রথম দেখা শিলিগুড়ি শহরে। নুরউদ্দিন তখন বনবিভাগের অফিসার, চাকুরীর প্রথম পোস্টিং শিলিগুড়ি শহরের অদূরে বাগডোরাতে।

প্রথম দেখাতে কলকাতা শহরের আধুনিক স্মার্ট চটপটে নূরীকে ভালো লাগে নুরউদ্দিনের। এই ভালোলাগা আরো বৃদ্ধি পায়, যখন শিলিগুরি শহরের নূরীকে নিয়ে দুর্গাপুজা দেখতে বের হন নুরউদ্দিন। সেদিন শিলিগুরি শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীর বুকে শরীর এলিয়ে দিয়েছিলো জ্যোৎস্না। আর নূরী ও নুরউদ্দিন তখন হারিয়ে যান, গল্পের ভূবনে। নূরী বেশ কিছুদিন ছিলেন শিলিগুড়িতে। নূরীর সাথে গল্প করার লোভ সামলাতে না পেরে হুটহাট করে নুরউদ্দিন মাঝে মাঝেই হাজির হত নূরীর আবাসস্থলে।

একদিন হঠাৎ’ই নূরী চলে যায় কলকাতা। কিন্তু বাগডোগরার নুরউদ্দিনকে সে ভুলতে পারে না। চিঠি আদান প্রদানের মাঝে কখন যে মন আদান প্রদান হয়ে যাবে,কে জানত?

১৯৪৭ সালের ২৩ জুলাই দুইজনের হাত আদান প্রদান হয়। ১৯৪৪ সালে তৎকালীন কলকাতার বিখ্যাত “লেডি বার্বন কলেজ” থেকে পাশ করেন ইন্টার মিডিয়েট। এম.সি. কলেজের পাঠ চুকিয়ে, ১৯৬১ ও ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন যথাক্রমে মাস্টারস ইন এডুকেশন ও মাস্টার্স ইন পলিটিক্যাল সাইন্স ডিগ্রী। লেডি বারবন কলেজের ছাত্রী থাকাকালীন  মহা দুর্ভিক্ষের সময় বেগম বদরুন্নেসা আহমদ ভলেন্টেয়ারীতে অংশগ্রহণ করেন। দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের জন্য তিনি খাদ্য রান্না বান্নার কাজে সাহায্য করতেন।

সমসাময়িক প্রাদেশিক আইনসভার তোরজোড় প্রস্তুতি ও সেইবার নারীর প্রার্থী হওয়ার সুযোগ আসায়- স্বামী নুরউদ্দিন আহমেদের মনে হয়, বদরুন্নেসা নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষমতা রাখেন। বেগম বদরুন্নেসাকে সেটা জানাতেই বেগম বদরুন্নেসা নিজেও আগ্রহ প্রকাশ করেন। কুষ্টিয়া ও ঢাকার নিকটজনের পরামর্শে বদরুন্নেসা দেখা করেন হোসেন শহীদ সোরওয়ার্দী এবং আওয়ামীলীগের সেক্রেটারি তরুন তুর্কি শেখ মুজিবর রহমানের সাথে। বদরুন্নেসার সাহস ও ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে তাকে মনোনয়ন দিতে রাজী হলেন যুক্তফ্রন্টের নেতারা।

বদরুন্নেসা ঠিক করলেন নির্বাচন করবেন নিজের শ্বশুর বাড়ী এলাকা অর্থাৎ কুষ্টিয়া থেকে। শ্বশুরবাড়ির এলাকার আওয়ামীলীগের সমর্থন পেয়ে বদরুন্নেসার প্রথম নির্বাচনী এলাকা ঠিক হয় কুষ্টিয়া-খুলনা-যশোর-ফরিদপুর পৌরসভা।

নিজের তিন সন্তান যাদের সব থেকে বড় জনের বয়স ছয় আর ছোট জনের বয়স দেড়, সাথে নিয়ে বদরুন্নেসা নামেন নির্বাচনের লড়াইয়ে। নিজের বড় বোন এবং নুরউদ্দিন আহমেদের মেজ ভাই ডা. শামসুদ্দিন আহমেদে হলেন তার প্রধান সারথি। নুরউদ্দিন আহমেদ এর মিয়া ভাই তাজউদ্দিন আহমেদ দায়িত্ব নিলেন কুষ্টিয়ার ভোট দেখতে। সেজ ভাই বদরুদ্দিন আহমেদ কাজ করলেন সমান তালে। বদরুন্নেসার স্বামী নুরউদ্দিন আহমেদ তখন সিলেটের কর্মক্ষেত্রে, তার ছুটি নাই।

ভাবা যায়?  ১৯৫৪ সালে এক আধুনিক শিক্ষিত বাঙালী নারী, তিনটা বাচ্চা কোলে নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চাচ্ছে। যখন এই দেশে নারীদের জন্য কিছুই সহজ ছিলো না। প্রগতীকে দেখা হত নিষিদ্ধ চোখে। সমাজের ব্যাকা চোখ উপেক্ষা করে বদরুন্নেসা ছিনিয়ে আনলেন বিপুল ব্যবধানে বিজয়। নির্বাচিত হলেন প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য।

এই সময় দেশের পরিস্থিতি উত্তাল হতে শুরু করে। কুষ্টিয়া মোহিনী মিলের শ্রমিকদের সাথে মিলিটারি সরকার বিরোধী আন্দোলনে একাত্বতা জানিয়ে একমাসের জন্য কারাবরন করেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ।

বেগম বদরুন্নেসা এরপরে তিনবার নির্বাচিত হয়েছেন আইনসভার সদস্য। মৃত্যুর  দিন অবধি তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন নারী শিক্ষা ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক মন্ত্রীর দায়িত্ব।

১৯৬০ সালে বেগম বদরুন্নেসা লালমায়টিয়া মহিলা কলেজে সালে ভাইস প্রিন্সিপাল হিসাবে চাকুরী শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে প্রিন্সিপাল থাকাকালীন মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করতে, লালমাটিয়া মহিলা কলেজের প্রিন্সিপাল পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

ষাটের দশকের প্রথমার্ধে ধানমন্ডির ৩২ নাম্বার সড়কের ৬৭৮ নাম্বার বাড়িতে স্থায়ী আবাসন গড়েন নুরুউদ্দিন-বদরুন্নেসা দম্পত্তি। ৬৭৭ নাম্বার বাড়ি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের যিনি সেই সময়পুরাটাই পাকিস্থান সরকার নজরদাড়িতে থাকতেন। পাকিস্থান সরকারের নজর এরিয়ে বেগম বদরুন্নেসা ৬৭৮ নাম্বার বাড়িতে কখনো কখনো চা-পার্টির আড়ালে গোপন শলাপরামর্শ করতে  দেশের কেন্দ্রীয় নেতারা জড় হতেন। যেইসব মিটিং এ উপস্থিত থাকতেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু।

১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনকে ত্বরাণিত করতে, ও আন্দোলনে নারীদের উপস্থিতি বৃদ্ধির লক্ষ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ‘বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামীলীগ’ অংশ চালু করেন। বেগম বদরুন্নেসা হন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।সেই সময় বেগম বদরুন্নেসা প্রতিষ্ঠা করেন গণ সাংস্কৃতিক পরিষদ। যার উদ্দেশ্যে ছিল, ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ ও আন্দোলন গড়ে তোলা।

১৯৭১ সালে বেগম বদরুন্নেসা ভারতের শরনার্থী শিবিরে রামকৃষ্ণ মিশন ও সারদা সেবা সংঘের সহায়তাতে বাংলাদেশী রিফিউজি ক্যাম্পগুলাতে খাদ্য পৌঁছে দেওয়া। একই সাথে তার অন্যতম দায়িত্ব ছিল, বিভিন্ন রিফিউজি ক্যাম্পের তত্বাবধায়ন এবং তাজউদ্দিন আহমেদকে রিফিউজি ক্যাম্প সমূহের হালনাগাদ তথ্য রিপোর্ট করা। দেশ স্বাধীনের পরে বেগম বদরুন্নেসা প্রতিষ্ঠান করেন, Bangladesh Women’s Rehabilitation and Welfare Centre ।যেখানে বীরাঙ্গনাদের আশ্রয় দেওয়া হতো।বেগম বদরুন্নেসার অধীনেই রাজনীতিতে আসেন, আইভি রহমান, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, সাহারা খাতুনসহ অসংখ্য নারী নেত্রী।

১৯৫৪ সাল থেকে রাজনীতি জড়িয়ে পড়লেও স্বাধীনচেতা বেগম বদরুন্নেসা তার সংসার ধর্মত্যাগ করেন নি। দীর্ঘ ২৭ বছরের সংসার জীবনে সংসারে হাল তিনিই ধরে রেখেছিলেন। স্বামীর ব্যস্ত অফিস জীবন, ঘনঘন বদলির চাকুরীর সাথে নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শিক্ষকতা সমান তালে ধরে রেখেছিলেন ।নারীর রুপ হাজারটা,  নারীর ক্ষেত্র হাজার। নারী সব ক্ষেত্রেই সফল ; বেগম বদরুন্নেসা তার বলিষ্ঠ উদাহরন।

বেগম বদরুন্নেসা ১৯৭৪ সালের ২৫ শে মে  ক্যান্সারে মারা যান।  তার মৃত্যুর  পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বকসী বাজার মহিলা কলেজের নামকরন করেন, ‘বেগম বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ’ ।নতুন প্রজন্ম  বেগম বদরুন্নেসা  সম্পর্কে জানেন খুবই  কম।পাঠ্যপুস্তকেও জায়গা হয় নি তার। তাই তো  অনেকের কাছেই বেগম বদরুন্নেসার ঝাপসা হয়ে আসা অতীতে তৃতীয় প্রজন্মের কালির দাগ। তার মৃত্যুর ২৫ বছর পরে, ১৯৯৯ সালে বেগম বদরুন্নেসা আহমেদ অর্জন করেন দেশের সর্বোচ্চ  খেতাব ‘স্বাধীনতা পুরস্কার ‘। দেশের মানবিক রাজনীতিবিদ এই মানুষটা আর নেই,  তার কাজগুলো থেকে গেছে।  স্মৃতির বইয়ে ধুলো পড়েছে। আস্তে আস্তে বইয়ের পৃষ্ঠাগুলা মলীন হচ্ছে। একদিন হয়ত পৃষ্ঠাগুলা ছিঁড়ে যাবে। শুধু আমরাই পারি এই পৃষ্ঠাগুলাকে সযত্নে ধরে রাখতে। পুরাতন বইকে নতুনে রূপ দিতে।

তথ্যসুত্র : প্রীতম আজীম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

সবশেষ খবর