সানাউল্লাহ রেজা শাদ, বরগুনা::
একসময় বই-খাতাই ছিল যাদের সঙ্গী, আজ তারাই বরগুনায় আতঙ্কের নাম। ৮ম শ্রেণি থেকে শুরু করে কলেজের প্রাথমিক বর্ষ পর্যন্ত—অর্থাৎ ১২ শ্রেণি পর্যন্ত—শিক্ষার্থীরাই এখন কিশোর গ্যাংয়ের মূলে। এরা দিনে-দুপুরে প্রকাশ্য সড়কে মারামারি করছে, এমনকি ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করছে। মারধরের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে, যেন এটি তাদের কাছে এক ধরনের বিনোদন।
চোখের সামনে দিনের আলোয় সংঘর্ষ ও অপরাধ সংঘটিত হলেও প্রশাসনের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে মানুষ। ঘটনাস্থল থেকে ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে যাওয়ার পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেক সময় ঘটনাস্থলে পৌঁছায় না বা ব্যবস্থা নিতে দেরি করে। ফলে কিশোররা আরও সাহসী হয়ে উঠছে।
কিশোর গ্যাং গুলোর হাতে এখন সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ নানা নেশাজাতীয় দ্রব্য। অল্প টাকার বিনিময়ে তারা মাদকের দুনিয়ায় ঢুকে পড়ছে। অনেককে আবার রাজনৈতিক নেতারা সামান্য ক্ষমতা ও প্রভাবের স্বাদ দিয়ে অপরাধ জগতে নামিয়ে আনছে। এর ফলেই এরা অপরাধকে ‘বীরত্ব’ ভেবে বসছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন— নৈতিক শিক্ষার অভাব, পারিবারিক বন্ধনের অবক্ষয় এবং সামাজিক পরিবেশের সংকটই এই কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির মূল কারণ। আজকের প্রজন্মকে বাবা-মা মোবাইল হাতে দিয়ে ব্যস্ত জীবনযাপনে ডুবে যাচ্ছেন, অথচ সন্তানের চলাফেরা, বন্ধু মহল কিংবা রাতের আড্ডার খবর নিচ্ছেন না। সেই ফাঁকেই তৈরি হচ্ছে বিপথগামী কিশোর।
বরগুনা সরকারি কলেজ এর একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী ‘তোফা’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি পোষ্টে কমেন্ট করায় বরগুনা সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ের পরিত্যাক্ত ভবনের পাশে উঠিয়ে নিয়ে করা হয় মারধর ও বলা কিশোর গ্যাং এর একজনের থুথু মাটি থেকে জিভ দিয়ে তুলতে । এই ঘটনা ভিডিও করে পরবর্তীতে ছড়িয়ে দেওয়া হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ।
শুধু সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ের পরিত্যাক্ত কিংবা উপজেলা খেলার মাঠ প্রাঙ্গনেই নয় শহরের বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত প্রকাশ্যে হচ্ছে এসব অপরাধ।
বরগুনা সরকারি কলেজ , সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি বালিকা বিদ্যালয়, আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, দরুদ উলুম নেছারিয়া কামিল মাদ্রাসা ( আলিয়া মাদ্রাসা) , কলেজিয়েট মাধ্যমিক বিদ্যালয়, আইডিয়াল কলেজ সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বললে তারা জানান — প্রতিষ্ঠান ছুটি , টিউশনিতে যাতায়াত এবং বিকাল বেলা একটু ঘুরতে কিংবা হাঁটতে বের হলে প্রায়শই ইফটিজিং, অশালীন অঙ্গভঙ্গির স্বীকার হতে হয়ে । প্রতিবাদ করলে পড়তে হয় তাদের টার্গেটে। অনেক সময় একটু সন্ধ্যা হলে নির্জন এলাকা দিয়ে হাঁটতে হয় লাগে সাথে পরিবারের কেউ থাকলে হেনস্থার স্বীকার হতে হয় তাদেরকেও।
এদের থেকে রেহাই পাচ্ছে না বৃদ্ধ’রাও । শুধু শহর কেন্দ্রিক নয় এসব অপরাধ ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছে গ্রাম অঞ্চলেও ।
যার ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে আতঙ্কের।
গৃহিণী রোকেয়া বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,
“আমরা এখন সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে ভয় পাই। দুপুরে রাস্তা দিয়ে হাঁটলেও আতঙ্ক থাকে, হঠাৎ কিশোর গ্যাং ঘিরে ধরবে। আগে চোর-ডাকাতকে ভয় পেতাম, এখন কিশোরদের ভয় লাগে।”
স্থানীয় আব্দুল হাকিম বলেন,
“এই কিশোররা নিজেরা এত সাহসী নয়। মাদক কারবারি, রাজনৈতিক নেতা কিংবা স্থানীয় প্রভাবশালীরা তাদের উস্কে দেয়, টাকা দেয়, আশ্রয় দেয়। ফলে তারা মনে করে, তাদের কিছুই হবে না। এই ভ্রান্ত ধারণাই আজকের অপরাধ প্রবণতার মূল উৎস।”
বরগুনা সরকারি কলেজ সংলগ্ন মসজিদের ইমাম বলেন,
“৮ম থেকে ১২ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষা ও চর্চার পরিবেশ এখন প্রায় নেই। তারা মোবাইল আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্ত। ফলে সামান্য উস্কানিতেই তারা মারামারি এমনকি মাদক ব্যবসার হাতিয়ার হয়ে যাচ্ছে।”
নেপথ্যে থেকে কারা দিচ্ছে উস্কানি? এমন প্রশ্ন যেন ভেসে ওঠে প্রতিটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে জনমনে ।
একটু বিশ্লেষণ করলে — এধরনের কিশোর অপরাধের নেপথ্যে রয়েছে একাধিক উস্কানিদাতা।
•মাদক ব্যবসায়ীরা কিশোরদের প্রলুব্ধ করছে টাকা ও নেশার বিনিময়ে। তারা জানে, অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় এদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ প্রায়ই সীমিত থাকে।
•স্থানীয় রাজনৈতিক ছত্রছায়া কিশোর গ্যাংদের আরও বেপরোয়া করছে।
•প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানো কিংবা প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে।
•অঞ্চলভিত্তিক প্রভাবশালী ও দাগি অপরাধীরা নিজেদের স্বার্থে এসব কিশোরকে মাঠে নামাচ্ছে ।
পরিবারে সন্তানকে সঠিক নজরদারিতে রাখা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক-সৃজনশীল কার্যক্রম বাড়ানো এবং সমাজে নৈতিক মূল্যবোধ পুনর্গঠিত করাই হতে পারে সমস্যার সমাধান।
প্রশাসনকে নিতে হবে এখনই কঠোর পদক্ষেপ । মাদক ব্যবসায়ী ও উস্কনিদাতাদের বিচারের আওতায় আনা ছাড়া বিকল্প নেই।
বরগুনা পুলিশ সুপার ইব্রাহিম খলিল জানিয়েছেন , কিশোর অপরাধ দমনে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। বেশ কয়েকটি গ্যাং ভেঙে দেওয়া হয়েছে, সদস্যরাও আটক হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি এদের নেপথ্যে কারা তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার।
তবে স্থানীয়দের মনে প্রশ্ন থেকেই যায় —প্রতিনিয়ত কেন নতুন গ্যাং জন্ম নিচ্ছে? কেন তাদের দাপট দিনে-দুপুরে এতটাই বেপরোয়া? এর পেছনে কি প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক ছত্রছায়া নেই?