26 C
Dhaka
Thursday, October 2, 2025

আসন্ন নির্বাচন ও পিআর পদ্ধতির বিতর্ক – গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কোন পথে

আরও পড়ুন

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গত ৫৪ বছরে ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি নির্বাচন নিয়ে বিতর্কও দেখা হয়। দীর্ঘ পথচলায় দেশে এখন পর্যন্ত একটি স্থায়ী ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। সাম্প্রতিক সময়ে তিনটি নির্বাচনকে ঘিরে যেমন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, তেমনি আসন্ন নির্বাচনে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়টিও বেশ বিতর্কের মুখে পড়েছে। এবার মূল আলোচনার বিষয় ‘নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে’।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত ‘ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট’ পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়। অর্থাৎ এই পদ্ধতিতে একজন ভোটার শুধুমাত্র একজন প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন এবং যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পান তিনিই জয়ী হন। এই পদ্ধতিতে একটি নির্বাচনী এলাকা থেকে শুধুমাত্র একজন প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কয়েকটি রাজনৈতিক দল আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (পিআর) নির্বাচনের দাবি তুলছে। তবে, বিএনপিসহ কিছু দল এর বিরোধিতা করছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ‘স্বল্প সময়ের মধ্যে পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব, সেটাই এখন মূল প্রশ্ন’।

পিআর পদ্ধতির ভালো দিক ও ঝুঁকি
বিশ্লেষকরা বলছেন, পিআর পদ্ধতির ভালো দিক হলো- যে দল নির্বাচনে যত শতাংশ ভোট পাবে, সংসদে তারা সেই অনুপাতে আসন পাবে। এতে করে ছোট-বড় সব দলের সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ থাকবে। সংসদে কোনো দলের একক কর্তৃত্ব থাকবে না। তখন রাজনৈতিক দলগুলো নীতিকেন্দ্রিক অর্থাৎ নীতি দ্বারা পরিচালিত হবে।
তবে তারা এটিও বলছেন, ‘বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই পদ্ধতি হঠাৎ করে চালু করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আগামী ছয় মাসের মধ্যে যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে জনসাধারণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে এই পদ্ধতি বোঝাতে সময়ই থাকবে না।’

এ বিষয়ে নির্বাচন বিশ্লেষক অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘এটিতে (পিআর) কোনো দল লাভবান হবে আর কোনো দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেটি বড় বিষয় নয়। নির্বাচনটা কতটুকু গণতান্ত্রিক হবে, সেটিই বড় জিনিস। পিআর পদ্ধতি বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে পরিচালিত হয়। তবে, আমাদের দেশে একটা নির্বাচনকে সামনে রেখে হঠাৎ করে পিআর পদ্ধতিতে যাওয়াটা খুব সহজ হবে না।’ পিআর পদ্ধতিতে জটিল কিছু বিষয় আছে উল্লেখ করে এই নির্বাচন বিশ্লেষক বলেন, ‘এটি আগে বুঝতে হবে। বিভিন্ন দেশে পরিচালিত এই পদ্ধতির ওপর গবেষণা করতে হবে। এরপর কোনটা আমাদের জন্য উপযুক্ত, সেটি বের করতে হবে। তাই বাংলাদেশে এই মুহূর্তে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে করাটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হবে বলে আমার মনে হয়।’

‘যদি ছয় মাসের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে হঠাৎ করে পিআর পদ্ধতিতে যাওয়া উচিত হবে না। কারণ, মানুষকে তো এই পদ্ধতি আগে বুঝতে হবে।’

পিআর পদ্ধতির বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পিআর পদ্ধতির প্রয়োগ হয়। সেখানে এককেন্দ্রিক ব্যবস্থায় এটির প্রয়োগ হয়। আমরা তো সেই পদ্ধতিতে নেই। আমাদের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলও নেই। সুতরাং এখানে ব্যাপক প্রতিনিধিত্বের জন্য আনুপাতিক নির্বাচনের প্রয়োজন নেই। সেই কারণে আনুপাতিক নির্বাচনের যে ন্যায্যতা, সেটি খুব বেশি আমাদের দেশে টেকে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘সব দল মনে করলে এটি চালু করতে পারে। কিন্তু এটি যারা চাচ্ছে তারা যদি শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে এ চিন্তা করে, তাহলে ঠিক হবে না। কারণ, আমরা তো রাজনৈতিক দলের অংশ চাই না, চাই ভোটারদের অংশ কিংবা প্রতিনিধিত্ব।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে এখনও রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনয়ন প্রক্রিয়া পুরোপুরি স্বচ্ছ নয়। পিআর পদ্ধতিতে আগে ৩০০ জনের মনোনয়ন একবারে দিয়ে দিতে হবে দলগুলোকে। মানুষ দলের প্রতীকে ভোট দেবে। নির্বাচনে যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সেই অনুযায়ী সংসদে আসন পাবে। এর বাইরে সর্বনিম্ন কত শতাংশ পর্যন্ত ভোট না পেলে সংসদে আসন পাবে না, সেটিও ঠিক করতে হবে।

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে বাংলাদেশে কোনো দল এককভাবে সরকার গঠনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারবে না বলেও মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, সরকার গঠনের জন্য ছোট ছোট দলগুলোর ওপর নির্ভর করতে হবে বড় দলগুলোকে। ফলে সংসদে অনৈক্য তৈরি হবে। এছাড়া, ছোট দলগুলোর নানা চাহিদা তৈরি হবে। ফলে বাংলাদেশের বিশৃঙ্খল রাজনীতি আরও বেশি বিশৃঙ্খল হয়ে উঠবে।

এ প্রসঙ্গে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘পিআর পদ্ধতিতে গেলে তো ৩০০ জনের নমিনেশন (মনোনয়ন) একবারে দিয়ে দিতে হবে দলগুলোকে। মানুষ দলের প্রতীকে ভোট দেবে। এখন আপনি ভোট পেলেন ৩০ শতাংশ। তাহলে সংসদে আনতে পারবেন ৩০ শতাংশ প্রতিনিধিকে। আপনি এই ৩০০ জন প্রার্থীর মধ্যে কাদেরকে সংসদে আনবেন, এজন্য নির্দিষ্ট একটি ফর্মুলা লাগবে।’

‘সেটি নির্ধারণে গণতান্ত্রিক নীতিমালা থাকতে হবে। এখন প্রশ্ন আসছে, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র কি সেই পর্যায়ে পৌঁছেছে? এখনও আমাদের এখানে এই নীতি চলছে যে, আমি মারা যাওয়ার পর আমার ছেলে, মেয়ে কিংবা স্ত্রী এমপি হবে। এই জাতীয় জায়গাগুলো কীভাবে ঠিক করবেন? আগে এগুলোতে আমাদের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা পরিবারকেন্দ্রিক নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’
বাংলাদেশে আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চালু হলে তা বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকবে মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক মাহবুব রহমান। তার মতে, ‘এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। তখন সরকার গঠনের জন্য ছোট ছোট দলগুলোর সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে হবে। তখন সংসদে থাকবে অনৈক্য। সরকারগুলো হবে দুর্বল এবং উদ্ভূত সরকারের পতন ঘটবে। এতে বাংলাদেশ আরও সংকটে পড়ে যাবে।’

অন্যদিকে, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থীর বাইরে বাংলাদেশে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন অনেকে। পিআর পদ্ধতিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ খুবই কম। তাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া কী হবে সেটিও আগে নির্ধারণ করতে হবে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

স্থানীয় সরকার ও সংসদের উচ্চকক্ষে পরীক্ষামূলক পিআর হতে পারে
নানা প্রতিবন্ধকতা থাকলেও বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দিকে যেতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাথমিকভাবে স্থানীয় সরকারের কিছু কিছু নির্বাচন বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে। এমনকি সংসদের উচ্চকক্ষের (যদি গঠন করা হয়) ৫০ শতাংশ আসনও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন করা যেতে পারে।

তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘পিআর পদ্ধতি অনেক ভালো ব্যবস্থা। যদি এটি ঠিকভাবে প্র্যাকটিস করা যায়। এটিকে ফেলে দেওয়া যাবে না। কলম্বো সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়। আমরাও পরীক্ষামূলকভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অর্থাৎ দু-একটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এটি প্রয়োগ করতে পারি।’
‘এছাড়া সংসদের উচ্চকক্ষের ৫০ শতাংশ আসন পিআর পদ্ধতিতে করা যেতে পারে’ মনে করেন তোফায়েল আহমেদ।

পিআর পদ্ধতি চালু হলে লাভবান হবে যারা
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ বেশ কয়েকটি দল আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে করার দাবি তুলেছে। অন্যদিকে, বিএনপি এবং তাদের যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী দলগুলোসহ একাধিক দল প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সংসদে তারা সেই অনুপাতে আসন পাবে। অর্থাৎ কোনো দল যদি ৩০ শতাংশ ভোট পায়, ওই দল সংসদের ৩০ শতাংশ আসন পাবে। বর্তমান বিশ্বে প্রায় ৮০টির বেশি দেশে এই পদ্ধতিতে ভোট হচ্ছে। তবে, দেশভেদে এই ব্যবস্থার রূপ ও কাঠামো আলাদা।
বাংলাদেশে বিগত নির্বাচনগুলোর ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোট সবচেয়ে বেশি। এরপর জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন ভোটের শতাংশে এগিয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রচলিত ‘ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট’ পদ্ধতিতে একটি আসনে চারজন প্রার্থী থাকলে সেখানে যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পান, তিনিই বিজয়ী হন। এখানে ভোটের শতকরা হার বিবেচ্য নয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

সবশেষ খবর