বিশেষ প্রতিনিধি :::
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের হতাশা প্রকাশ ও পদত্যাগ করার ভাবনা প্রসঙ্গে নানা আলোচনার জন্ম হয়েছে। বাড়ছে গুজব, অনিশ্চয়তা ও প্রশাসনিক স্থবিরতা। অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করার কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত বরফ গলতে শুরু করেছে। এনসিপির সাথে বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিএনপি ও জামায়াত ও দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে বৈঠকে বসতে সম্মত হয়েছেন। এর আগে গত ৪৮ ঘণ্টায় ছিল অনেক নাটকীয়তা। যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগে আবেগের সুরও ছিল চড়া। সংকট মোকাবিলা না করে পদত্যাগের বিষয়টি ভালোভাবে নেয় নি দেশের সাধারণ নাগরিক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
সেই হিসেবে শনিবার দিনের শেষে বৈঠক দুটি হওয়ার কথা রয়েছে। সেনাবাহিনীর অবস্থান, বিএনপি ও এনসিপির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির পর পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়া ড. মুহাম্মদ ইউনুস নতুন কৌশল নির্ধারণ করে সরকারকে এগিয়ে নিতে চান। তবে বিএনপির সাথে আলোচিত এই বৈঠকের পরেই প্রফেসর ইউনূস তার ভবিষ্যৎ নীতিকৌশল ঠিক করবেন এমনটাই বলা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করতে এমন সংকট তৈরি করেছে। পরিকল্পনা অংশ হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূসকে জনবিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। একইভাবে ৫ ই আগস্টের পর অভ্যুত্থানের মূল শক্তি বিএনপি ও জামায়াত ইসলামকে দূরে ঠেলে দেয়া হয়েছিলো। অভ্যুত্থানের আরেক বড় শক্তি সশস্ত্র বাহিনীকেও রাখা হয়েছিলো অন্ধকারে।
অন্তবর্তীকালীন সরকারের বিগত দিনে অভ্যুত্থানের মূল শক্তি ছাত্রদের মধ্যেও দেখা দেয় অনৈক্য। এর ফলে ফ্যাসিবাদ বিরোধী শিবিরে বাড়তে থাকে দূরত্ব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের পোস্টের পর সংক্ষুব্ধ অংশটি বর্তমানে কিছুটা স্বাভাবিক।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে ইসরাকের শপথ ইস্যুতে মাঠে অবস্থান নেয়া বিএনপি নেতাকর্মীদের কারনে পরিস্থিতি ভিন্নদিকে মোড় নেয়। দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবির কারণে অস্বস্তিতে পড়ে যায় অভ্যুত্থানের শক্তিগুলো। এরপর নির্বাচন ও বন্দর ইন্যুতে সেনাবাহিনী প্রধানের বক্তব্য সারাদেশে আস্থার সংকট তৈরি করেছিলো। গেল দুই দিন ধরে একটা সমঝোতায় আসার চেষ্টা চলে। সুত্রমতে, সেই ধারাবাহিকতায় যমুনায় এখন আর পদত্যাগের প্রস্তুতি নেই। নতুন করে উপদেষ্টা পরিষদ ঢেলে সাজানো হচ্ছে।
বাংলাদেশে জনসমর্থন ও সাংগঠনিক কাঠামোর বিস্তার ও কার্যকারিতার দিক থেকে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল এখন বিএনপি। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সময় এবং পরেও এই সরকারের প্রতি সরাসরি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন এবং এ সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না বলে পরিষ্কার করেছেন।
অন্যান্য রাজনৈতিক দলেরও সমর্থন পেয়ে এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার। নাগরিক সমাজের মধ্যেও গণ-অভ্যুত্থানে গঠিত এই সরকারের পক্ষে ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও আশা। কিন্তু কোন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিএনপি, নাগরিক সমাজের সঙ্গে এই সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের দূরত্ব তৈরি হলো, তা বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে।
সুত্রমতে, প্রধান উপদেষ্টা ড ইউনুস পদত্যাগ না করলেও অন্তত তিন থেকে চারজনকে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে বিদায় নিতে হবে, সমঝোতার আলোকে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে একটি অংশ এত দিন বিএনপির সাংঘর্ষিক অবস্থান না নেওয়ার সিদ্ধান্তকে ‘দুর্বলতা’ হিসেবে দেখেছিলেন। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের মনে রাখা উচিত, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একমাত্র বিএনপিরই দেশব্যপী আন্দোলন করার সাংগঠনিক শক্তি রয়েছে। এমনকি রাজধানী ঢাকাতেও বিএনপির জনসমর্থনের যে ভিত্তি ও রাজপথে সাংগঠনিক শক্তির যে সামর্থ্য, তাকে খাটো করে দেখা ভুল হবে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘পদত্যাগ ঘোষণা’র ইস্যু নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নিউইয়র্ক টাইমস। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গণমাধ্যমটি তাদের প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছে ‘নির্বাচন নিয়ে চাপের মুখে অধ্যাপক ইউনূসের পদত্যাগের হুমকি’।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে একটি আদর্শবাদী আন্দোলন যখন গত আগস্টে ক্রম কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটায়, সে সময় বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ গণতন্ত্রের আসন্ন পুনরুজ্জীবন উদযাপন করেছিলেন। এরপর ৯ মাস হতে চললেও অন্তর্বর্তী সরকার সবাইকে হতাশ করেছে, যারা দ্রুত নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। এখন দেশটির খ্যাতিমান নেতা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস হুমকি দিচ্ছেন যে যদি তাকে তার কাজ করতে দেওয়া না হয় এবং ধীরগতিতে দেশকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করার সুযোগ না দেওয়া হয়, তাহলে তিনি পদত্যাগ করবেন।
সেখানে আরও বলা হয়, আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত মুহাম্মদ ইউনূসকে সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সেরা সম্ভাবনা হিসেবে দেখা হচ্ছিল। তাকে যখন অন্তর্বর্তী সরকার পরিচালনার নেতৃত্বে আনা হয়, তখনো রাস্তাঘাটে রক্তপাত চলছিল। কিন্তু তার সহযোগীরা বলছেন, বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল ও সেনাবাহিনীর মধ্যে বিকাশমান ঐক্যের কারণে তিনি বাধাগ্রস্ত অনুভব করছেন। এই ঐক্য তার নীতিগুলোর সমালোচনা করছে এবং বলছে, তিনি নির্বাচনের পরিকল্পনায় অত্যন্ত ধীরগতিতে এগোচ্ছেন।
ড. ইউনূসের মনে হয়তো অসংখ্য হতাশা জমে আছে। কিন্তু সরকারপ্রধান হিসেবে সব ধরনের আবেগ, বিবেচনা ও সিদ্ধান্তের ঊর্ধ্বে থাকবে তার দায়িত্ববোধ। আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি তিনি বাংলাদেশকে ভালোবাসেন। সেক্ষেত্রে তার জন্য পদত্যাগ কোনো বিকল্প নয়, বরং নেতৃত্ব দিয়ে যাওয়াই একমাত্র পথ। পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত দেশকে দৃঢ়, কার্যকর ও সুচিন্তিতভাবে নেতৃত্ব দেওয়াই তার একমাত্র দায়িত্ব এবং পুরো জাতি এর জন্য তার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। তাকে অবশ্যই এক্ষেত্রে অটল থাকতে হবে এবং আমরা গণমাধ্যম হিসেবে আমাদের নৈতিকতার ভিত্তিতে তার পাশে থাকব। তবে নীতি-নৈতিকতা বিবেচনায় স্বাধীন গণমাধ্যমকে ভিন্নমত, বিকল্প ভাবনা ও বিশ্লেষণ তুলে ধরতে হয়, যেখানে অপ্রিয় সত্যও থাকবে।
ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে ড. ইউনূসের অবদানকে বিশ্ব কেবল স্বীকৃতি দেয়নি, অনুসরণও করেছে। ঋণকে তিনি কেবল ‘অধিকার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেননি, বরং প্রতিটি মানুষের মাঝে উদ্যোক্তা হওয়ার মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীলতার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলেছেন। সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার মূল আকাঙ্ক্ষা ও ‘তিন শূন্যে’র পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন বিশ্ব দরবারে তাকে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। কিন্তু এসবের কোনোকিছুই কিংবা বিশ্বব্যাপী তার সম্মান, অগণিত পুরস্কার, সম্মানসূচক একাধিক ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি, অন্তহীন প্রশংসা কখনোই তাকে সরকার পরিচালনার জন্য প্রস্তুত করেনি।
প্রকৃতপক্ষে অভ্যুত্থান পরবর্তী একটি সরকার পরিচালনা অত্যন্ত কঠিন কাজ। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে তা আরও কঠিন। উপরন্তু যখন গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পতনের পর শাসনব্যবস্থার প্রতিটি প্রতিষ্ঠান—সংসদ, বিচারব্যবস্থা, পুলিশ, আমলাতন্ত্র, গোয়েন্দা সংস্থা ইত্যাদি—ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, সেই পরিস্থিতিতে সরকার চালানো প্রায় অসম্ভব।