নিউজ ডেস্ক :::
সিএন্ডএফ এসোসিয়েশনের পর এবার শিপিং খাতের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএএ) পূর্বনির্ধারিত দ্বিবার্ষিক নির্বাচন বন্ধ করে সিলেকশনের মাধ্যমে ‘নিজেদের লোক’ বসাতে চাইছেন চট্টগ্রাম বিএনপির কয়েকজন নেতা। তাদের হুমকির মুখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত সংগঠনটি নির্বাচনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে নির্বাচনের ভেন্যু পরিবর্তন করতেও বাধ্য হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিএন্ডএফ এসোসিয়েশনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হবার উদাহরণ তৈরি করা এক বিএনপি নেতার অনুসারীরা এবার নতুন মিশনে নেমেছেন। এই বিষয়ে আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ভাই আমিন হুমায়ুনের বাসায় দফায় দফায় বৈঠক হয় বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সুত্র।
সুত্রমতে , যে তিন বিএনপি নেতার নেতৃত্বে এমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাদের একজন বিএনপি নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ভাই আমীর হুমায়ূন মাহমুদ চৌধুরী। বেশ কয়েকজন শিপিং ব্যবসায়ীকে তার বাসায় ডেকে নিয়ে পক্ষ ত্যাগের জন্য ‘চাপ’ দিচ্ছেন— এমন অভিযোগও উঠেছে। জানা গেছে, গত এক মাসে এ ধরনের বেশ কয়েক দফা ‘বৈঠক’ হয়েছে আমীর হুমায়ূনের বাসায়।অপর দুজন হলেন চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক এস এম সাইফুল আলম এবং সদস্য মশিউল আলম স্বপন। এর মধ্যে স্বপন ছাড়া বাকি দুজনের শিপিং সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যবসাই নেই। তারা সংগঠনটির সদস্যও নন। বিএনপি নেতা সাইফুল এর আগে চিটাগং কাস্টম ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনেও একই কায়দায় তিনি ও তার লোকজন মিলে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ সব ক’টি পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হয়ে যান। নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ছাড়া কাউকেই মনোনয়ন ফরম কিনতে দেওয়া হয়নি। কিনতে গেলে অনেককে মারধরও করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএএ) এর অফিসে গিয়ে শিপিং ব্যবসার সঙ্গে দূরতম সম্পর্ক নেই—এমন ‘বিএনপি ক্যাডার’রা গিয়ে নির্বাচন কমিশন ও শিপিং ব্যবসায়ীদের হুমকি দিচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট মতে, শিপিং ব্যবসার সাথে জড়িত ব্যবসায়ীরা হুমকি মুখে এক প্রকার ধরাশায়ী। ৪৭ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত শিপিং খাতের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনটি অতীতে কখনও এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি।
দেশের শীর্ষস্থানীয় শিপিং ব্যবসায়ীরা সংগঠনটির সদস্য। ২৪ সদস্যবিশিষ্ট পরিচালনা পর্ষদের ২০২৫-২০২৭ মেয়াদের নির্বাচন আগামী ১৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এতে ভোট দেবেন ২২৬ জন ভোটার। সদস্যরা ২৪ জন পরিচালক নির্বাচন করার পর সেখান থেকে পরিচালকরা মিলে একজন চেয়ারম্যান, দুজন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও দুজন ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন। অন্যরা সংগঠনটির পরিচালক হিসেবে থাকেন।
জানা গেছে, মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ৯ মার্চ পর্যন্ত সাধারণ ক্যাটাগরিতে ১৬ পরিচালক পদের জন্য ২৮ জন এবং সহযোগী ক্যাটাগরিতে ৮ পরিচালক পদের জন্য ১৭ জন মনোনয়নপত্র জমা দেন। দুজন প্রার্থী উভয় ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন জমা দেওয়ায় মোট মনোনীত প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৩ জনে। এর মধ্যে ৩৬ জনই বলেছেন, তারা নির্বাচন ছাড়া অগণতান্ত্রিক পন্থায় নেতৃত্বের পরিবর্তন চান না। গত ২৭ মার্চ চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশিত হয়।
এর আগে গত ৫ মার্চ চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদ এলাকার কিছু বিএনপি-যুবদল নেতাকর্মী শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের অফিসে ঢুকে নির্বাচন বন্ধ করার জন্য হুমকি দিয়ে আসে। এদের সকলেই বিএনপি নেতা সাইফুল ও ডবলমুরিং থানা বিএনপি নেতা সালাউদ্দিনের অনুসারী ‘ক্যাডার’ হিসেবে পরিচিত। রোববারও (৬ এপ্রিল) বিএনপি ক্যাডাররা অ্যাসোসিয়েশন অফিসের সামনে ব্যানার টাঙ্গিয়ে বর্তমান বোর্ডের চেয়ারম্যান সৈয়দ এম আরিফসহ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে ‘স্বৈরাচারের দোসর’ ট্যাগ দিয়েছে নির্বাচন বন্ধ করার চেষ্টা চালায়। হুমকির মুখে এরই মধ্যে নির্বাচনের ভেন্যু হোটেল আগ্রাবাদ থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে নির্বাচন কমিশন।
জানা গেছে, সংগঠনটির ৯৫ ভাগেরও বেশি সদস্য অবাধ নির্বাচনে যে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপের বিরোধী। শিপিং ব্যবসায়ীরা বলছেন, নির্বাচিত কমিটিকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের ‘পছন্দের লোক’ বসিয়ে অনির্বাচিত কমিটি গঠনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, শিপিং এজেন্টদের ভেন্ডর নিয়োগ ও বিভিন্ন কাজ বাগিয়ে নেওয়ার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখা।
জানা গেছে, বিএনপি নেতার সাইফুলের নেতৃত্বে বহিরাগতরা ইতোমধ্যে একটি ‘ছায়া কমিটি’ গঠন করেছে। এজন্য তারা বিএনপির ‘স্থায়ী কমিটি’র সদস্য ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমির খসরু মাহমুদের ভাই আমির হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরীর বাসভবনে অন্তত আট দফা বৈঠকও করে। সেই বৈঠকের কিছু ছবিও এসেছে প্রতিবেদকের হাতে । তাতে নতুন ‘চেয়ারম্যান’ হিসেবে ক্রাউন ন্যাভিগেশন কোম্পানি লিমিটেডের সাবেক পরিচালক শাহেদ সারোয়ারকে মনোনীত করা হয়। বর্তমান কমিটির কয়েকজন কর্মকর্তাকে নিজেদের পক্ষে টানতে বিএনপি সমর্থক ব্যবসায়ী আমির হুমায়ুনের বাসায় নিয়ে ‘চাপ’ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ মিলেছে।
আকস্মিক এমন পরিস্থিতিতে ১৯ মার্চ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালনা পর্ষদ এবং স্থায়ী কমিটির সদস্যরা এক জরুরি সভায় বসেন। ওই সভায় ২৪ জন পরিচালকের মধ্যে ২২ জন এবং ১১ জন স্থায়ী কমিটির সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
সভায় শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ এম আরিফ বলেন, ‘একজন সম্মানিত ব্যক্তি তাকে পরামর্শ দিয়েছেন নির্বাচনের বদলে পরিচালকদের মনোনয়নের মাধ্যমে কমিটি গঠন করার জন্য।’ তিনি এ বিষয়ে উপস্থিত সদস্যদের মতামত জানতে চান।
সৈয়দ এম আরিফ বলেন, ‘সভায় উপস্থিত সকল পরিচালক ও স্থায়ী কমিটির সদস্যরা সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচনী সময়সূচি অনুযায়ী সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে মতামত তুলে ধরেন। তাদের সকলেই মনোনয়নের মাধ্যমে কমিটি গঠনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। আমরা দেখেছি, নির্বাচন করতে ইচ্ছুক ৪৩ জন প্রার্থীর মধ্যে ৩৩ জনই নির্বাচনের পক্ষে।’
সৈয়দ আরিফ বলেন, ‘কেউ কেউ হয়তো চাইছেন না ইলেকশন হোক। কিন্তু আমাদের ৯৫ ভাগেরও বেশি সদস্য অবাধ নির্বাচনে যে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপের বিরোধী। অতীতেও গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের কমিটি হয়েছে। এবারও গণতান্ত্রিকভাবেই সবকিছু হবে। নির্বাচন কর্মকর্তারাও সেভাবেই এগোচ্ছেন।’
শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি শফিকুল আলম জুয়েল বলেন, ‘এ ধরনের বহিরাগত হস্তক্ষেপ নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে এবং আন্তর্জাতিক শিপিং ব্যবসায় দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে।’
নির্বাচন বানচালের চেষ্টার অভিযোগ প্রসঙ্গে আমীর হুমায়ূন মাহমুদ চৌধুরী শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশনের কিছু সদস্য তার কাছে এসেছিলেন— এমন কথা উল্লেখ করে একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘তাদের আমি ডাকিনি। তারাই আমার কাছে আসছে। তাদের অভিযোগ, সেখানে স্বৈরাচারের দোসররা রয়েছে। আমি বলছি, তারা যদি আলোচনায় বসতে চায়, আমি কিছু করার চেষ্টা করবো। এখন তারা যেহেতু আসেনি, সেখানে আমার কিছু করার নেই।’
এর আগে একটি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রস্তাবিত কমিটি গঠন এবং নির্বাচন ছাড়াই কমিটি গঠনের চাপ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে আমীর হুমায়ূন মাহমুদ বলেন, ‘আমি মনে করি, আগের কমিটি পরিচালনায় জড়িত ছয় থেকে সাতজন খারাপ লোক আছেন, যাদের যেকোনোভাবে—প্রয়োজনে জোর করে হলেও—বহিষ্কার করা প্রয়োজন।’
বিভিন্ন অভিযোগ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সদস্য মশিউল আলম স্বপন বলেন, ‘আমরা কোনো জোর করছি না। নির্বাচন বন্ধ নয়, পিছিয়ে দিতে বলেছি। কারণ ভোটার লিস্টে কারেকশনের প্রয়োজন আছে। বর্তমান কমিটিতে যারা আছে, তারা স্বৈরাচারের দোসর। তারা শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে।’
শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশনের অফিসে গিয়ে যারা হুমকি দিয়ে এসেছে এবং ব্যানার নিয়ে যারা ‘আন্দোলন’ করছে— তাদের প্রায় সবাই বহিরাগত এবং স্থানীয়ভাবে ক্যাডার হিসেবে পরিচিত। এ প্রসঙ্গে মশিউল আলম স্বপন বলেন, ‘সেখানে সাধারণ ব্যবসায়ীরা গিয়েছিল। বৈষম্যের শিকার হয়েছে এমন লোকজনও গিয়েছিল। তারা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলতে সেখানে যায়।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক এস এম সাইফুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেন নি। জানা যায়, ওমরা হজ পালন করতে বর্তমানে তিনি সৌদি আরবে অবস্থান করছেন।
শিপিং খাতের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশি-বিদেশি জাহাজের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করা এজেন্টদের সংগঠনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের শিপিং ব্যবসার ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হবে এবং খাতটিতে ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।