সানাউল্লাহ রেজা শাদঃ
পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলাধীন ধানীসাফা ইউনিয়নের নিভৃত পল্লী উদয়তারা বুড়িরচর গ্রামের মুসলিম ঐতিহ্য ও ইতিহাসের শত বছরের পুরনো কাঠের তৈরি মমিন মসজিদ। এ মসজিদটি কাঠ দিয়ে তৈরি হওয়ায় স্থানীয়ভাবে কাঠের মসজিদ নামে পরিচিতি লাভ করে। শত বছর পেরিয়েও মসজিদটি টিকে আছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নিদর্শন হয়ে।
কাঠের মসজিদটি বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম মসজিদের ২৩ তম স্থান দখল করে আছে। কাঠের ওপর আরবি ক্যালিগ্রাফির অপূর্ব সৌন্দর্যের এ মসজিদের পুরোটা জুড়ে আছে বাহারি নকশা ও নান্দনিক কারুকাজ।
ব্রিটিশ ভারতে মুসলিম জাতির ইতিহাস সংরক্ষণ ও ধর্মীয় চেতনা থেকে কাশ্মীরে নির্মিত একটি কাঠের মসজিদের আদলে নিজের নকশায় মসজিদটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন মৌলভি মমিন উদ্দিন আকন । আসাম, ত্রিপুরা ও কাশ্মীর থেকে শাল, সেগুন আর লোহা কাঠ সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন তিনি। কাঠে লোহার প্যারেকের বদলে ব্যবহার করা হয়েছে কাঠের শলাকা।
এ মমিন মসজিদের দৈর্ঘ্য ২৪ ফুট আর প্রস্ত ১৮ ফুট। মসজিদটির ভেতরে আলো-বাতাস ঢোকার এবং সৌন্দর্য সৃষ্টির লক্ষ্যে পাটাতনের মাঝখানে তৈরি করা হয়েছে আরেকটি দোচালা টিনের ছাউনি। মসজিদে উত্তর আর দক্ষিণে দুটো করে জানালা এবং পূর্ব-পশ্চিমে চারটি করে জানালা রয়েছে। পূর্বদিকে একমাত্র প্রবেশদ্বারে কারুকার্যখচিত দুটি খাম্বাবিশিষ্ট দরজা রয়েছে।
মসজিদের প্রধান মিস্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয় পিরোজপুরের স্বরূপকাঠী এলাকার দৈহারী ইউনিয়নের শ্রী হর কুমারকে। তার নেতৃত্বে ২২ জন মিস্ত্রী ১৯১৩ সালে মসজিদ তৈরি করা শুরু করে দীর্ঘ ৭ বছরের কর্মযজ্ঞ শেষ হয় ১৯২০ সালে।
মসজিদটিকে ২০০৩ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
ইউনেস্কো প্রকাশিত বিশ্বের অন্যতম মসজিদ নিয়ে প্রকাশিত ৪০০ পৃষ্ঠার একটি বইয়ে এ কাঠ মসজিদটি সচিত্র বর্ণনায় স্থান পেয়েছে। গোটা বরিশাল বিভাগের একমাত্র মঠবাড়িয়ার মমিন মসজিদটির আলোকচিত্র ২০১৪ সাল থেকে জাতীয় জাদুঘরের ১৯নং স্থাপত্য গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে।
তবে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মসজিদটির কারুকাজ ও রঙয়ের ক্ষতি হয়েছে বিগত দুই দশকে।
প্রতিদিন দূর দূরান্ত থেকে পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত থাকে মুসলিম ইতিহাস ঐতিহ্যের এই কাঠের মসজিদ। তবে বিশ্রামের জন্য ভালো ব্যাবস্থা না থাকায় বিভ্রান্তে পড়তে হয় পর্যটকদের।
স্থানীয়দের দাবি একটি বিশ্রামাগার, নারীদের নামাজের জন্য আলাদা স্থান ,বাথরুম ও যোগাযোগের একমাত্র রাস্তাটির সংস্কার জরুরী ভিত্তিতে দরকার।
শতবর্ষী এই কাঠের মসজিদ দেখতে আসা একদল পর্যটকদের সাথে কথা বললে তারা বলেন, এই কাঠের মসজিদটির নান্দনিক কারুকাজ আমাদের মুগ্ধ করছে । কোন ধরনের লোহার ব্যাবহার ছাড়াই স্থাপনাটি এতো বছর টিকে আছে যা আমাদের মুসলিম ইতিহাসের বাহক হয়ে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে মুসলিম ইতিহাসের সাথে । দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী পুরাকির্তীর নিদর্শন মঠবাড়িয়ার এই “মমিন” মসজিদের সংস্কার ও সংরক্ষণে সরকারের যথাযথ নজরদারি ও বিশ্রামাগারের দাবি জানান তারা।
মৌলভি মমিন উদ্দিন আকনের নাতি মো. আবুল কালাম আজাদ জানান, পুরো নির্মাণ প্রক্রিয়া উপস্থিত থেকে তত্ত্বাবধান করেছিলেন মমিন উদ্দিন। মসজিদটি নির্মাণে তৎকালীন সময়ের ১৫-২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল ।
তিনি আরো বলেন, মুসলিম ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সাক্ষী আমাদের এই মমিন মসজিদ। কাশ্মিরের মসজিদটি ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ায় এটি এখন দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র কাঠের তৈরি মসজিদ।
২০০৮ ও ২০২১ সালে খুলনা জাদুঘরের আওতায় মসজিদটির কিছু সংস্কার করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “মসজিদটিকে এর মধ্যে দুবার সংস্কার করা হয়েছে তবে তা যথেষ্ট নয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টিকিয়ে রাখতে গেলে মসজিদটির কাঠামো ঠিক রেখে এর উপর থেকে একটি ছাদ দেওয়া উচিত।এতে করে মসজিদটির কাঠগুলো সুন্দর থাকবে এবং ঝড় বৃষ্টিতেও নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাও থাকবে না। তাছাড়া বাইরে ছাদ থাকলে বৃষ্টিতে বা গরমে নামাজ পড়তে কোনো সমস্যা হবে না।
পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশরাফুল আলম খান বলেন, দৃষ্টি নন্দন মমিন মসজিদ আমাদের জাতীয় সম্পদ মসজিদটির সার্বিক উন্নয়নে আমরা চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাছে মসজিদটি দ্রুত সংস্কারের পাশাপাশি এটি সুরক্ষার জন্য চিঠি প্রেরণ করা হয়েছে।
এছাড়াও মসজিদের সার্বিক উন্নয়ন ও ইতিহাস ঐতিহ্য কীভাবে সংরক্ষণ করা যায় তার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে দ্রুততার সঙ্গে পদক্ষেপের আশ্বাস দেন তিনি ।