মোহাম্মদ মোশাররাফ হোছাইন খান: স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার পরিকল্পনা, স্বাস্থ্য সেবা এই দুই বিভাগ নিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। মেডিক্যাল কলেজ ও সহযোগী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুপুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক কর্মকাণ্ড স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের অধীনে নিয়ন্ত্রিত হয়। হাসপাতাল ও হাসপাতাল সংক্রান্ত সকল কর্মকাণ্ড স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অধীনে নিয়ন্ত্রিত হয়। স্বাস্থ্য খাতে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৫ অর্থ বছরের বাজেট ছিল প্রায় ২লাখ ৮২ হাজার ১৩৭ কোট টাকা। বাজেট বাস্তবায়নের পরিমাণ ছিল প্রায় ৮৬ শতাংশ বলে জানা যায়। এ হিসাবে গত সাড়ে পনেরো বছরে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বাস্তবায়নের পরিমাণ ছিল প্রায় ২ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন গবেষণা সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে, স্বাস্থ্য খাতে গড় দুর্নীতির পরিমাণ ৩০ শতাংশের উপরে।
সর্বসাকল্যে ৩০ শতাংশ হিসাবে হিসাব ধরা হলে স্বাস্থ্য খাতে বিগত পনেরো অর্থ বছরে দুর্নীতির পরিমাণ হয় প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা।গত পনেরো অর্থ বছরের দুর্নীতির এ টাকায় বিশ্বের সর্বাধুনিক মানের সুবিধা সম্বলিত কমপক্ষে ৭৫০ শয্যার ৪৭টি সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল তৈরি করা সম্ভব হতো। ইন্ডিয়ার হাসপাতাল প্রকল্পের হিসাবে ৮১টি সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল করা সম্ভব হতো।
দুর্নীতি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। তবে বিশ্বে সব দেশেই স্বাস্থ্যখাতকে গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। এ খাতের উন্নতির উপর নির্ভর করে দেশের অর্থ, শিক্ষা, কৃষি, শিল্পসহ সর্বস্তরের উন্নতি। বাস্তবে স্বাস্থ্য খাত আস্থা ও অস্তিত্ব সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীন হয়ে বছরে কয়েক লাখ রোগীকে অসংক্রামক রোগের উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারত, সিংগাপুর, থাইল্যান্ডসহ ১৯ টি দেশে যেতে হয়েছে। এতে দেশ থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে গত পনেরো বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার পরিকল্পনা, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের প্রকাশিত প্রতিবেদন সমূহে দেশের স্বাস্থ্য খাতের বানোয়াট প্রভূত উন্নতির চিত্র, শেখ মুজিব স্বপ্ন-দর্শন, হাসিনার ভিশন, মিশন রূপকল্পের প্রতারণা তুলে ধরা ছিল মূল কর্মসূচি।
এইচআরএস ডাটাসিট পর্যালোচনা করলে সুস্পষ্টভাবে উঠে আসে দেশের স্বাস্থ্য খাতের দুর্দশা চিত্র। এছাড়া ২০১৯ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির এগারোটি উৎস চিহ্নিত করে এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে ২৫টি সুপারিশ পেশ করে। এ শুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করাতো দূরের কথা বরং বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালীন সময়ে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মানুষ যখন গৃহাবদ্ধ সে সময় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে হাসিনা, পুতুল, জাহিদ মালেকের ঘনিষ্ঠজনরা মেতে ছিল শত শত কোটি টাকা দুর্নীতির মহোৎসবে। দৈনিক নওরোজ স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক বিষয়ে অনুসন্ধান কাজ পরিচালনা করছে। ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে পরিচালিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে তুলে ধরা হবে গত সাড়ে পনেরো বছরের স্বাস্থ্য খাতের বাস্তব চিত্র। খাত ভিত্তিক কারা কীভাবে দুর্নীতিতে জড়িত ছিল, কীভাবে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির টাকা পাচার হয়েছে। দুর্নীতির সাথে জড়িত কে , কোথায় বর্তমানে দায়িত্বরত রয়েছে।
বিগত সাড়ে পনেরো বছর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের সর্বস্তরে শেখ মুজিবের স্বপ্ন-দর্শনের নামে চলছে দুর্নীতি ও লুটপাটের মহোৎসব। দুর্নীতির এই মহোৎসবকে দপ্তর সমূহের বার্ষিক প্রতিবেদন ও আওয়ামী লীগ মদদপুষ্ট মিডিয়ার মাধ্যমে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয়েছে দেশ ব্যাপী। বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আওয়ামী শাসনের এই সময়ে দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি শিল্পখাতসহ সর্বস্তরে শেখ হাসিনা নিজে এবং নিজ পরিবারের সদস্যরা ও তাদের সহযোগীরা দেশের সকল উন্নয়ন প্রকল্প থেকে নির্বিঘ্নে নির্ধারিত অঙ্কের কমিশন বাণিজ্য ও লুটপাটে লিপ্ত ছিল। প্রতি বছর কমিশন বাণিজ্য ও লুটপাটের বিপুল অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচার করে একটি তলা বিহীন ঝুড়িতে পরিণত করে বাংলাদেশকে। ব্যাপক কমিশন বাণিজ্য, দুর্নীতি, লুটপাট থেকে রেহাই পায় নি মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদার স্বাস্থ্য খাত। কমিশন বাণিজ্য, অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাটের ভয়াল থাবায় আস্থা এবং অস্তিত্বের সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে পুরো স্বাস্থ্য-চিকিৎলা খাত।
দেশের চিকিৎসা সেবার প্রতি আস্থাহীন হয়ে অসংক্রামক কমপক্ষে ১২ টি রোগের চিকিৎসার জন্য বছরে কয়েক লাখ রোগীকে ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ ১৯ টি দেশে যেতে হয়েছে এবং হচ্ছে। বাংলাদেশি রোগীদের চাপ সামাল দিতে ইন্ডিয়া বাংলাদেশি রোগীদের জন্য যাতায়াত সুবিধাজনক রাজ্যে নতুন করে অত্যাধুনিক মানের কয়েকটি হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে।
নতুন করে তৈরি হওয়া ইন্ডিয়ান হাসপাতাল সমূহের বাংলাদেশের সরকারি, বেসরকারি অফিস, ব্যাংক বীমা, কর্পোরেট অফিস সমূহে অবাধ ব্রান্ডিং এর সুযোগ করে দিয়েছে হাসিনার প্রশাসন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ. মনসুরের দেয়া তথ্য মতে, “বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার বা ৬০ হাজার কোটি টাকা এ খাতে পাচার হয়েছে। এ খরচের বড় অংশ অনানুষ্ঠানিকভাবে (ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে বা অবৈধভাবে) হয়। যার কারণে দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বা বৈদেশিক লেনদেনের ওপর উপর যথেষ্ট চাপ তৈরি হয়”।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশ ব্যাপী ভারতীয় হাসপাতাল গুলোর কয়েক হাজার এজেন্ট নিয়োজিত ছিল এবং আছে, যাদের কাজ হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে রোগী পাঠানো এবং চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীদের চিকিৎসা খরচের টাকা নিরাপদে পাচার করে দেয়া।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, বিদেশে চিকিৎসা নিতে গিয়ে অসংখ্য মধ্যবিত্ত পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে। এ সকল পরিবার সমূহ সামাজিক ও আত্ম মর্যাদার কারণে কারো কাছে সাহায্য চাইতে পারছে না আবার চিকিৎসা খরচ যোগাতেও পারছে না। আবার অনেকে রুটিন চেকআপ করাতে বার বার বিদেশে গিয়ে বিশাল অঙ্কের ঋণের দায়ে জর্জরিত হচ্ছে ।
এতেও অগণিত সংখ্যক পরিবার ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হচ্ছে।গত সাড়ে পনেরো বছরের পনেরো অর্থ বছরে বাজেটে জাতীয় বাজেটের প্রায় প্রায় ৫ শতাংশ বাজেট বরাদ্দ ছিল স্বাস্থ্য খাতে। গত ১৫ বছরের জাতীয় বাজেট ও স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে জানা যায়, শেখ হাসিনার শাসনের সাড়ে পনেরো বছরে পনেরো অর্থ বছরে বাংলাদেশের মোট জাতীয় বাজেট ছিল ৫৬ লাখ ৪২ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা। স্বাস্থ্য খাতের বাজেটের হিসাবানুসারে এই সময়ে স্বাস্থ্য খাতে ১৫ অর্থ বছরে বাজেট ছিল ২ লাখ ৮২ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন ও সিএজির কয়েকটি অডিট প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে জানা যায়, ১৫ বছরে বাস্তবায়িত বাজেটের পরিমাণ ৬৮ থেকে ৯৮ শতাংশ।
গড় পরিমাণ ৮৬ শতাংশ। এ হিসাবে বাস্তবায়নকৃত বাজেটের পরিমাণ প্রায় ২ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা। এতে বছরে গড়ে ১৬ হাজার ২০০কোটি টাকা স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করা হয়েছে। নাগরিক প্রতি বছরে প্রায় ১০৪১ ব্যয় করা হয়েছে । পনেরো বছরে নাগরিক প্রতি মোট ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ১৫৬১৫ টাকা। স্বাস্থ্য খাতে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সৈয়দ আব্দুল হামিদের গবেষণা ও সিএজির কয়েক বছরের অডিট আপত্তি পর্যালোচনা করে জানা যায়, স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির হার ৩০ শতাংশের উপরে। তবে স্বাস্থ্য খাতে সর্বসাকল্যে দুর্নীতির পরিমাণ ৩০ শতাংশ হারে হিসাব ধরা হলে ১৫ বছরে দুর্নীতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা। দুর্নীতির এই টাকায় সাতশত পঞ্চাশ শয্যার ৪৭ টি সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল নির্মাণ করা সম্ভব হতো।( যদিও এ প্রকল্পে পুকুর চুরির অভিযোগ রয়েছে) ৩০ এই সময়ে ভারতের দিল্লিতে রোবোটিক সার্জারি ৩০ টি সুবিধাসহ ৭৫০ শয্যার সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল তৈরি করতে খরচ হয়েছে ৬০০ কোট রুপি বা ৯০০ কোটি টাকা। এ হিসাবে দেখা যায়, ভারতে অধিকাংশ বিশেষায়িত বা বিশেষ বিশেয়াতি হাসপাতালে শয্যা প্রতি নির্মাণ ব্যয় হয়েছে ১কোটি ২০লাখ টাকা আর বাংলাদেশে ব্যয় হয়েছে ২ কোটি টাকারও বেশী। গত পনেরো বছর স্বাস্থ্য খাতে নাগরিক প্রতি মাথাপিছু গড় দুর্নীতি ছিল প্রায় ৩১২ টাকা
শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশের স্বাস্থ্য খাতে সর্বস্তরে লুটপাট ছিল ওপেন সিক্রেটন একটি বিষয়। মেডিক্যাল কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল, বিশেষায়িত, সেকেন্ডারি, প্রাইমারি হাসপাতালর ,কমিউনিটি ক্লিনিকসহ সর্বস্তরে ছিল অনিয়ম দুর্নীতি, লুটপাটের স্বর্গরাজ্য।বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন-আদর্শ বাস্তবায়নের নামে সর্বস্তরে চলে দুর্নীতির প্রতিযোগিতা। হাসিনা, পুতুলের আজ্ঞাবহ মন্ত্রী, সংসদীয় কমিটির সভাপতি, কমিটির সদস্য, স্বাস্থ্য খাতের দপ্তর, পরিদপ্তর সমূহের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও ঠিকাদাররা প্রচলিত আইন কানুন, পিপিআর প্রভৃতির কোন কিছুতে তোয়াক্কা করে নি স্বাস্থ্য খাতে পনেরো বছর হাসিনাটিকে থাকা এই মাফিয়া চক্রটি। এমন চিত্রই উঠে এসেছে ২০১০ সাল থেকে করা বাংলাদেশের কম্পট্রোলার জেনারেল এন্ড অডিটের করা বিভিন্ন অডিট প্রতিবেদনেস্বাস্থ্য খাতের মিশন হচ্ছে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে সবার জন্য সুলভে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে একটি সুস্থ সবল জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা। আর ভিশন হচ্ছে সকলের জন্য সাশ্রয়ী ও মানসম্মত চিকিৎসা সেবা। একটি সবল সুস্থ জাতী গড়ে তুলতে সাশ্রয়ী ও মান সম্পন্ন চিকিৎসা ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। সুস্বাস্থ্য প্রতিটি নাগরিকের মানবিক মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব নাগরিকদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। পুষ্টি একটি শিশুর জন্মগত অধিকার। সুস্থ্য-সবল নাগরিকই রাষ্ট্র বা জাতির মূল চালিকা শক্তি। নাগরিকদের সুস্থতা অসুস্থতার উপর ভিত্তি করে অর্থনীতি, শিক্ষা, কৃষি ,শিল্পসহ সব কিছু যথার্থ পরিচালিত হয়। গত সাড়ে পনেরো বছর দেশের স্বাস্থ্য খাতে ছিল এই মিশন, ভিশন, রূপকল্প স্বপ্ন, দর্শনের তোষামোদি। তোষামোদকারী গণমাধ্যমের কল্যাণে এ মিশন, ভিশন,স্বপ্ন, দর্শন ও ডিজিটাইজেশনের নামে মজিব-হাসিনার বন্ধনা প্রচারিত হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি সব অফিসসহ পুরো দেশ ব্যাপী। সর্বত্র প্রচারিত মজিব-হাসিনার স্বপ্ন, দর্শন, মিশন, ভিশন, রূপকল্প ও ডিজিটাইলশন যা কাজীর গরু কাগজে কলমে থাকার মতো।
শেখ হাসিনার গত সাড়ে পনেরো বছরের শাসনামলে ডা আ. ফ. ম রূহুল হক, বেগম রওশন এরশাদ, মোহাম্মদ নাসিম, জাহিদ মালিক,সামন্ত লাল মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় ,২০১৯ সালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মো. নাসিম বৈশ্বিক মহামারি করোনায় মারা যাওয়া পর্যন্ত কৌশলগত কারণে শেখ পরিবারের পক্ষে স্বাস্থ্য খাতের মালিকানায় ছিল শেখ হাসিনা নিজে। এ সময় তার সহযোগিতায় ছিল মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। শেখ হাসিনা ২০০৯ সাল থেকে টানা দশ বছর মেয়েকে সাথে রেখে নিজের মতো করে গড়ে তোলেন। জাহিদ মালিক মন্ত্রী হওয়ার পর এর মালিকানা দেয়া হয় সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে।উত্তরাধিকার সূত্রে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলই ছিলেন এ মন্ত্রণালয়ের পর্দার অন্তরালে একচ্ছত্র মালিক। পুতলের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে কোন প্রকল্প বা কর্মসূচি গ্রহণের ক্ষমতা কারো ছিল না বলে স্বাস্থ্য খাতের একাধিক সূত্রে জানা যায়। নির্দেশনায় পুতুল দেখভাল করতেন শেখ হাসনিা। এ খাত থেকে অনুসন্ধানে জানা যায়, তথাকথিত অটিজম বিশেষজ্ঞ সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের স্বাস্থ্য খাতের কমিশনের হিসাব ছিল বাস্তবায়িত বাজেট ভিত্তিক।মোট বাজেটের হিসাব অনুসারে তার কমিশন বুঝিয়ে দেওয়া হতো। এখাত থেকে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের অর্জিত দুর্নীতির টাকা তার মা শেখ হাসিনার দায়িত্বে তার বিশ্বস্ত কয়েকজনের মাধ্যমে পাচারের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন বলেও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শেখ মুজিবের বেচে থাকা দুই কন্যা হাসিনা ও রেহানা একই বাসায় বসবাস করলেও তাদের মধ্যে আন্ত ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকতা ছিল বলে জানা যায়। শেখ হাসিনার হাতে দল এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থাকলেও সর্ব বিষয়ে একক কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা শেখ হাসিনার ছিল না। গত পনেরো বছরে ৪ টি সংসদ নির্বাচন ও অন্যান্য নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নে শেখ হাসিনার একক কোন ক্ষমতা ছিল না। এক্ষেত্রে শেখ রেহানারও শক্ত অবস্থান ছিল। মন্ত্রণালয় বন্টনেও শেখ রেহানার শক্তিশালী লবিং ছিল। সংসদ সদস্য মনোনয়ন, মন্ত্রী,প্রতিমন্ত্রী চূড়ান্ত করন, উপজেলা চেয়ারম্যান এমন কি ইউপি চেয়ারম্যানের প্রার্থীতা চূড়ান্ত করতে শেখ রেহানার চাঁদাবাজির বিষয়টি ওপেন সিক্রেট।
এ সময়ে শেখ রেহানা এসব করে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। তবে সব কিছুতে সে ছিল পর্দার অন্তরালে। মেগা প্রকল্প বোনিজ্যের ক্ষেত্রে হসিনা-রেহানার ছিল সমান সমান অংশীদার। হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এ সকল মেগা প্রকল্পের দুর্নীতির দুই বোনের সন্তানরা সম অংশীদার হয়। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, শেখ রেহানার ভাগে থাকা মেগা প্রকল্প সমূহের লেনদেন বেশিরভাগ হয়েছে তার মেয়ে রেজওয়ানা ছিদ্দিক টিউলিপের মধ্যস্থতায়। টিউলিপের পরিচালনায় লন্ডনে তার কয়েকটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ছিল এরমধ্যে গুড চেঞ্জ থিয়েটার উল্লেখযোগ্য। বড় বড় সব ডিল এই গুড চেঞ্জ থিয়েটারেই হতো।
এ ছাড়া এই থিয়েটারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিরোধীদের দমন পীড়নের বিভিন্ন কর্মসূচি সেখান থেকে গৃহীত হতো বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। শেখ হাসিনার অংশের লুটপাটের বড় বড় ডিলগুলো জয়ের আমেরিকার ভার্জিনিয়া ও ফ্লোরিডায় থাকা তার কার্যালয়ে সংঘটিত হতো বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। তবে পারিবারিক বিশ্বস্ততা ও ব্রিটেনের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে লন্ডনে টিউলিপের পরিচালনায় থাকা প্রতিষ্ঠান সমূহেও হাসিনার অনেক ডিল সম্পাদিত হতো বলে জানা যায়। এরপর কথিত আইটি বিশেষজ্ঞ সজীব ওয়াজেদ জয়ের হস্তগত হতো।
এ সব দিক থেকে পুতুর ছিল নিরাপদ। পুতুল তার মায়ের সার্বক্ষণিক সহযোগী হিসেবে থাকায় পুতুলের কর্মকাণ্ড ও উপার্জন নিয়ে তার খালা শেখ রেহানা এবং ভাই সজীব ওয়াজেদ জয় কখনো মাথা ঘামাননি। এছাড়া পুতুলের বিষয়ে শেখ হাসিনা খুব সচেতন ছিল।
ইতোমধ্যে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ‘বিশ্বাসযোগ্য’ অভিযোগের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া দেশের জন্য মর্যাদাহানিকর বলেও মন্তব্য করেছে দুদক। দুদক সূত্রে জানা যায়, পুতুলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বেশ কয়েকটি অভিযোগ রয়েছে এবং তারা এসব অভিযোগ অনুসন্ধান করছে। জানা যায়, পুতুলকে ডব্লিউএইচও-এর দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে মনোনীত করার সময় রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার এবং নিয়মবহির্ভূত কার্যকলাপেরও অভিযোগ পাওয়া গেছে।এর মধ্যে অন্যতম অভিযোগ, পুতুলের যথাযথ যোগ্যতা না থাকলেও বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সফরে সফরসঙ্গী করা হয়েছে। দুদকের অনুসন্ধান সূত্রে জানা গেছে, ডব্লিউএইচও-তে আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে তাকে মনোনীত করার সময় কানাডার পাসপোর্টধারী নাগরিক ছিলেন।
এছাড়া, দুদক সূত্রে জানা যায়, পুতুল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঢাকার পূর্বাচল নতুন শহর আবাসিক প্রকল্পের কূটনৈতিক জোনে ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন এবং এর জন্য তার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া, পুতুল ‘সূচনা ফাউন্ডেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে বিভিন্ন সামাজিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে ‘জোর করে উপঢৌকন আদায় ও অর্থ আত্মসাৎ’ করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। দুদকের অনুসন্ধানে সূচনা ফাউন্ডেশনের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পায় নি।দেশের স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম উদ্ঘাটনে দুদকের ২৫ টি টিম ২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত টানা দুই বছর অনুসন্ধান চালায়। এতে তারা দুর্নীতির ৮ টি উৎস খুঁজে বের করে। দুর্নীতি প্রতিরোধে ২৫ টি সুপারিশও পেশ করে। এছাড়া গত কয়েক বছর বাংলাদেশের কম্পট্রলার এন্ড অডিটর জেনারেল এর স্বাস্থ্য বিষয়ক অডিটে কোটি কোটি টাকারও অনিয়ম উদ্ঘাটন করে।
এই অনিয়মের কারনগুলোও তারা চিহ্নিত করেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-পিপিআরসহ সরকারি বিধি-বিধান যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, সরকারি অর্থ-ব্যবস্থাপনা ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে সরকারি অর্থের অপচয়, প্রকৃত বাজার মূল্য অপেক্ষা অনেক বেশি মূল্যে মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও কেমিক্যাল রি-এজেন্ট ক্রয়, নির্ধারিত সময়ে মালামাল সরবরাহ না করা, সরকারি আদেশ লঙ্ঘন করে ঔষধ ক্রয় করা, ভ্যাট ও আইটি যথাযথ কর্তন না করা, রাজস্ব প্রাপ্তিসহ অন্যান্য বিবিধ প্রাপ্তি সরকারি কোষাগারে জমা না করা, ক্রয়কার্যে পিপিআরসহ সরকারি বিধি-বিধান যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত হার ও বাজার মূল্য অপেক্ষা উচ্চ মূল্যে এমএসআর ক্রয় করা, স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী ঔষধ সরবরাহ না করা সত্ত্বেও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের এমআরপি মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্যে ঔষধ ক্রয় করা, ইউজার ফি সম্পর্কিত অনিয়ম, ক্রয় প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, যেমন- বাজার মূল্য অপেক্ষা উচ্চ দরে ক্রয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবিধান-২০১৭ এর লঙ্ঘন।
সিএজির অডিটে হাজার হাজার কোটি টাকা অনিয়ম, দুর্নীতি, আত্মসাতের চিত্র প্রকাশ হলেও এর সাথে জড়িত কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নি। অনিয়ম, দুর্নীতির সাথে জড়িত কর্মকর্তাদের অধিকাংশ আর.লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকায় এদের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নি বলেও জানা যায়।সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায় স্বাস্থ্য খাতে যে কর্মকর্তা অনিয়ম দুর্নীতিতে যত বেশি দক্ষ ছিল তাকে ততবেশি গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হতো। এটি ছিল গত সাড়ে পনেরো বছরের স্বাস্থ্য খাতের বাস্তবতা। -চলবে