মোহাম্মদ মোশাররাফ হোছাইন খানঃ
দেশের ব্যাংকিং খাতের শীর্ষ খেলাপী প্রতিষ্ঠান সমূহের তালিকায় রয়েছে জন দরদী, দানবীর, শিক্ষানুরাগী হিসেবে খ্যাত আব্দুল কাদের মোল্লার থার্মেক্স গ্রুপ । গ্রুপটির কাছে রাষ্টায়ত্ব সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রুপালীসহ ১ ডজন কমার্শিয়াল ব্যাংকের পাওনা রয়েছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার বেশী ।
বছর বছর বড় অঙ্কের ঋনের পরিমান সুদযুক্ত হয়ে সরকারী ব্যাংকগুলোর জন্য ক্যান্সারের রূপ ধারন করছে । বেসরকারি ব্যাংকংগুলোর জন্য অশনি সংকেত বলে মনে করছেন ব্যাংকিং খাতের বিশেষজ্ঞরা । ব্যাংক সমূহের বিশাল অংকের টাকা খেলাপী টাকা পরিশোধ না করে অকাতরে দান করছেন মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা, স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ও জনকল্যাণে।এ নিয়ে ব্যাংক পাড়ায় তৈরি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ বলেছেন, এ যেন ডাকাতী করে দরিদ্রকে সাহায্য করার উপহাস ।
প্রতিষ্ঠানটি ঋন খেলাপি হয়েছে অনেক আগেই। তবে আয় থাকলেও ঋণ পরিশোধে আগ্রহ নেই থার্মেক্স গ্রুপের। তবু বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ অনুগ্রহে সুবিধা পেয়েছে ঋণ পুনঃতফসিলের। সম্প্রতি রূপালী ব্যাংকে গ্রাহকের একক ঋণসীমার পাশাপাশি অতিক্রম হয়েছে ফোর্স ঋণের মেয়াদোত্তীর্ণের সময়ও। যা ব্যাংকিং খাতের সুশাসনের অভাবের প্রতিচ্ছবি বলছেন বিশ্লেষকরা।আয় থাকার পরও করছে না ঋণের অর্থ পরিশোধ। ঋণ পরিণত হচ্ছে খেলাপিতে। নতুন আইনে যা বিবেচিত ‘ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি’। যাদের চিহ্নিত করে রাষ্ট্রীয় সুবিধা থেকে বঞ্চিতসহ আইনি ব্যবস্থা নেয়ার হাঁকডাকও বাংলাদেশ ব্যাংকের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৩১৮ কোটি টাকার ওপরে। ঋণ পরিশোধ না করলেও বন্ধ হয়নি প্রতিষ্ঠানটির আয়। গেল তিন বছরে পণ্য রপ্তানি করেছে ৩৫৮ কোটি টাকার।
গ্রাহকের একক ঋণসীমাও অতিক্রম করেছে থার্মেক্স গ্রুপ। রূপালি ব্যাংকে ১০০ কোটি টাকার এলসি সীমার বিপরীতে দায় প্রায় ১১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এ ফোর্স ঋণের ৩১ কোটি টাকা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। তবে মামার বাড়ির আবদারের মতোই থার্মেক্স গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ঋণ সুবিধা ফের নবায়ন ও পুনঃতফসিলসহ একক ঋণসীমা অনুমোদনের বিশেষ আবেদন করেছে রূপালী ব্যাংক। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার পরিপন্থী। যদিও এ প্রক্রিয়ায় এর আগেও ঋণ নবায়নের সুযোগ নিয়েছে কাদের মোল্লার থার্মেক্স গ্রুপ।
জানা যায়, ১৯৯৭ সালে তৈরী পোষাক কারখানার জন্য ৯২ লাখ টাকার ক্যাপিটাল মেশনারিজ আমদানির মাধ্যমে রাষ্টায়ত্ব সোনালী ব্যাংক সাথে সম্পর্ক তৈরি হয় আব্দুল কাদের মোল্লার । অক্টোবর ২০২৪ সালের অক্টোবরে এসে আব্দুল কাদের মোল্লার প্রতিষ্ঠিত থার্মেক্স গ্রুপের ৬ প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকটি পাওনা হয়েছে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা । ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে পুরো টাকাই ক্লাসিফায়েড হয়েছে । সোনালী ব্যাংকের বিশাল অংকের এই ঋণ আদায়ে কোন তৎপরতা নেই গ্রুপটির; জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিষ্ঠার প্রথম যুগে আদর্শিক একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে থার্মেক্স গ্রুপ সফলতার চুড়ায় পৌঁছে। ২০১০ সালের পর আব্দুল কাদের মোল্লা অপরিকল্পিতভাবে বাড়াতে থাকেন নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান । এ সকল প্রতিষ্ঠানকে বড় অংকের বিনিয়োগ করে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসিসহ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক।
তবে একে একে প্রতিষ্ঠান সংখ্যা ও বিনিয়োগ বাড়লেও আনুপাতিক হারে আমদানী-রফতানী বানিজ্য বাড়াতে পারেনি থার্মেক্স। শতভাগ রপ্তানিমূখী এ সকল প্রতিষ্ঠান আমদানি – রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য সফল না হওয়ায় থার্মেক্স গ্রুপের ব্যাংকগুলোতে লোন লায়াবিলিটি বেড়েছে গাণিতিক হারে । এ ছাড়া আমদানী-রপ্তানী সূচক নিম্নমূখীতা, ঋণ প্রবাহের সাথে আমদানি-রপ্তানি বানিজ্যে অসমতা এবং এক্সপোর্ট প্রসিডেও ব্যাংকিং বিধি-বিধান পরিপালিত না হওয়ায় ফোর্স লোন সৃষ্টি করতে হয়েছে কয়েকটি ব্যাংককে।
এই ফোর্স লোনগুলোও যথারীতি পরিশোধে থার্মেক্স সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক যথার্থভাবে রক্ষা করেনি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা। ব্যাংকারদের কেউ কেউ বলেছেন – গত এক যুগ ধরে থার্মেক্সের ব্যবসার গতি-প্রকৃতি, ঋণের পরিমাণ, আমদানি-রপ্তানির আনুপাতিক অবস্থার সার্বিক বিবেচনায় সরকারী ব্যাংকগুলোতে ঋণ পরিশোধের ধারা অনিয়মিত।
এ বিষয়ে রূপালী ব্যাংক লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক আবু নাসের মাহমুদ মাসুদ বলেন, ‘ ঋণগুলো পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এটা বোর্ডের সিদ্ধান্ত। সেটা পরিশোধের নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। এটা অনাপত্তির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে।’
এ পরিস্থিতিতে সরকারী ব্যাংকগুলো থেকে ভবিষ্যৎ সহায়তা পাওয়ার কোন পথও খোলা রাখেন নি থার্মেক্স । আইনী ফাকঁ ফোকর বের করে কোর্টের মাধ্যমে এর মালিক আব্দুল কাদের মোল্লা তার সিআইবি ক্লিন রাখার কৌশলে টিকে আছেন। এটি কোন দীর্ঘ মেয়াদী সমাধান বলে মনে করছেন না সংশ্লিষ্ট ব্যাংকাররা ।
তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটিকে সামনের দিনগুলোতে ব্যবসায়িক ভাবেই টিকে থাকার চেষ্টা করতে হবে। এর বিকল্প কোন পথ নেই বলে জানিয়েছেন রুপালী, সোনালী, জনতা ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট পদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা। তারা জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসায়িক পথে যদি না হাটে ব্যাংকও লোন আদায়ের বিকল্প পথ বের করে নিতে বাধ্য হবে।কয়েকজন ব্যাংকার জানান, প্রতিষ্ঠাটিকে অনেক ছাড় দিয়েও রেগুলার রাখার চেষ্টা করা হয়েছে ।থার্মেক্স সে সম্মান রক্ষা করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে ।
কেউ কেউ বলেছেন, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কতৃপক্ষ বিধি-বিধান লংঘন করে এ প্রতিষ্ঠানটিকে অতিমাত্রা সুযোগ দেয়ায় সরকারী ব্যাংকগুলো আরো বেশী ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে । এ কারনে ব্যাংক লোন আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ব্যাংকগুলোর দায়ীত্বশীল কর্তা ব্যাক্তিরা এ দায় কোন ভাবে এড়িয়ে যেতে পারেন না।
যে সকল কর্মকর্তা ও উচ্চ পর্যায়ের নীতি নির্ধারক ব্যাংকিং আইন ও বিধান লংঘন করে এ সকল খেলাপি গ্রাহককে বার সুবিধা’র আওতায় এনেছে তারাও সমভাবে দায়ী বলে মনে করছেন ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা।
এ ছাড়া, প্রতিষ্ঠানটির মালিক আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর পর দুইজন গভর্নরের সাথে ছিলো সুসম্পর্ক। তিনি যেভাবে চাইতেন সেভাবেই গভর্নরদ্বয় তার লোন নিয়মিত রাখার পথ করে দিয়েছেন।ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের এই দুইজন গভর্নরের অযাচিত হস্তক্ষেপও লোন দানকারী ব্যাংক সমূহকে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১৭ শতাংশ। গত ১৬ বছরের মধ্যে বিতরণ করা ঋণ ও খেলাপি ঋণের সর্বোচ্চ অনুপাত এটি।
কে এই আব্দুল কাদের মোল্লা?
নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার পাঁচকান্দি গ্রামের আব্দুল মজিদ মোল্লা ও নূরজাহান বেগমের পুত্র আব্দুল কাদির মোল্লা । তিনি ১৯৬১ সালের ৮ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন । ১৯৭৪ সালে ৮ম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় তার বাবার মৃত্যু হলে সংকটাপন্ন পারিবারিক অবস্থার মধ্যেও এসএসসি পাশ করেন । এসএসসি পাশের পর রিক্তহস্তে ভাগ্যান্বেষণে বের হওয়া আব্দুল কাদের মোল্লা স্টাইফেন নিয়ে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি থেকে ডিপ্লোমা শেষ করেন ।
এরপর সিংগাপুরে পাচ বছর একটি শিপইয়ার্ডে চাকুরী করে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৮৫ সালে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডে ছোট একটি পদে চাকুরী নেন। সেখানে বারো বছর চাকুরী শেষে ’৯৭ সালে স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অবসর নেন তিনি। তিতাস গ্যাসের চাকুরী কালীন সময়ে আব্দুল কাদির মোল্লা অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল সম্পদ অর্জন করেন বলে জানিয়েছেন ঘনিষ্ঠজনরা।
ইংরেজী দৈনিক ডেইলী স্টারসহ কয়েকটি পত্রিকায় ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তিতাসের সাবেক এই ৪ হাজার টাকা বেতনের বিক্রয় সহকারী কাদের মোল্লাকে নিয়ে এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় । ওই প্রতিবেদন সমূহে বলা হয়েছে, টাক্সফোর্স ২১ শত কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পেয়েছে আব্দুল কাদের মোল্লার। রহস্যজনক কারণে ঐ তদন্ত বেশি দূর এগোয়নি। তখন বিষয়টি ছিল টক অব দ্যা কান্ট্রি ।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, বিচক্ষণ কাদের মোল্লা তিতাসে মাত্র ১২ বছরের চাকুরী জীবনে বিপুল সম্পদ অর্জন বিপদের কারন হতে পারে আচঁ করতে পারেন। ১৯৯৭ সালে চাকুরী ছেড়ে শিল্প উদ্যোক্তা হন । এরপর এক যুগের সফলতায় আব্দুল কাদের মোল্লার থার্মেক্স গ্রুপ। থার্মেক্স গ্রুপের অধীনে রয়েছে বর্তমানে ষোলটি শিল্প প্রতিষ্ঠান ।
ব্যবসায়িক জীবনে তিনি হয়েছেন একটি বীমা কোম্পানির পরিচালক ও এসবিইসি ব্যাংকের পরিচালক ও চেয়ারম্যান। হয়েছেন কর বাহাদুর, পেয়েছেন মাদার তেরেসাঁ পুরস্কারও । দেশ ব্যাপী জন কল্যাণ ও শিক্ষা বিস্তারে যশ – খ্যাতি রয়েছে তার । নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্খনে বহু স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, মসজিদ ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন ।
কয়েক শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার দেয়া এফডিআর রয়েছে বলেও জানা যায়। এছাড়া দেশের উল্লেখযোগ্য বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে ব্যাপক সাহায্য – সহযোগীতা করেছেন তিনি। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণ করে দিয়েছেন হল বা মসজিদ, কোন বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করে দিয়েছেন কনভেনশন সেন্টার আবার কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে দিয়েছেন পরিবহন । সমাজের বিভিন্ন স্তরে তিনি দান অনুদান দিচ্ছেন নিয়মিত।
ব্যাংকগুলোকে খাদের কিনারে রেখে এভাবে উদার হস্তে দান-অনুদানকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হবার একটি মতলববাজী হিসেবও মনে করছেন তার এলাকার কেউ কেউ।
তারা বলেছেন, তিনি যদি প্রকৃত শিল্পপতি বা ব্যবসায়ী হতেন ব্যাংকগুলোকে এভাবে বিপদে ফেলে উদার হস্তের দানবীর সাজতেন না।
উল্লেখ্য, ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন “পাঁচকান্দী ডিগ্রি কলেজ” । তিতাসের ৪ হাজার টাকা বেতনের একজন কর্মচারী একটি ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠিত করার মতো টাকা কোথায় পেলেন এ নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন । এ দিকে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার দেয় দান-অনুদান গ্রহণ ও নামকরণ নিয়ে শিক্ষাবিদদের মধ্যে রয়েছে বিশেষ বিতর্ক।