::: নাদিরা শিমু, নেওয়াজ তুহিন :::
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে শিপ ব্রেকিং শিল্পের মন্দাবস্থার কারণে অসংখ্য ভারী কারখানা গড়ে উঠেছে। অধিকাংশ কারখানাই শ্রমিক ও কর্মচারীদের জন্য নিরাপদ নয়। বিএম কনটেইনার ডিপোর দূর্ঘটনার পর কল কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর, বিষ্ফোরক অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে কড় নজরদারির কথা বলা হলেও ; অবস্থা কোন ভাবেই পরিবর্তিত হয় নি৷ সীতাকুণ্ডের জাহাজ নির্মাণ শিল্প থেকে শুরু করে বেসরকারি কনটেইনার ডিপো – সবখানেই শ্রমিকদের জীবন ঝুঁকিতে। দূর্ঘটনার পর পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও, টাকায় হয়েছে মুখবন্ধ।
গেল বছরের ৪ ঠা জুন সীতাকুণ্ডের শীতল পুরে বিএম কনটেইনার ডিপোতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বিস্ফোরণে ৫১ জনের মৃত্যুর ঘটনাও ধামাচাপা পড়েছে। এই ঘটনায় করা মামলারও এখনও হয়নি কোন কূল-কিনারা। ঘটনার চার দিন পর ৭ জুন.রাতে মামলা করে পুলিশ। এতে আট জনের নাম উল্লেখ করা হয়। তারা সবাই বিএম কনটেইনার ডিপোর কর্মকর্তা। এ ঘটনায় ছয়টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ভয়াবহ এই দূর্ঘটনার প্রায় ৯ মাস অতিবাহিত হলেও এখনও এ মামলার কোনো কূল-কিনারা হয়নি। তদন্তে আটকে আছে মামলাটি। কবে নাগাদ তদন্ত শেষ হবে সে বিষয়ে কিছুই বলতে পারছেন না মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও।
জানা গেছে বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছেন চট্টগ্রাম জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মোস্তাক আহমেদ। তিনি বলেন, ‘ কিছু কাগজপত্রের জটিলতার কারণে মামলাটির তদন্ত শেষ করা যাচ্ছে না। এসব কাগজপত্র পাওয়া গেলে দ্রুত সময়ে তদন্তকাজ শেষ করা যাবে।’
জেলা গোয়েন্দা পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, বিএম কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের পর ভয়াবহ বিস্ফোরণে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যসহ ৫১ জনের প্রাণহানি ঘটে। আহত হন দুই শতাধিক। ডিপোর একাংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। দুর্ঘটনায় রফতানির পণ্যবাহী ১৫৪ কন্টেইনার এবং আমদানি করা পণ্যবাহী দুটি কন্টেইনার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এ ঘটনায় ৭ জুন রাতে সীতাকুণ্ড থানার এসআই আশরাফ সিদ্দিকী বাদী হয়ে ডিপোর ৮ কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। মামলায় বিএম কন্টেইনার ডিপোর মহাব্যবস্থাপক নাজমুল আক্তার খান, উপ-মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) নুরুল আক্তার খান, ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) খালেদুর রহমান, সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্বাস উল্লাহ, জ্যেষ্ঠ নির্বাহী (প্রশাসন) নাছির উদ্দিন, সহকারী ব্যবস্থাপক আবদুল আজিজ, ডিপোর শেড ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম ও সহকারী ডিপো ইনচার্জ নজরুল ইসলামকে আসামি করা হয়।
ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় করা মামলার এজাহারে বলা হয়, ডিপোতে ড্রামভর্তি কেমিক্যাল থাকার কথা ফায়ার সার্ভিসকে জানায়নি মালিক পক্ষ। এ কারণে কেমিক্যালভর্তি কন্টেইনারের আগুন পানিতে নেভানো সম্ভব হয়নি। কেমিক্যালের কারণে এক কন্টেইনার থেকে আরেক কন্টেইনারে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সে সঙ্গে হতাহতের ঘটনা বেড়ে যায়। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ৩৩৭/৩৩৮/৩০৫.ক/৪২৭ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
মামলার এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, ডিপোতে আমদানি-রফতানি গার্মেন্টস পণ্য কন্টেইনারে রাখার পাশাপাশি কেমিক্যালভর্তি ড্রামও রাখা হতো। কিন্তু অগ্নিকাণ্ড মোকাবিলায় ডিপো কর্তৃপক্ষের অগ্নিনির্বাপণের পর্যাপ্ত সরঞ্জাম এবং প্রশিক্ষিত জনবল ছিল না। কেমিক্যাল-জাতীয় পদার্থের আগুন নেভানোর মতো কোনো ধরনের প্রস্তুতিও তাদের ছিল না।
এ অবস্থায় ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হলে ফায়ার সার্ভিসের একাধিক টিম পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ডিপো কর্তৃপক্ষ ড্রামভর্তি কেমিক্যাল কন্টেইনারে থাকার বিষয়টি ফায়ার সার্ভিসকে জানায়নি। ড্রামভর্তি কেমিক্যালের কারণে এক কন্টেইনার থেকে আরেক কন্টেইনারে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সে সঙ্গে ড্রামভর্তি কেমিক্যালের ৬-৭টি কন্টেইনার একযোগে বিস্ফোরিত হয়।
মামলার এজাহারে পুলিশ আরও উল্লেখ করেছে, বিস্ফোরণের ভয়াবহতায় আশপাশের ২-৩ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা অনেক ভবনের কাচ টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে। বিস্ফোরিত কন্টেইনারের ছড়িয়ে পড়া টুকরোর আঘাতে ঘটনাস্থলে থাকা ফায়ার সার্ভিসকর্মী, পুলিশ সদস্য এবং বিপুল সংখ্যক মানুষ হতাহত হয়। এ জন্য আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে এত সময় লেগেছে। কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা, ডিপো পরিচালনায় দুর্বল ব্যবস্থাপনা এবং অব্যবস্থাপনার কারণে অগ্নিকাণ্ড ও হতাহতের ঘটনা ঘটে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত এ মামলার তদন্ত শেষ করতে পারেনি পুলিশ। মামলার আসামিদের কাউকে গ্রেফতারও করা হয়নি। ফলে মামলার তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই বলে জানান সীতাকুণ্ড থানার ওসি তোফায়েল আহমেদ।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘ বিএম ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলাটি প্রথমে সীতাকুণ্ড থানা পুলিশ তদন্ত করেছিল। কিছু দিন আগে মামলাটি জেলা গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখন জেলা গোয়েন্দা পুলিশ মামলা তদন্ত করছে।’
ওসি আরও বলেন, বিস্ফোরণের পর গত নভেম্বর মাসে বিএম কন্টেইনার ডিপোর আমদানি-রফতানি পণ্য ব্যবস্থাপনা পুরোদমে শুরু হয়েছে। দুর্ঘটনার পর ডিপো ব্যবহার করে আমদানি-রফতানি ও খালি কন্টেইনার সংরক্ষণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। ডিপো সংস্কার করার পর গত ২২ আগস্ট শুধু খালি কন্টেইনার সংরক্ষণের অনুমোদন দেয় কাস্টমস। গত ২৫ অক্টোবর ৯ শর্তে পোশাকপণ্য রফতানি কার্যক্রম ব্যবস্থাপনার অনুমোদন দেওয়া হয়।
শর্ত মানায় গত ৭ নভেম্বর আমদানি-রফতানি কার্যক্রম পুরোদমে শুরুর অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে বিএম ডিপোকে রাসায়নিক পণ্য ব্যবস্থাপনার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে।
বিএম কনটেইনার ডিপোর মালিক পক্ষ ভয়াবহ বিস্ফোরণে দগ্ধদের ক্ষতিপূরণ দেবার ঘোষণা দিলেও এখনও পাননি অনেকেই।
চালক মহিবুল্লাহ কাভার্ড ভ্যান নিয়ে গিয়েছিলেন সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে। তার গ্রামের বাড়ি যশোর জেলায়। সে দিনের ঘটনায় এক মাস ধরে হাসপাতালের বেডে তীব্র জ্বালা-পোড়ার যন্ত্রণায় ভোগেন।
মহিবুল্লাহর মা আমেনা বেগম শনিবার রাতে বলেন, ডিপোর ঘটনায় দগ্ধ ছেলেটাকে একটা টাকাও দেয়নি কেউ। আমরা অনেক কষ্ট করে টাকা-পয়সা ম্যানেজ করে তার চিকিৎসা করিয়েছি। বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ টাকা দিতে চেয়ে নাম নিয়ে গেলেও টাকা দেয়নি।
ফরিদপুরের নজরুল ইসলাম ঘটনার দিন ঢাকার একটি কোম্পানির কাভার্ড ভ্যানচালক হিসেবে সেখানে মাল নিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ফিরতে পারেননি। দগ্ধ হওয়ার পর নজরুল ইসলাম ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নেন।
দগ্ধ নজরুলের ভাই কামরুল ইসলাম বলেন, ভাই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ঢাকার একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে কাভার্ড ভ্যানচালক হিসেবে চাকরি করতেন। তিনি এখনও কর্ম অক্ষম। কিন্তু ঘটনাস্থলে যাদের কারণে আমার ভাই দগ্ধ হলো তাদের কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা ছাড়া আর কোনো টাকা-পয়সা পাননি।
তিনি বলেন, বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ তো মোটা অঙ্কের সহযোগিতার আশ্বাস দিল, কিন্তু সে টাকা তো এখনও পেলাম না।
তাদের মতোই এখনও সহযোগিতা পাননি দগ্ধ কাভার্ড ভ্যানচালক সজীব, মাসুম মিয়া ও ফারুকসহ আরও অনেকে। যদিও ঘটনার পর চট্টগ্রাম ও ঢাকায় চিকিৎসারত ব্যক্তির স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষের লোকজন। তারা এই তালিকায় অনেক পরিবারকে তিন দফায় ১৫ হাজার করে টাকাও দিয়েছে, কিন্তু অন্যদের মোটা অঙ্কের টাকা তুলে দিলেও এসব পরিবার এখনও কোনো টাকা পাননি বলে তারা জানিয়েছেন।
সজীব কাভার্ড ভ্যানের চালক ছিলেন। তার স্ত্রী মিথিলা আকতার জানান, স্বামী দগ্ধ হওয়ার পর ঢাকায় আনা হলে দুই দফায় অপারেশন হয়েছে। তিনি নিজ খরচে হাসপাতালে ছিলেন, কিন্তু এখনও বিএম ডিপো থেকে টাকাটা পাননি।
চিকিৎসাধীন আবদুল আমিন শেখের মা পারুল আকতার জানান, তার ছেলে সে দিন ডেইলি কাজে ছিল। ছেলে দ্বগ্ধ হওয়ার পর মাত্র ১৫ হাজার সহায়তা দিয়েছে বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ। আর কোনো টাকা পাননি তিনি।
কথা বলার এক ফাঁকে তিনি বলছিলেন, বাবা ওরা কি আমাগো আর টেকা দিবে?
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় স্মার্ট গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) মেজর জেনারেল (অব.) শামসুল হায়দার চৌধুরীর সঙ্গে।
তিনি বলেন, আমাদের সাহায্য অব্যাহত আছে। যারা এখনও টাকা-পয়সা পাননি তারা যেন নিজ উদ্যোগে যোগাযোগ করেন। এ ছাড়াও আমাদের টিম কাজ করছে। যারা এ ঘটনায় দগ্ধ হয়েছেন বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসহ যোগাযোগ করলে আমরা তাদের হাতে টাকা পৌঁছে দেব। এ ছাড়াও এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের কোনো স্বজন চাকরির জন্য উপযোগী হলে তাদের আমরা প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করব।
তিনি আরও বলেন, আমরা টাকা দেওয়া এখনও বন্ধ করিনি। যাদের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে তাদের টাকা দেওয়া হয়েছে। যারা এখনও টাকা পায়নি তারা এসে তাদের নাম বললে আমরা বেঁচে থাকা তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে দেখব। কারণ ঘটনার দিন কোন কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কারা এসেছিল সেই তালিকায় তাদের ও প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে।
তিনি জানান, এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় তারা ৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ৬৯ জনের মধ্যে টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৬ জন নিহত রয়েছেন। এ তালিকায় ১৩ জন ফায়ার কর্মী ৯ জন কর্মচারী এবং অন্যান্য ৪ জন। ফায়ার সার্ভিসের নিহতদের ১৫ লাখ, বিএম ডিপোতে কর্মরত ও সাধারণ নিহতদের ১০ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। তবে এ ঘটনায় এখনও ৩ ব্যক্তির লাশ ডিএনএ পরীক্ষা করানো সম্ভব হয়নি। ফলে তাদের পরিচয় জানা যায়নি। এ কারণে ওই ৩ ব্যক্তির টাকা কাকে দেওয়া হবে এখনও সে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি তারা। এ ঘটনায় যাদের অঙ্গহানি হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী হলে ১০ লাখ, বিএম ডিপো ও সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে ৬ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, এ ঘটনার পর প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের অর্থ সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল যারা দগ্ধ হয়েছেন ও চিকিৎসাধীন আছেন তাদের প্রত্যেককে ৪ লাখ টাকা করে দেওয়া হবে। তবে বিএম ডিপো তাদের আহত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ঠিকই টাকা বুঝিয়ে দিয়েছে। তবে অনেক সাধারণ দগ্ধ মানুষ সেই টাকা পাননি।