::: রাহাত আহমেদ :::
ঢাকা ওয়াসা গেল ১২ বছরের অন্তত ১৪ বার পানির দাম বাড়িয়েছে। বিদেশি ঋণের অংকও বাড়ছে। কিন্তু পানি নিয়ে ভোগান্তি যেন শেষ হবার নয়। এরমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির কাছে সরকারের পাওনাও বাড়ছে দিন দিন৷ এই সংস্থার কাছে সরকারের বকেয়া পাওনা মাত্র চার বছরের ব্যবধানে বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এ বকেয়া টাকার পরিমান এখন দশ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। মূলত সংস্থাটির বাস্তবায়নকৃত ও চলমান প্রকল্পের জন্য স্থানীয় এবং বৈদেশিক ঋণ বাবদ নেওয়া হয়েছে বিপুল অঙ্কের এই অর্থ। ঢাকা ওয়াসার এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সীমাহীন দুর্নীতি, অতিরিক্ত রাজনৈতিক প্রভাব, প্রয়োজনের অধিক জনবল এবং ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যয় বাড়ছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, দক্ষতা বাড়াতে এসব প্রতিষ্ঠানে সংস্কার জরুরি।
কিন্তু বিপুল অঙ্কের এই অর্থ বকেয়া থাকার পরও পানির দাম যেমন বাড়াতে হয়েছে তেমনিভাবে রাজধানীবাসীর পানির চাহিদা মেটাতেও হিমসিম খাচ্ছে ওয়াসা৷ তবে ওয়াসার হিসাব বলছে, ঢাকা ওয়াসার দৈনিক প্রায় ২৭০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করার সক্ষমতা রয়েছে। এর মধ্যে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থেকে পানি উৎপাদন করা হয় ৯১ কোটি লিটার, আর বাকি ১৭৯ কোটি লিটার গভীর নলকূপ থেকে উৎপাদন করা হয়। আর রাজধানীবাসীর পানির চাহিদা দৈনিক ২১০ থেকে ২৪০ কোটি লিটার। চাহিদা বাড়ছে তাই প্রকল্প বাড়বে এটাই স্বাভাবিক।
ঋণের টাকায় ঢাকা ওয়াসার বাস্তবায়নাধীন অধিকাংশ প্রকল্পই নির্ধারিত সময় ও খরচে শেষ হচ্ছে না। একাধিকবার প্রকল্পের মেয়াদ ও বরাদ্দের অর্থ বাড়ানোর পরও কাজ অসমাপ্ত থাকছে।রাজধানীর কুড়িল, বিশ্বরোড, ভাটারা নূরের চালা, উত্তর বাড্ডা, মধ্য বাড্ডা, মেরুল ডিআইটি, কালাচাঁদপুর, মিরপুর, আগারগাঁও, রায়েরবাজার এলাকায় পানির সমস্যার কোন সমাধানই দিতে পারছে না ওয়াসা।
ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায়, কিছু কিছু এলাকায় পানির সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ সমস্যা সমাধানে ঢাকায় ৮০০টির বেশি পাম্পের মধ্যে ১০০টির বেশি পাম্পে বোরিং (গভীরে পাইপ বসানো) করাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্র বলছে, গত ২২ জানুয়ারি ঢাকা ওয়াসার বকেয়ার বিষয়ে অর্থ বিভাগ থেকে স্থানীয় সরকার বিভাগে চিঠি পাঠানো হয়েছর। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বকেয়া টাকা জমা দেওয়ার বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
চিঠিতে বলা হয়, সরকার বিভিন্ন সময়ে যে ঋণ দেয়, তা পরিশোধসূচি অনুযায়ী ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের পরিশোধ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সূচি অনুযায়ী ঋণের অর্থ পরিশোধ না করলে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সরকারের বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। ঢাকা ওয়াসার সঙ্গে অর্থ বিভাগের স্বাক্ষরিত লোন অ্যাগ্রিমেন্ট বা এলএ (ঋণচুক্তি) ও সাবসিডিয়ারি লোন অ্যাগ্রিমেন্ট বা এসএলএ (সম্পূরক ঋণচুক্তি) অনুযায়ী, বকেয়ার পরিমাণ ২৪ হাজার ৩৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
ওয়াসাকে দেওয়া এ চিঠিতে স্থানীয় এবং বৈদেশিক ঋণের আসল ও সুদ (ডিএসএল) নির্ধারিত অর্থনৈতিক কোডে জমা দিতে বলা হয়।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান মনে করেন, ‘ সংস্থাটি ঋন টাকায় জনগণ জন্য সুফল আনতে না পারলে ভবিষ্যতে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে পাওয়া প্রকল্প সহায়তার বিষয়ে সতর্ক হওয়া জরুরি। সেবার দাম বাড়িয়ে ঘাটতি পুরন না করে প্রকৃত চিত্র সামনে আনা উচিত। ‘
উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থের উৎস দুটি—বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন ও উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে পাওয়া প্রকল্প সহায়তা বা ঋণ। বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে পাওয়া প্রকল্প সহায়তা/ঋণ গ্রহণকারী সংস্থার অনুকূলে বাংলাদেশ সরকার বিনিয়োগ করে। এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষে অর্থ বিভাগ ও ঋণ গ্রহণকারী সংস্থার মধ্যে একটি চুক্তি হয়, যা সম্পূরক ঋণচুক্তি নামে পরিচিত।
অন্যদিকে সরকারের নিজস্ব সম্পদ থেকে স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দেওয়ার সময় অর্থ বিভাগের সঙ্গে ঋণ গ্রহণকারী সংস্থার যে চুক্তি হয়, সেটি ঋণচুক্তি হিসেবে পরিচিত। আর ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চুক্তি অনুযায়ী সরকারকে কিস্তির টাকা বাবদ যে অর্থ পরিশোধ করে, তা পরিচিত ডেট সার্ভিস লায়াবিলিটি (ডিএসএল) হিসেবে।
এক যুগ আগেও ঢাকা ওয়াসার ঋণ ছিল শূন্যের কোঠায়। অর্থ বিভাগের ডিএসএল হিসাব বিবরণীর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরেও প্রতিষ্ঠানটির ডিএসএলের পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। এখন তা ২৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ চার বছরে ঢাকা ওয়াসার কাছে সরকারের পাওনা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
বকেয়া পাওনার বিষয়ে জানতে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, ‘ ঢাকা ওয়াসার সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্ধিত পানির চাহিদা মেটাতে নেয়া প্রকল্পের সুফল জনগণই পাচ্ছে। আর সরকারের পাওনার টাকার অংকটি সঠিক নয়। এই পরিমান দশ হাজার কোটি টাকা মতো হবে। কতটা পেলো সেটি বড় নয়; ঢাকা ওয়াসা সরকারের অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করেছে -সেটিই স্বার্থকতা। ‘
বকেয়ার বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার উপপ্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা এ এম মোস্তফা তারেক বলেন, চিঠিতে বকেয়ার যে তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে, তা সঠিক নয়। ঢাকা ওয়াসা নিয়মিত ডিএসএল পরিশোধ করে আসছে। গতবছরও ঢাকা ওয়াসার কাছে বকেয়া ৫১ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা ছিলো, এখন কমেছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এসব টাকা জনগণের করের টাকা। সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা, অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং জবাবদিহির অভাব রয়েছে। সুতরাং প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার করতে হবে। তা না হলে সরকারের দায় আরো বাড়বে।
সরকারের বকেয়া পাওনা পরিশোধ করার তাগাদা আসলেও পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে ঢাকা ওয়াসা। ঢাকা ওয়াসার তথ্যমতে সায়দাবাদ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট থেকে উৎপাদিত প্রতি এক হাজার লিটার পানির জন্য সংস্থাটির খরচ ২৫ টাকা, পদ্মা যশলদিয়ায় ২৭ টাকা এবং গন্ধবপুর ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টে সম্ভব্য খরচ হবে ৩৫ টাকা। একারনে সরকার থেকে বাড়তি ভুর্তকি চায় ঢাকা ওয়াসা। ঢাকা ওয়াসা গত দুই বছরে দুবার পানির দাম বাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে ২০০৯ সালের পর ১৩ বছরে ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বেড়েছে ১৪ বার। করোনাকালে প্রথম দফায় পানির দাম বাড়ানো হয় ২০২০ সালের এপ্রিলে। এরপর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে আরেক দফা দাম বাড়ে। এ দুই দফায় আবাসিকে প্রতি এক হাজার লিটার পানির দাম বেড়েছিল তিন টাকা ৬১ পয়সা (৩১ শতাংশ)। বাণিজ্যিকে বেড়েছিল চার টাকা ৯৬ পয়সা (১৩ শতাংশ)।ওয়াসার দেয়া নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী ২০ শতাংশ দাম বাড়ালেও আবাসিক গ্রাহকদের প্রতি হাজার লিটার পানির জন্য দাম গুনতে হবে ১৮ টাকা ২১ পয়সা। আর একই হারে দাম বাড়লে বাণিজ্যিক গ্রাহককে প্রতি হাজার লিটারের জন্য ৫০ টাকা ৪০ পয়সা হারে পানির দাম গুনতে হবে।
সরকার পানির জন্য ভুর্তকি দেবে না এমন নীতিগত সিদ্ধান্তের বোঝা জনগণের কাঁধেই পড়বে। একদিনে বৈদেশিক ঋণের বোঝা ; অন্যদিকে বাড়ত দামে পানি কেনার বোঝা- সবমিলিয়ে নাভিশ্বাস উঠেছে রাজধানীবাসীর৷ সরকারের প্রস্তাবিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাজধানীতে জোনভিত্তিক পানির দাম নির্ধারণ করে বস্তিতে বসবাসরত নিম্ন আয়ের মানুষকে কম দামে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে মধ্যবিত্তের কাছে নতুন বোজা চাপানো হবে, বেড়ে যাবে পানির দাম।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী তাজুল ইসলামও মনে করেন, ‘ঢাকা শহরে বসবাসরত বেশিরভাগ মানুষই বিত্তবান’ । দরিদ্রদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করে সেই টাকা দিয়ে ধনীদের ভর্তুকি দেওয়া নৈতিকভাবে কতটা সমর্থনযোগ্য নয়।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) চেয়ারম্যান ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন , ‘ঢাকা ওয়াসার অনিয়ম, দুর্নীতি, একনায়কতন্ত্র এবং অদক্ষতার কারণে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে চলেছে। পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সেবা দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত এ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতাগুলো দূর না করে ব্যর্থতার দায় জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়।’
ঢাকা ওয়াসার কাছে সরকারের বকেয়া পাওনা মাত্র চার বছরের ব্যবধানে বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এ বকেয়া টাকার পরিমান এখন দশ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। মূলত সংস্থাটির বাস্তবায়নকৃত ও চলমান প্রকল্পের জন্য স্থানীয় এবং বৈদেশিক ঋণ বাবদ নেওয়া হয়েছে বিপুল অঙ্কের এই অর্থ।
বকেয়া পাওনার বিষয়ে জানতে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, ‘ ঢাকা ওয়াসার সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্ধিত পানির চাহিদা মেটাতে নেয়া প্রকল্পের সুফল জনগণই পাচ্ছে। আর সরকারের পাওনার টাকার অংকটি সঠিক নয়। এই পরিমান দশ হাজার কোটি টাকা মতো হবে। কতটা পেলো সেটি বড় নয়; ঢাকা ওয়াসা সরকারের অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করেছে -সেটিই স্বার্থকতা। ‘