24.3 C
Dhaka
Thursday, October 2, 2025

বাঁশখালীতে ভোটের মাঠে নৌকার প্রতিপক্ষ ছিলো পুলিশ

আরও পড়ুন

বিশেষ প্রতিনিধি  :::

ভোটের একদিন পর চট্টগ্রামের বাঁশখালী আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী মুস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী মুখ খুলেছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন বাঁশখালী থানার ওসি তোফায়েল আহমেদ নিজেই ঈগল প্রতীকের প্রার্থী মুজিবুর রহমান সিআইপি’র পক্ষে ভোট কেটেছেন। শুধু ভোট কেটে নেন নি, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ভয় লাগাতে একটি কেন্দ্রে জলকামান ডুকিয়ে  সংখ্যালঘুদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছেন।

সোমবার রাতে বাঁশখালী আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও প্রার্থিতা বাতিল হওয়া নৌকার প্রার্থী এমন অভিযোগ করেছেন।

তিনি বলেন, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের ওসি থাকাকালীন সময়ে  ১৯৬ টি শিল্প প্রতিষ্ঠানে মাসিক মাসোহারা তোলার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ তদন্তে পুলিশ সদর দপ্তরের একজন পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। যেদিন তদন্ত গঠন করা হয় সেদিনই তাকে চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানায় প্রাইজ পোস্টিং করা হয়। ৮ ই ডিসেম্বর  এমন বিতর্কিত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদকে বাঁশখালী থানার দায়িত্ব দেওয়া হলে নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয় এমন অভিযোগ নির্বাচন কমিশনে করেছিলাম। অভিযোগ করেছি জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছেও। বেশ কয়েকদফা অভিযোগ করার পরও নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

নতুন পদায়নকৃত একজন ওসির বিরুদ্ধে কেমন কেন এই ধরনের অভিযোগ জানতে চাইলে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ নির্বাচন কমিশনারের কাছে লেখা চিঠিতে আমি বলেছিলাম সীতাকুণ্ডে  অবস্থানকালীন সময়ে বিএম ডিপো ট্রাজেডি’র নানা বিতর্কিত ইস্যু  চাপা দিতে সহযোগিতা করেছিলেন  ওসি তোফায়েল। তার সাথে বিএম ডিপোর মালিক, স্বতন্ত্র প্রার্থীর নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। এছাড়া মহাসড়কে স্ক্রাপের ট্রাক ডাকাতির সাথে তার সম্পৃক্ততার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এমন একজন বিতর্কিত কর্মকর্তাকে একটি মহল সুকৌশলে  বাঁশখালী থানায় পদায়ন করেছে। অভিযোগ সুস্পষ্ট।  ‘

প্রতিবেদকের হাতে আসা চিঠিতে দেখা যায়, নৌকার প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবর চিঠি দিয়েছিলেন ৮ ই ডিসেম্বর । সেই চিঠিতে ওসি তোফায়েল আহমেদের বিরুদ্ধে দৈনিক প্রথম আলো ও দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত সংবাদের সংযুক্তিও দিয়েছেন।

সুত্রমতে, ওসি তোফায়েল আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে নয় পুলিশ সদস্যের স্বাক্ষ্য গ্রহন করেছিলেন পুলিশের  ‘ডিএনপিসি’ বিভাগ। 

চট্টগ্রামের পটিয়া আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলামের দেয়া অভিযোগের ভিত্তিতে ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নেজাম উদ্দিনকে প্রত্যাহার করা হয়েছিলো। একই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুলাইমান ইসলামের বিরুদ্ধে নৌকার প্রার্থীর অভিযোগ দেবার পর তাকেও প্রত্যাহার করে নেয় নির্বাচন কমিশন। অন্যদিকে, চট্টগ্রামের খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম -১০ আসনের নৌকার প্রার্থীর বাসায় ভাড়া থাকার অভিযোগ উঠার পর তাকেও প্রত্যাহার করে নেয় নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনকে দুষ্ট ও নিরপেক্ষ করতে চট্টগ্রামের  বিভিন্ন আসনের  থানার ওসিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার পর তাকে প্রত্যাহার করা হলেও বাঁশখালীর বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের নিরবতা প্রশ্ন তৈরি করেছে জনমনে। সেই প্রশ্ন ও সন্দেহের আগুনে ঘি ঢেলেছে ভোট গ্রহনের শেষ মুহুর্তে  মোস্তাফিজুর রহমানের সাথে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কথোপকথন ফাঁস করা, নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্র থেকে একজন পৌর  কাউন্সিলরকে তুলে আনার ঘটনা, সর্বশেষ তার প্রার্থীতা বাতিলের সিদ্ধান্ত।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত চাম্বল, জলদি কেন্দ্র, সাধনপুর, পুঁইছড়ি কেন্দ্রে বাঁশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদের উপস্থিতিতেই ভোট কেটে নেয়া হয়েছে। এসব কেন্দ্রে পুলিশের ভয়ভীতি উপেক্ষা করে ভোটাররা লাইনে দাঁড়ালে দুপুর দেড়টার দিকে কেন্দ্রে জলকামান প্রবেশ করানো হয়। ভয় পেয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা কেন্দ্র ছেড়ে চলে যায়। 

উত্তর সরল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে প্রকাশ্যে ব্যালেট ছিনতাইয়ের খবর পেয়ে বেলা পৌনে তিনটার সময়  ওই কেন্দ্রে হাজির হন নৌকার প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান। হাতে আসা ভিডিও চিত্রে দেখা যায় কেন্দ্রের বারান্দায়  ডুকার সাথে সাথে লাঠিসোটা নিয়ে নৌকার প্রার্থীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ঈগল প্রতীকের সমর্থকরা। এসময় ঈগল প্রতীকের সমর্থকদের ছুঁড়ে মারা ইটের আঘাতে তার মাথা ফেটে যায়। অভিযোগ, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদের নির্দেশে নৌকার প্রার্থী মোস্তাফিজকে অবরুদ্ধ করতে প্রধান গেট আটকে দেয় পুলিশ ও আনসারের সদস্যরা।

উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা নৌকার প্রার্থীকে উদ্ধার করে আনার জন্য থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ফোন দিলে তিনি উপরের নির্দেশের অজুহাতে সময় ক্ষেপন করেছেন। আক্রান্ত হবার পর গেট আটকে রাখার কারণে মোস্তাফিজুর রহমানের ব্যক্তিগত গাড়ির ড্রাইভার কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে নি। ড্রাইভার ও প্রত্যক্ষদর্শিদের ভাষ্যমতে, এই কেন্দ্রটি বিএনপি-জামাত অধ্যুষিত। ঈগলের পক্ষে জামাতের বেশ কিছু কর্মী অস্ত্রসহ কেন্দ্রের বাইরে অবস্থান নেয়। তারা বেশ কয়েক রাউন্ড গুলিও ছুঁড়ে। নৌকার প্রার্থী মোস্তাফিজের উপর হামলা, কেন্দ্রে গোলাগুলির ঘটনা এবং তার গাড়ি ভাঙচুর করার খবর তিনটা এক মিনিটে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ও জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল বাসার ফখরুজ্জামানকে অবহিত করেন গণমাধ্যমকর্মীরা।

হাতে আসা আরেকটি ভিডিওতে ঈগল সমর্থক জামাত কর্মীদের  চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলতে শোনা যায় ‘ মুস্তাফিজের গাড়িটি ভেঙে দাও ‘। এসময় আরেক শিবিরকর্মীকে বলতে দেখা যায় ‘ গাড়ি চেয়ারম্যানের বাসায়। ‘ 

ভোটের মাঠে উত্তর সরলের ওই কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনজন গণমাধ্যম কর্মী। তাদের ভাষ্যমতে, নৌকার প্রার্থী মোস্তাফিজ এই কেন্দ্রে ডুকলে তার উপর হামলা করা হবে ; এটিই পরিকল্পনার অংশ ছিলো। পৌনে তিনটার দিকে নৌকার প্রার্থী একজনকে নিয়ে এই কেন্দ্রে আসার কারণে পরিকল্পনা অনুযায়ী সুযোগ তৈরি হয়। এসময় তার সাথে কোন লোকজন ছিলো না। 

এই কেন্দ্রে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করা একটি বেসরকারি টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান জানান, ওসি তোফায়েল আহমেদের সিগনাল পাবার পরই তার গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। কেন্দ্রের গেট আটকে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। সেই সাথে আতন্ক ছড়াতে ফাঁকা গুলি ছুঁড়া হয়েছে। সন্ত্রাসীদের বলতে শোনা যায় ‘ ওসি স্যার ফোন করেছে, ফোন করেছে। ‘

কেন্দ্রটিতে ঈগল প্রতীকের এজেন্ট ও বেশকিছু সন্ত্রাসী সকাল থেকে অবস্থান করছিলো – এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে একাধিক সুত্র। বেলা আড়াইটা থেকে ওই কেন্দ্রটিতে ঈগলের পক্ষে ভোট কেটে নেয়া হচ্ছিলো। নৌকার প্রার্থী মুস্তাফিজুর রহমানের উপর হামলা, কেন্দ্রের গেটে তালা দেওয়া এবং তার গাড়ি ভাঙচুরের পর বেশ কিছু কর্মী সমর্থক কেন্দ্রের বাইরে জড়ো করে নতুন নাটক সাজায় পুলিশ প্রশাসন। বলা হয়, কেন্দ্র দখল করতে ডুকেন নৌকার প্রার্থী। অথচ হাতে আসা তিনটি ভিডিওতে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে ‘ নৌকার প্রার্থী মোস্তাফিজ ডুকার সাথে সাথেই তার উপর লাঠিসোঁটা নিয়ে আক্রমণ করা হয়।

জানতে চাইলে স্থানীয় ভোটার আব্দুর রহিম এবং সোলাইমান বলেন, ‘ কেন্দ্র দখল করতে কেউ একজন নিয়ে আসেন না। যা যা দেখেছেন সব পুলিশের সাজানো নাটক। পুলিশ বনাম আওয়ামী লীগ খেলা চলেছে। ‘

সুত্রমতে, নৌকার প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমানকে ওই কেন্দ্র আটকে রেখে বাঁশখালীর ৪৯ টব কেন্দ্রে নৌকার বিপক্ষে নিরবিচ্ছিন্নভাবে ভোট কেটে নেয়া হয়। সুত্রটি জানায়,  নৌকার প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমানকে প্রথম লাঠির আঘাত করা ব্যক্তিটি তার আত্নীয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী জাফরুল ইসলামের উপর হামলার শোধ নেয়া হয়েছে এই ঘটনায়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নৌকার প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমানের বিভিন্ন অডিও, ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেবার কাজটিও করেছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদ। নির্বাচনের মাঠে ওসির ভোট কেটে নেয়া বাধা দেবার কারণে ওয়ার্ড কাউন্সিলর গফুর আহমেদকে থানায় তুলে নিয়ে আসেন তিনি। নিজের কর্মীকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় উপস্থিত হলে থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদ সংসদ সদস্য মুস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর সাথে ঔদ্ধত্যপুর্ণ আচরণ করেছেন। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফায়েলের রুমে থাকা গণমাধ্যম কর্মীরা জানিয়েছেন রুমে ডুকার সাথে সাথেই কোন কথা না শোনে ‘ ভিডিও করো ‘ ‘ভিডিও করো ‘ এমন বাক্যবাণে ওসি তোফায়েল নৌকার প্রার্থী মুস্তাফিজুর রহমানকে উত্যক্ত করেছেন। ভিডিও ধারন করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়াই ছিলো ওসি তোফায়েল আহমেদের মুল লক্ষ্য।

সাথে থাকা একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিনিধি জানান, ‘ ওসি তোফায়েল এমপি মোস্তাফিজের সাথে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছেন। একজন এসআইকে মোবাইল হাতে ভিডিও করতে বলেন।  এসময় নৌকার প্রার্থী উত্তেজিত হয়ে থানা ছেড়ে চলে আসেন। ‘

প্রার্থীর অভিযোগ না শুনে ভিডিও ধারন করা কোন ধরনের আইন, প্রশ্ন সেই গণমাধ্যমকর্মীর। 

একই সময় বাঁশখালী উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে খবর পৌঁছে দেওয়া হয় ওসি তোফায়েল আহমেদ নৌকার প্রার্থী মোস্তাফিজকে থানায় এনে বসিয়ে রেখেছেন। তার প্রার্থীতা বাতিল হচ্ছে। 

ছাত্রলীগের নেতা মাহবুবুর রহমান  বিভেল এই ঘটনার সত্যতা জানতে পৌনে একটার দিকে নৌকার প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমানের মেয়ে উপজেলা যুব মহিলা লীগের সভাপতি  রওকাতুন নুর প্রিয়তাকে ফোন দেন। 

সকাল থেকে কেন্দ্র কানাঘুষা ছিলো প্রার্থীতা বাতিলের। ঈগলের পক্ষে মাঠে পুলিশ কাজ করবে এমন তথ্যও ছড়ানো ছিলো, যাতে নৌকার পক্ষে মাঠে থাকা ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা ভয় পায়।  

সূত্রমতে, ভোটের দিন ওসির কক্ষে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে মারতে উদ্যোত হয়েছেন এমন  ভুল বার্তা পৌঁছানো হয়েছে নির্বাচন কমিশনে। সুত্রটির দাবি, যেহেতু এরআগেও নৌকার প্রার্থী বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়েছেন, সুযোগের ব্যবহার করা হয়েছে। মুলত নৌকার প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমানকে উত্তর সরল কেন্দ্রে হামলার পর সেখানে আটকে একঘন্টায় চুড়ান্ত করা হয়েছে ভোটের জয় পরাজয়। ভোটগ্রহণ শেষ হবার পর তাকে উদ্ধারের নাটক মঞ্চস্থ করা পুলিশের তরফ থেকে। 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

সবশেষ খবর