বিশেষ প্রতিনিধি
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত অবস্থায় তোফায়েল আহমেদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও মহাসড়কে ডাকাতিতে সহযোগিতার অভিযোগ উঠে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থানা এলাকার ১৯৬ কারখানা থেকে মাসে দেড় কোটি টাকা ‘চাঁদাবাজি’ র অভিযোগ উঠা সেই ওসি তোফায়েল আহমেদের বিরুদ্ধে একজন পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল পুলিশ সদর দপ্তর। এবার নয়জন পুলিশ কর্মকর্তাকে স্বাক্ষ্য দিতে ডাকা হয়েছে পুলিশ সুপার কার্যালয়ে।
রবিবার (২৪ শে ডিসেম্বর) চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার শফিউল্লাহর স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে নয় পুলিশ কর্মকর্তাকে পুলিশ সুপার কার্যালয়ে হাজির হবার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে চিঠিতে কি কারণে তাদের ডাকা হয়েছে সেটি উল্লেখ করা হয় নি। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের স্মারকের (১১৭/২৩) বরাদ দিয়ে (২৩/১২/২৩) সংশ্লিষ্ট প্রেক্ষিতে অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে এদের তলব করার কথা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
চিঠিতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থানার উপ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) নাসির উদ্দীন ভুঁইয়া, টেকনাফ থানার উপ পরিদর্শক ( নিরস্ত্র) সোহেল আহমেদ, ভুজপুর থানার পিএসআই সাজিব হোসেন, সীতাকুণ্ড থানার উপ পরিদর্শক ( নিরস্ত্র) সাকাওয়াত হোসেন মৃদা, চন্দনাইশ থানার এএসআই কামাল কাজীকে ২৬ শে ডিসেম্বর চট্টগ্রাম পুলিশ সুপার কার্যালয়ের ৪০৬ নং কক্ষে হাজির হতে বলা হয়েছে। সুত্রমতে, ডিল্য্ন্ডপিএস কর্মকর্তা বদরুল মামুন (পরিদর্শক) সীতাকুণ্ডের সাবেক ওসি তোফায়েল আহমেদের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ সম্পর্কে স্বাক্ষীদের ভাষ্য নেবেন।
এছাড়া, রাঙ্গামাটি পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মরত কনস্টেবল কৃষ্ণ দাশ চাকমা, কনস্টেবল জামিল হোসেন ( পুলিশ লাইনে সংযুক্ত), চিকদাইর পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল মেঘনাথ চাকমা, মোটরযান শাখায় কর্মরত পুলিশ কনস্টেবল দীন মোহাম্মদকেও হাজির হবার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
সুত্রমতে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ তদন্তে এসব কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহন করা হবে। পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্তে এসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে জানিয়েছে সুত্র।
সুত্রমতে,নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনার অজুহাতে সীতাকুণ্ডের বিতর্কিত ওসি তোফায়েল আহমেদকে বাঁশখালী থানায় পদায়ন করে দেশের সুবৃহৎ কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের নিরাপত্তা ও পরিবেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে, এমন অভিযোগ পৌঁছে গেছে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের টেবিলে। দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প গ্রুপ আবুল খায়ের গ্রুপের ক্রাপবাহী ড্রামট্রাক সুপরিকল্পিতভাবে ডাকাতির অভিযোগ উঠা ওসি তোফায়েল আহমেদের পদায়ন করা হয় বাঁশখালী থানায়।ওসি তোফায়েল সীতাকুণ্ডের ১৯৬ কারখানায় চাঁদাবাজি করে বাংলাদেশ পুলিশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করেছে এমন সংবাদ একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হবার পরদিনই তাকে বাঁশখালীতে পদায়ন করা হয়।
অভিযোগপত্র অনুসারে , সীতাকুণ্ডের ১৯৬টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান, চোরাই জ্বালানি তেল ও জাহাজের পুরোনো আসবাব বিক্রির দোকান, ড্রামের কারখানা, পুরোনো লোহা বিক্রেতা, পরিবহন চালক—কেউই বাদ যান নি চাঁদাবাজি থেকে। পুলিশ সদর দপ্তর ওসি তোফায়েলের বিরুদ্ধে যেদিন তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সেদিনই তাকে আরেকটি থানায় প্রাইজ পোস্টিং দেয়া হয়েছে,যেখানে দেশের অন্যতম বৃহৎ কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প অবস্থিত।
পুলিশের ঘনিষ্ঠ একটি সুত্র জানায়, সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ নতুন নয়। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে শিপইয়ার্ডে মো. রাসেল নামে এক শ্রমিককে হত্যার পর মরদেহ গুম করার অভিযোগ গড়ায় আদালত পর্যন্ত। মরদেহ গুমের অভিযোগ এনে আদালতে মামলার জন্য আবেদন করেন ভুক্তভোগী শ্রমিকের বাবা মো. ইউনুস মিয়া। চলতি বছরের ১ অক্টোবর চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুল হকের আদালতে সীতাকুণ্ডের ওসি তোফায়েলসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করে ভুক্তভোগী শ্রমিকের বাবা।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী তোফায়েল আহমেদ ২০০৮ সালে এসআই (নিরস্ত্র) হিসেবে চাকুরীজীবন শুরু করেন পুলিশের খুলনা পুলিশ লাইনে। ২৩ শে ডিসেম্বর ২০১৬ সালে পদোন্নতি পেয়ে ওসি হন তিনি। ২০২২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম রেঞ্জে যোগ দেওয়ার আগের পুরো চাকরিজীবনই খুলনা রেঞ্জে। পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জে যোগ দেওয়ার ২৬ দিনের মাথায় সীতাকুণ্ডের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি। চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার শফিউল্লাহর সাথে খুলনা জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় কাজ করেছেন তিনি। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে খুলনা রেঞ্জে প্রায় ৬ বছর ছিলেন চট্টগ্রামের বর্তমান পুলিশ সুপার । পরে পুলিশ সুপার হিসেবেও কিছুদিন খুলনায় দায়িত্ব পালন করেন। সেই সুবাধে সীতাকুণ্ড থানায় যোগ দেবার পর থেকে ঘুষের স্বেচ্ছাচারিতা সংবাদের শিরোনাম হলেও বহাল তবিয়তে থেকেছেন গুরুত্বপূর্ণ এই থানার চেয়ারে। এমনকি অভিযোগ তদন্তকালীন সময়ে বাঁশখালীর মতো গুরুত্বপূর্ণ থানায় বদলি করা হয়েছে তাকে৷
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কর্মরত এক সংবাদকর্মী জানান, থানায় যোগদানের পর হতে তোফায়েল আহমেদ একই থানার মহিলা মুন্সি কনস্টেবল নাসরীনকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন সময় ধর্ষন করে আসছিলেন। এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরে পুলিশের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ সেই মহিলা মুন্সীকে অন্যত্র বদলি করে দিলেও নিশ্চিন্ত থেকেছেন তোফায়েল ।
জানা যায়, তোফায়েল আহমেদ ওসি ডিবি হিসেবে খুলনায় কর্মরত থাকা অবস্থায় ওই জেলার শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তার ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করেছেন। সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে নানা ধরনের অপকর্ম জড়ান তিনি ।
আরেকটি সুত্রের দাবি, জেলার শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ হবার কারনে ওসি তোফায়েল সীতাকুণ্ডের সার্কেল অফিসারকেও নানাভাবে মানসিক নির্যাতন করেছেন। তার ভয়ে অধিনস্থ পুলিশ কর্মকতারাও তটস্থ থাকেন। জেলার শীর্ষকর্তার ঘনিষ্ঠ হবার কারণে সীতাকুণ্ড থানায় যোগদানের পর থেকে তিনি চট্টগ্রাম জেলার ওসিদের বদলির তদবির বানিজ্য করে আসছেন; সুত্রটির দাবি।
সীতাকুণ্ড থানার একটি সুত্রমতে, ওসি তোফায়েল এতটা নারী লিপ্সু যে শিল্প প্রতিষ্ঠান ‘কেএসআরএম গ্রুপ’ হতে সীতাকুণ্ড থানার ইন্টেরিয়রের কাজ দেখবাল করার জন্য একজন সুন্দরী নারী থানায় আসলে তিনি ওই নারীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে চট্টগ্রাম খাগড়াছড়ি পার্বত্য অঞ্চলে নিয়ে গিয়ে অনৈতিক মেলামেশা করতে বাধ্য করেন। বিষয়টি জানাজানি হবার পর লাখ টাকায় চাপা দেয়া হয়েছে সেই সংবাদ।
তোফায়েল আহমেদ সীতাকুণ্ডের শিপইয়ার্ড ব্যবসায়ী ইকবালকে নিয়ে প্রায় সময় নারী জুয়া মদ নিয়ে আড্ডা মজে থাকেন, এমন তথ্যও মিলেছে অনুসন্ধানে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তার কাছে পুলিশিং এর চেয়ে নেশার প্রাধান্য বেশি। তিনি প্রায় সময় নেশায় বুঁদ থাকেন।
সুত্রমতে, তোফায়েল আহমেদের বিরুদ্ধে পুলিশ হেডকোয়ার্টার আইজিসেলে অর্ধ শতাধিক পৃষ্ঠা সম্বলিত অভিযোগপত্র জমা পড়েছে। যার প্রেক্ষিতে গত ৬ এবং ৭ ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে, তদন্ত কমিটি তদন্ত কার্যক্রম শুরুর আগেই বাঁশখালীর মতো থানায় বদলি করে পুরস্কৃত করা হয়েছে তাকে।
ওসি তোফায়েল আহমেদ সংশ্লিষ্ট তদন্তে পুলিশের উপ পরিদর্শক ও কনস্টেবলদের জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে তলব করার খবরটি গোপন রাখা হয়েছে কৌশলে। স্বাক্ষী হিসেবে তালিকায় থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যে দুইজন বর্তমানে সীতাকুণ্ড থানায় কর্মরত আছেন, বাকিরা বদলি হয়ে রেন্জের বিভিন্ন এলাকায় চাকরিরত।