25.6 C
Dhaka
Thursday, October 2, 2025

মুক্তিযুদ্ধে ভীনদেশী বন্ধুরা

আরও পড়ুন

ওয়াহিদ জামান :::

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সকল শ্রেণী পেশার বাঙ্গালিদের সাথে কিছু ভিনদেশী মানুষের অবদান জাতি চিরদিন স্মরণ রাখবে। তাদের কেউ বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে প্রচারণা করেছিলেন, কেউ বা যুদ্ধকালীন অর্থ সংগ্রহে নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন, আবার কেউ কেউ যুদ্ধাহত মানুষের পাশে দাঁড়াতে এসেছিলেন বাংলাদেশে।

পঁচিশে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের আকস্মিকতা, নির্বিচার হত্যা এবং অপ্রস্তুত নিরীহ মানুষের ওপর বেপরোয়া আক্রমণ যে কোনো মানুষকে দু:খ দিয়েছে, ক্ষুব্ধ করেছে।

বাংলাদেশে হানাদার বাহিনীর নৃশংসতায় প্রাণ গেছে লাখ লাখ মানুষের। আহত কিংবা পঙ্গুত্ববরন করা মানুষের সংখ্যাও কম। বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা চলছিল তখন। অসহায় বেসামরিক  বাঙালি উপর ঝাপিয়ে পড়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। অসহায় বাঙালি   আর্তনাদ অনুভব করতে পেরেছিলেন বিখ্যাত সংগীত দল দ্য বিটলসের লিড গিটারিস্ট জর্জ হ্যারিসন। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের জন্য কিছু একটা করতে চাইছিলেন তিনি। হ্যারিসন উদ্যোগ নিলেন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর। বাংলাদেশের যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে  গান লেখা হয়ে গেল। তিনি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট মেডিসিন স্কয়ারে আয়োজন করেছিলেন  কনসার্ট। সেই চ্যারিটি কনসার্টে একে একে জড়ো হলেন জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, লিওন রাসেল, রিঙ্গো স্টার, বিলি প্রেস্টন, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ আলী আকবর খান এবং ওস্তাদ আল্লা রাখাসহ অনেকেই। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ তখন পুরোটাই অচেনা।  এই কনসার্টের পর পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল বাংলাদেশের যুদ্ধ পরিস্থিতি । 

ব্রিটেন থেকেই যুদ্ধের জন্য অস্ত্র কিনতে কিংবা শরণার্থীদের সহায়তায় সর্বপ্রথম  অর্থ প্রেরণ করা হয়েছিলো।  যুদ্ধের নয় মাস নিদ্রাহীন সময় কাটিয়েছেন বৃটিশ বাংলাদেশীরা। তাদের এমন উদ্বিগ্নতায় এগিয়ে এসেছিলেন বেশকিছু ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করা সংগঠনগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘ অ্যাকশন বাংলাদেশ’  ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ ‘ এর প্রধান ছিলেন পল কনেট। এই সংগঠনের ব্যানারে পয়লা অগাস্ট লন্ডনের ট্রাফলগার স্কয়ারে বিরাট জনসমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিলো। সমাবেশস্থলটি লোকারণ্যে পরিণত হয়, মানুষের ভীড়ে কোথাও তিলমাত্র জায়গা অবশিষ্ট ছিলো না। সেই সমাবেশে বিপুল সংখ্যক বৃটিশ জনগণ যোগ দিয়েছিলেন, যাদের অধিকাংশই বৃটেনের বসবাসরত বাঙালিদের প্রতিবেশী। সেই সমাবেশে এতো বেশি উপস্থিতি ছিলো যে ট্রাফলগার স্কয়ারের কাছাকাছি দুরত্বে অবস্থান করা ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারির বারান্দাগুলোও গমগম করছিলো।  বিলেতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থনে সবচেয়ে বড় এই সমাবেশে।

পূর্ব লন্ডনে মিছিল, সভা, কনসার্ট, ডাকটিকিট প্রকাশ—নানা কর্মসূচির মাধ্যমে সে সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তোলা হয়।

গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাক্রম সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে জানাতে যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো।  প্রবাসী বাঙালিদের বড় একটি অংশ যুক্তরাজ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে।

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার যুদ্ধে যে কয়জন ভিনদেশী বন্ধু বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাদের অন্যতম ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ-বিষয়ক সচিব ডগলাস হিউম। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যরাও জোরালোভাবে বাঙালির স্বাধীনতার লড়াইকে সমর্থন জানান। 

২৫ মার্চ রাতে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় সংঘটিত গণহত্যার কয়েক দিনের মধ্যেই হাউস অব কমন্স সভায় গণহত্যার বিষয়টি  নিয়ে আলোচনা হয়। ২৯ মার্চ হাউস অব কমন্স সভায় ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ-বিষয়ক সচিব স্যার অ্যালেস ডগলাস হিউম পূর্ব বাংলায় বাঙালিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানোয় দুঃখ প্রকাশ করেন এবং পাকিস্তানকে তাদের সামরিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করার আহ্বান জানান।

ডগলাস হিউম  হাউস অব কমন্স সভার আলোচনায়  পূর্ব বাংলায় বসবাসকারী ব্রিটিশ নাগরিকদের নিরাপত্তার কথাও উত্থাপন করেছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী আক্রমণ চালিয়েছিল, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত ব্রিটিশ কাউন্সিলও হামলার শিকার হয়। তবে হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি। সেদিন পুরো হাউসই ডগলাস হিউমের সঙ্গে শোক প্রকাশ করেছিল। এ ছাড়া হাউস অব কমন্স সভায় এপ্রিল, মে, জুন, সেপ্টেম্বর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসজুড়ে পূর্ব বাংলায় সংঘটিত এবং চলমান ঘটনা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। বাংলাদেশের পক্ষে  চলে তর্ক-বিতর্ক।

১৯৭১ সালে মু‌ক্তিযু‌দ্ধের সমর্থনে বা‌র্মিংহাম ও লন্ড‌নে প্রতি‌টি সভা-সমা‌বে‌শে স‌ক্রিয় অংশগ্রহণের পাশাপা‌শি মু‌ক্তিযুদ্ধের তহবি‌লে নি‌জের সবটুকু সামর্থ্য দি‌য়ে সহ‌যোগিতা ক‌রে‌ছেন ব্রিটিশ বাংলাদেশিরা । মু‌ক্তিযুদ্ধের সম‌য়ে বি‌লে‌তে সভা-সমা‌বেশ-মিছিলের ছ‌বি আর ভিডিওতে দেখা যায় বেশ কয়জন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যকে। পল কোনেট দম্পতি, পিটার শো র , জন স্টোনহাউজ এমপি, গর্ডন সালভেনের মতো মানবাধিকার কর্মী বৃটেনে বাঙালিদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। 

বাংলাদেশে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর  হত্যাযজ্ঞ ও বাঙালিদের মানবেতর অবস্থার সংবাদ পেয়ে ব্রিটিশ বেশকিছু এমপি তাঁদের নিজেদের উদ্যোগে পশ্চিম বাংলায় শরণার্থী শিবির ও পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাদেশ সরকারনিয়ন্ত্রিত এলাকায় ভ্রমণ করেছিলেন।ভ্রমণকারী এমপিদের মধ্যে ব্রুস ডগলাস। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার অবদান বৃটিশ বাংলাদেশীরা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেন। এছাড়া যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্সে ৩ আগস্ট বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ১৩০ জনের বেশি সদস্য আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য পাকিস্তানের কাছে আবেদন জানান। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বৈদেশিক মুদ্রা গিয়েছিল ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের তোলা চাঁদার অর্থ। ব্রিটেন থেকে চাঁদা হিসাবে তোলা তিন লাখ ৯২ হাজার পাউন্ড তোলা হয়েছিল, যদিও স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল সংগৃহীত অর্থ। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে আরেকটি  অবিস্মরণীয় নাম  সাংবাদিক সাইমন ড্রিং।  ১৯৭১ সালে সংগঠিত মুক্তিযুদ্ধের সময় জীবন বাজি রেখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নৃশংসতার ছবি ও খবর বিদেশি গণমাধ্যমের সহায়তায় বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন সাইমন ড্রিং। বাংলাদেশের দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে একটা বড় শক্তি ছিল বিদেশিদের সমর্থন-সহযোগিতা।

- Advertisement -spot_img

সবশেষ খবর