26 C
Dhaka
Thursday, October 2, 2025

গাড়িতে আগুন দেয়া যুবক শনাক্ত

আরও পড়ুন

কুতুবউদ্দিন হিরু :::

রাজধানীতে বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে গাড়িতে আগুন লাগিয়ে আতন্ক ছড়ানো সেই যুবককে অবশেষে শনাক্ত করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। গণমাধ্যম কর্মী সেজে  আগুন লাগানোর গোপন ভিডিও দৈনিক এই বাংলা প্রকাশ করে। বলাকা এক্সপ্রেসের গাড়িতে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানো সেই যুবককে শনাক্ত করার কথা জানিয়েছে গোয়েন্দা সুত্র।

গোয়েন্দা পুলিশ সুত্রমতে, বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে শনিবার (২৮ অক্টোবর) রাজধানীর নয়াপল্টন ও আশপাশের এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যবহার করার হয়েছে গণমাধ্যমকর্মীদের। ঢাকায় অর্ধশতাধিক যানবাহনে আগুন দেওয়াসহ অন্তত সাতটি পুলিশ বক্সে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।

সুত্রমতে, কুমিল্লা থেকে ক্রিকেট সরান্জামের ট্রাকে করে অন্তত বিশ হাজার ‘স্টাম্প’ ব্যাট ডুকানো হয়। বাইতুল মোকারামের স্টেডিয়াম মার্কেটের একটি গুদামে ডুকানো হয়েছে এসব সরন্জাম।

অন্য একটি সুত্রমতে,  ‘গোল্ডেন ফিফটি টু’ নামের একটি সংগঠন বিএনপির পক্ষে সমাবেশস্থলে  লাঠি সরবরাহের কাজ সমন্বয় করেছে। ক্রিকেট খেলার স্টাম্পসহ বিভিন্ন পেট্রোল বোমা তৈরির কাঁচামালও জোগাড় করে রাখা হয় সমাবেশের দুই দিন আগে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সংগঠনটির সাড়ে চারশো কর্মিদের ব্যবহার করে  ঢাকায় বিভিন্ন বাসে আগুন দেয়া হয়েছে। ত্রি স্টার নয়নকে ঢাকার শান্তিনগরে দায়িত্ব দেয়া হয়।

এরই মধ্যে একটি বাসে আগুন দেওয়ার পর ওই বাসের চালক জানান, ভেস্ট পরা এক যুবক তার বাসে আগুন দেয়। আগুন দেওয়া ওই ব্যক্তি গোয়েন্দা পুলিশের সদস্য বলে ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও ভাইরাল হবার পর খোঁজ নিয়ে নয়নকে শনাক্ত করে পুলিশ।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, তারা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন । এরই মধ্যে শনিবার গাড়িতে আগুন দেওয়াসহ পুলিশের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বাসে আগুন দেওয়া ওই যুবক হলেন রবিউল ইসলাম নয়ন। তিনি যুবদল ঢাকা দক্ষিণের সদস্য সচিব। তাকে ২০১৩-১৪ সালেও বাসে আগুন দেওয়ার একাধিক ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছিল।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, তারা বেশ কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করেছেন। যেখানে দেখা যাচ্ছে রবিউল ইসলাম নয়নের নেতৃত্বে বাসে আগুন দেওয়া হচ্ছে। তারা ইতোমধ্যে নয়নকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান শুরু করেছেন। নয়নকে গ্রেফতার করতে পারলে তার সঙ্গে আরও যারা ছিলেন তাদেরও পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যাবে। বিএনপি ও জামাত কর্মীদের সহযোগিতা করা গণমাধ্যমকর্মীদের শনাক্তের কাজ চলছে।

খোঁজ নিয়ে  জানা যায়, গণমাধ্যমের গাড়ি ব্যবহার করেই ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পেট্রোল  বোমা তৈরির কাঁচামাল পাঠানো হয় নির্বিঘ্নে। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি বেসরকারি টেলিভিশনের ‘সিইও’ জামাত শিবিরের কর্মীদের কাছে লাঠিসোটা ও পেট্রোল বোমা তৈরির কাঁচামাল পোঁছানোর কাজ তদারকি করেছেন। সুত্রমতে, তিনি ক্যাডারভিক্তিক সংগঠন ইসলামি ছাত্র শিবিরের সাবেক ‘সাথী ‘। চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যায়নরত অবস্থায় শিবিরের রাজনীতির সাথে সক্রিয় থাকলেও সাংবাদিকতায় জড়িত হবার পর নানা কৌশলে  নিজের পরিচয় আড়াল করতে সক্ষম হন। শীর্ষপদে নিজের জায়গা তৈরি করেন দেশের প্রথম সারির সংবাদভিত্তিক টেলিভিশনে।

সুত্রমতে, গেল দশ বছরে চট্টগ্রাম কলেজ শিবিরের অন্তত আধাডজন নেতাকে ওই টেলিভিশনের সাংবাদিক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে নিজের বলয় তৈরি করেছেন তিনি। সংবাদভিত্তিক ওই টেলিভিশনের সিইও পদে দায়িত্ব পালন করা ওই সাংবাদিকের সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।

শনিবার বিকাল পৌনে ৪টার দিকে মালিবাগ ফ্লাইওভারের ওপর বলাকা পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেবার ঘটনার ভিডিও চিত্র ফাঁস হবার পর থেকে তদন্ত মাঠে নামে গোয়েন্দা পুলিশ । ওই বাসে আগুনের ঘটনাটি ধারণ করা একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, যুবদল নেতা রবিউল ইসলাম নয়ন একটি বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরা অবস্থায় বাসটির পাশে ঘুরছেন। বুলেট প্রুফ জ্যাকেটে ‘প্রেস’ লেখা রয়েছে। তার হাতে একটি লাঠি। সঙ্গে বেশ কয়েকজন যুবক। এর মধ্যে একজন যুবক তরল জাতীয় পদার্থসহ একটি বোতল গাড়ির ভেতরে ছুড়ে মারছে। যুবদল নেতা নয়নের সাথে ওই বেসরকারি টেলিভিশনের সিইও’র যোগাযোগ আছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দা পুলিশ।

গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তা জানান, বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনাগুলোর ভিডিও ফুটেজ ও তথ্য সংগ্রহের পর বিশ্লেষণ করেছেন তারা। পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাষ্য, রবিউল ইসলাম নয়ন ও তার সহযোগীরা মোটরসাইকেলে করে ‘প্রেস’ লেখা জ্যাকেট পরে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে বাসে আগুন দিয়েছে। ‘প্রেস’ লেখা জ্যাকেট তাদেরকে কারা সরবরাহ করেছে সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷ প্রতিটি ঘটনায় বিশেষ কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে।

শনিবার রাতেই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ সাংবাদিকদের জানান, ‘যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পোশাক পরে আগুন লাগিয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। সংঘর্ষের সময় যারা পুলিশ হাসপাতালসহ বিভিন্ন জায়গায় আগুন লাগিয়েছে, ওই চক্রটিই ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য ভেস্ট পরা অবস্থায় বাসে আগুন দিতে পারে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রবিউল ইসলাম নয়নের গ্রামের বাড়ি মাগুরার মোহম্মদপুরের পানিঘাটা এলাকায়। স্কুলজীবন শেষে ঢাকায় এসে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া নয়ন একসময় ঢাকা মহানগর উত্তরের ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের ও পরবর্তীতে মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক হন। সাহসী হওয়ার কারণে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সুনজরে পড়েন তিনি। পরে তাকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক এবং পরে মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সদস্য সচিব পদ দেওয়া হয়।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, নয়নের বিরুদ্ধে প্রায় দুই শতাধিক মামলা রয়েছে। মাগুরার মোহম্মদপুর ছাড়াও রাজধানী ঢাকার একাধিক থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে ও ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে ১২ দিনের মাথায় রাজধানীর বাংলামোটরে পুলিশের একটি বাসে, পরীবাগ ও পান্থপথে পৃথক তিনটি বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় এক পুলিশ সদস্যসহ একাধিক ব্যক্তি মারা যান। পরে ২০১৪ সালের ৬ জানুয়ারি দুই সহযোগীসহ নয়নকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

সেসময় পুলিশ জানায়, নয়নসহ গ্রেফতার হওয়া তিন জনকে দলে ‘থ্রি-স্টার’ হিসেবে ডাকা হতো। নয়নের নেতৃত্বে তারা তিন জন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বাসে আগুন দিতো।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, নয়ন আগে থেকেই বাসে আগুন দেওয়ার বিষয়ে দক্ষ। গত শনিবারও সে সহযোগীদের নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় বাসে আগুন দেয়। এবার সে কৌশল হিসেবে প্রেস লেখা বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে ঘুরে বেড়ায়। যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে যুবদল নেতা হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারে।

গোয়েন্দা পুলিশের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, পুড়ে যাওয়া এক গাড়ির চালক ডিবির জ্যাকেট পরা এক যুবকের আগুন দেওয়ার কথা বলেছিলেন, সেটি ছিল নয়ন। গাড়িচালক প্রেস লেখাটিকে ডিবি বলে ধারণা করে থাকতে পারেন। নয়ন ও তার সহযোগীদের ধরতে পারলে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে। কার নির্দেশনায় নয়ন আগুন দিয়েছে তা জানা যাবে।

এইবাংলা/সিপি/হিরু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

সবশেষ খবর