25.2 C
Dhaka
Thursday, October 2, 2025

বঙ্গবন্ধু টানেলের আদ্যপান্ত

আরও পড়ুন

তানভীর আহমেদ

সাহসীরা নাকি স্বপ্ন দেখেন,  একই সাথে  সে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। যে কোনও সাফল্য বা অর্জনের মূলেই থাকে পরিশ্রমী মানুষের সেই আকাঙ্খা বা স্বপ্ন। স্বপ্নই আসলে মানুষকে দিয়ে পরিশ্রম করায়, এটাই মানুষকে অসম্ভবকে সম্ভব করার চেষ্টা করতে উৎসাহ দেয়। যার মাঝে স্বপ্ন নেই তার মাঝে আসলে আশা বা উৎসাহ নেই। সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা, ব্যর্থতা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস, ছোট অবস্থায় থেকেও জীবনে বড় অর্জন করার সংকল্প – সবকিছুই উৎসই আসলে স্বপ্ন ।হলিউডের মুভিতে এবং গল্প, উপন্যাসে টানেলের ব্যাপারটি অনেকে শুনেছেন, পড়েছেন এবং দেখেছেন । কিন্তু সেই টানেল যে বাংলাদেশে নির্মিত হবে তা অনেকের কাছে ছিল একসময় স্বপ্ন ছিল । দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় সেই সাহসী স্বপ্নের আজ বাস্তবিক রূপ “বঙ্গবন্ধু টানেল” ।

কর্ণফুলী টানেল একটি স্বপ্ন, সম্মৃদ্ধ অর্থনীতির পথে অপার সম্ভাবনার নাম। একটি দেশের মর্যাদার ও অহঙ্কারের প্রতীক, দেশের অর্থনীতির নতুন সোপান। দক্ষিণ চট্টগ্রামের  মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন  কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ-  নেতৃত্বের দৃঢ়তা, স্বকীয়তা ও মূল্যবোধের মূর্ত প্রতীক হয়ে  মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।

এইতো ৮০-৯০ দশক,এক বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেও চোরাচালান, মাদক ও অস্ত্র পাচার এর নিরাপদ রুট হিসেবে কুখ্যাতি ছিল বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেঁষে গড়ে উঠা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নৈসর্গিক ভূমি আনোয়ারা উপজেলার। সময়ের বিবর্তনে সরকারি-বেসরকারি এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের ফলে কিছু কল- কারখানা স্থাপিত হলেও দৃশ্যমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন চোখে দেখেনি এই উপজেলার মানুষ। রাতের অন্ধকার দূরীভূত করে সূর্য উঠবেই এটি অমোঘ সত্য৷ দেরিতে হলেও আনোয়ারা উপজেলার আকাশে উদিত হয়েছে দিনবদলের সূর্য। আর দিন বদলে সেই উদিত সূর্য “বঙ্গবন্ধু টানেল”।

বঙ্গবন্ধু টানেলের ইতিবৃত্ত :

বাংলাদেশ সরকারের পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের মত একটি মেগা প্রকল্পের নাম কর্ণফুলী টানেল যেটাকে বঙ্গবন্ধু টানেল নামে নাম করণ করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জিং মেগা প্রকল্প ছিল এটি। দেশের জন্য তো প্রথম আবার দক্ষিণ এশিয়ায়ও প্রথম টানেল এটি । এই” বঙ্গবন্ধু টানেল “
কর্ণফুলী নদীর উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তকে সংযোগ করে  চট্টগ্রামকে পরিণত করবে “ওয়ান সিটি টু টাউনে”।

টানেল নির্মাণ কাজের উদ্বোধন ও নির্মাণ কর্মযজ্ঞ  

চট্টগ্রাম মহানগরীর পতেঙ্গা পয়েন্ট থেকে আনোয়ারা উপজেলা পর্যন্ত টানেলের মূল দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। টানেল অভ্যন্তরে নির্মিত হয়েছে দুটি টিউব। প্রতিটি টিউবে রয়েছে দুটি করে চার লেইন। মাঝপথে রয়েছে তিনটি ক্রস প্যাসেজ। সম্ভাব্য যে কোনো দুর্ঘটনায় উদ্ধার তৎপরতার সহায়ক হিসেবে এই ক্রসপ্যাসেজ নির্মিত হয়েছে।

অপরদিকে, টানেলের উভয় প্রান্তে আছে ওয়েস্টেশন ও অ্যাপ্রোচ রোড। আনোয়ারা প্রান্তে স্থাপন হয়েছে টোলপ্লাজা ও ৭২৭ মিটারের উড়াল সেতু । আর অ্যাপ্রোচ রোড ৫ দশমিক ২৮ কিলোমিটারের। আর পতেঙ্গা প্রান্তে আছে ৫৫০ মিটারের অ্যাপ্রোচ রোড। ” বঙ্গবন্ধু টানেল” প্রকল্প বাস্তবায়ন দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কর্ণফুলী নদীর মাঝ বরাবর ৩৬ মিটার ও উভয় প্রান্তে ১৮ মিটার গভীরতায় টানেল নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। টানেল অভ্যন্তরে রয়েছে অগ্নিপ্রতিরোধক বোর্ড, ডেকোরেটিং বোর্ড। টানেলের দুই প্রান্তে একটি করে ১৫ মেগাওয়াটের দুটি বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিং পিং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। পতেঙ্গা থেকে দক্ষিণ প্রান্তে আনোয়ারা পর্যন্ত প্রথম টিউবের খনন কাজ সম্পন্ন হয় ২০২০ সালের ২ আগস্ট। একই বছরের ১২ ডিসেম্বর আনোয়ারা থেক পতেঙ্গামুখী দ্বিতীয় টিউবের কাজ শুরু হয়ে পরবর্তী বছরের ৭ অক্টোবর তা সম্পন্ন হয়। এরপর শুরু হয় পূর্ত ও ইলেক্ট্রমেকানিক্যাল কাজ।

টানেল নির্মাণে যত খরচ :

বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণে প্রকল্পের শুরুতে ব্যয় ধরা হয় ৮ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। পরে ডলারের মূল্য বৃদ্ধিসহ বিশ্বজুড়ে সৃষ্ট কোভিড ও অন্যান্য কারণে প্রয়োজনীয় নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যায়। ফলে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। পুরো প্রকল্পে চীনের এক্সিম ব্যাংক স্বল্প অর্থাৎ ২ শতাংশ সুদে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে ৫ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। বাকি অর্থ জোগান দিচ্ছে সরকার। অর্থাৎ ৪ হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা।

টোল আদায় এবং টানেলে যে সব যানবাহন চলবে :

দেশের বিভিন্ন সেতু এবং শাহ আমানত সেতুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বঙ্গবন্ধু টানেলের টোল প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রাথমিক প্রস্তাবনায় তিন চাকার গাড়ি ও মোটরসাইকেলের বিষয়টি বিবেচনা করা হয়নি। প্রস্তাবনায় প্রাইভেট কার, জিপ ও পিকআপের জন্য ২০০ টাকা, মাইক্রোবাসের জন্য ২৫০ টাকা, ৩১ বা এর চেয়ে কম আসনের বাসের জন্য ৩০০ টাকা এবং ৩২ বা এর চেয়ে বেশি আসনের বাসের জন্য ৪০০ টাকা, ৫ টনের ট্রাকের জন্য ৪০০ টাকা, ৫ থেকে ৮ টনের ট্রাকের জন্য ৫০০ টাকা, ৮ থেকে ১১ টনের ট্রাকের জন্য ৬০০ টাকা, ট্রাক (তিন এক্সেল) ৮০০ টাকা, ট্রেইলর (চার এক্সেল) ১ হাজার টাকা এবং চার এক্সেলের বেশি ট্রেইলরের জন্য ১ হাজার টাকার সঙ্গে প্রতি এক্সেলের জন্য ২০০ টাকা বাড়তি টোল নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

দ্রুত এবং কম সময়ে যাওয়া যাবে  কক্সবাজারে :

দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কক্সবাজারমুখী যানবাহন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয়ে টানেলের অভ্যন্তর দিয়ে চলে যাবে আনোয়ারা প্রান্তে। সেখানে পিআইবি সড়ক হয়ে পটিয়ার মধ্যেদিয়ে যানবাহন উঠে যাবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক তথা আরাকান সড়কে। এতে করে চট্টগ্রামের সঙ্গে কক্সবাজারের দূরত্ব কমবে ১৫ কিলোমিটারের বেশি।

টানেলের ছোঁয়ায় পরিবর্তিত আনোয়ারা উপজেলা :

টানেলের ফলে আনোয়ারা উপজেলা এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল হয়ে উঠেছে এক নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে। পাল্টে যাচ্ছে আনোয়ারবাসীর জীবনযাত্রার মান। একের পর এক খুলছে নতুন নতুন সম্ভাবনার দুয়ার। বৃদ্ধি পেয়েছে টানেল সংযুক্ত সড়কের আশেপাশের জায়গা-জমির দাম। গড়ে উঠছে নতুন নতুন শিল্পকারখানা।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দেশের অর্থনীতিতে কর্ণফুলী নদীর ভূমিকা ঐতিহাসিক। আর এখন সেই নদীর তলদেশে নির্মিত  ট্যানেল দেশের অর্থনীতিতে রাখবে বিরাট ভূমিকা।  একই কারণে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা এবং তার সরকারের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পাবে বহুগুণ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

সবশেষ খবর