কুতুবউদ্দিন হিরো
এমটিএফই নিয়ে আলোচনার ঝড় শেষ হতে না হতেই প্রতারণার তালিকায় যুক্ত হওয়া ক্রিপ্টো মাইনিং ইন্টারন্যাশনালের (LLC) নাম প্রকাশ্যে এলো। ক্রিপ্টো মাইনিং ইন্টারন্যাশনাল যেন অনলাইনে অর্থ হাতিয়ে নেবার মহাজাল। অথচ অনেকেই জানে না ক্রিপ্টো কারেন্সি বা বিট কয়েন কি। কিন্তু অন্যেদের কথায় প্রভাবিত হয়ে এবং লোভনীয় বিজ্ঞাপন দেখে এখন অনেক ব্যবসায়ী কিপ্টো কারেন্সির ফাঁদে জড়াচ্ছেন। ঘরে বসে খুব সহজে রোজগারের নেশায় পড়ে ক্রিপ্টো কারেন্সির ফাঁদে পড়েছেন বাংলাদেশ বিমানের সাবেক এক কর্মকর্তা । বিনা পরিশ্রমে খুব সহজে আয় করার লোভে ডিজিটাল মুদ্রা বাজারে বিনিয়োগ করে এখন ঝুঁকিতে পড়েছেন ক্যাপ্টেন শাহদাত নামের এই বিনিয়োগকারী।
যার হাত ধরে শাহদাত কোটি কোটি টাকা খুঁইয়েছেন তার নাম শারমিন কাজল। শারমিন কখনো নিজেকে মডেল, কখনও নাট্য পরিচালক বলে পরিচয় দেন। এসটিভি বাংলা নামের চ্যানেলের লগো লাগানো গাড়িও ব্যবহার করেন।তবে তথ্য মন্ত্রণালয়ের নথি অনুযায়ী এমন কোন চ্যানেলের অস্তিত্ব নেই।
বিশ্লেষকদের মত, বাংলাদেশ মানি গেমের জন্য উর্বর ভুমি তা না হলে একের পর এক ক্রিপ্টো নিয়ে জুয়া আর প্রতারণা খবরের শিরোনাম হতো না। ক্রিপ্টো মাইনিং ইন্টারন্যাশনাল (LLC) ; আমেরিকান কোম্পানির নাম করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই কোম্পানিটি।
এই প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার জালে ধরাশায়ী ক্যাপ্টেন শাহদাত হোসেন। ধানমন্ডিতে নিজের বাড়ী, এক সময়ে বাংলাদেশ বিমানের পাইলট ছিলেন। পেনশনের টাকা আর বাড়ী ভাড়ার টাকা দিয়েই ভালোই চলছিল তার। এভাবেই এক শুভাকাঙ্ক্ষীর হাত ধরে ডিজিটাল কারেন্সির জালে ধরা পড়ে খুইয়েছেন প্রায় ১০ কোটি টাকা।
শাহদাত হোসেন জানান , শারমিন কাজল নামে এক মহিলা তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাত দিন তার সাথে সময় দিয়ে, গাড়িতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে – একটা সময় ক্রিপ্টো মাইনিং ইন্টারন্যাশনালের বিনিয়োগের করার জন্য রাজি করিয়ে নেন। বিনিয়োগের টাকা দুইশ দিনেই দ্বিগুণ, সাথে প্রতিদিন ক্যাশ। এমন সব লোভনীয় অফার। ‘
ক্যাপ্টেন চাপের মুখে ও লোভে পড়ে মান সম্মান রাখতে রাজি হন। মহিলাটি প্রায় দেড় বছর ধরেই তার সাথে আছেন ; তাই প্রথমে ১৪ লক্ষ টাকা এবং পুনরায় ১৫ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করেন। প্রথম দিকে রির্টান দিলেও পরবর্তীতে বলা হয় সার্ভারের কাজ চলছে আগামী সপ্তাহ থেকে টাকা পেয়ে যাবেন।
শারমিন কাজলের দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রতিদিন ১২৭ ডলারের দ্বিগুণ ২৫৪ ডলার বিনিয়োগে সপ্তাহে ১২৭০ ডলার ফেরত আসার কথা। আবার সাপ্তাহিক ৩৯১ ডলারের দ্বিগুণ ৭৮২ ডলার বিনিয়োগে সপ্তাহে ২০৫২ ডলার অর্থাৎ ২,৪০,০০০ টাকা ক্যাপ্টেন শাহদাত পাবেন বলে শারমিন কাজল লিখিতও দেন।
কিন্তু মুলত বিনিয়োগকারী ১৫ দিন পর মাত্র ৯৮ হাজার টাকা পেয়েছেন। এরেই মধ্যে সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট টিটু শারমিন কাজলের সাথে যুক্ত হন। সার্জেন্ট টিটু এবং শারমিন একসাথে থাকেন, ক্যাপ্টেনের ভাষ্য মতে, ওরা দুইজন প্লান করে এ্যাকাউন্ট থেকে মোট ৫৬ লাখ টাকা তুলে নিয়ে যায়। সর্বশেষ ২২ লাখ টাকার চেক ক্যাশ করেন নারায়ণগঞ্জের শিবু মার্কেট থেকে। জানা যায়, শারমিন কাজলের বাড়ির কাছাকাছি ব্যাংকে, নিজেই চেক নিয়ে গেছেন ।
এর পূর্বেও শারমিন কাজল তার নিজের নামে চেক লেখে নিজেই ব্যাংক থেকে টাকা তুলছেন ।কিন্তু এই ২২ লাখ টাকার চেক পাস করার জন্য কোন প্রকারের কল বা ম্যাসেজ কোনটাই পান নি ক্যাপ্টেন শাহদাত।ক্যাপ্টেন শাহদাতের অভিযোগ, শারমিন কাজলের সাথে ব্যাংকের কর্মকর্তারকও জড়িত ।’
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী বিটকয়েন বা অন্য কোন ক্রিপ্টোকারেন্সি কেনাবেচা বা সংরক্ষণ করা বেআইনি ।বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন , ‘ বাংলাদেশে বিটকয়েনের কোন অনুমোদন নেই। যেহেতু অনুমোদন নেই, সুতরাং এই জাতীয় লেনদেন বৈধ নয়।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, শারমিন কাজল এর আগেও দুবাই ভিক্তিক বাইটাপেক্স নামে একটা কোম্পানির ব্যানারে প্রায় ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে গা ঢাকা দেয়। তখন এলাকার কিছু লোকজন তার বাড়ি ঘেরাও করলে সালিশ বিচারের মাধ্যমে কিছুটা সমাধান হয়। প্রতারিত গ্রাহকদের টাকা এখন পর্যন্ত কিছু কিছু করে শোধ করছেন তিনি।
যদিও শারমিনের ভাষ্যমতে, বাইটাপেক্স জিয়া ও ফেরদৌস রুমি নামে দুইজনে মালিক ছিল, তারাই ওই টাকা নিয়ে ব্যবহার করে হাতিয়ে নেয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জিয়া শারমিনকে দুবাই নিয়ে ৭ দিন রেখে বিভিন্ন ধরনের উপটোকন দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দেয়। দেশে আসার পর সরাসরি তার সাথে যোগাযোগ করে টাকা পাঠাতে বলে। এতে করে কোম্পানির পার্টনারশিপ ভেঙে যায়। ফলে সেই কোম্পানির কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়।
শারমিন কাজল প্রথম প্রথম টাকা জিয়ার কাছে পাঠাতো। পরে নিজেই টাকা রেখে দিয়ে নিজের কাজে লাগাতেন ফেরদৌস রুমিকে বাদ দিয়ে সরাসরি জিয়ার সাথে কার্যক্রম করার কারনে কোম্পানির গোপনীয়তা থাকেনি। যদিও ফেরদৌস রুমিই তাকে জিয়ার কাছে নিয়ে যান।সিটি প্রজেক্টের পূর্বে শারমিন কাজল এবিনিউটেক বায়োস্প্রে নামে মালেয়শিয়ান একটা এমএলএম কোম্পানির সাথে সম্পৃক্ত থেকে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন । অনেক গ্রাহককে এখন পর্যন্ত পণ্য ডেলিভারি দেয়নি কাজল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়৷ শারমিন কাজলের সাথে মালেয়শিয়ান কোম্পানি এবিনিউটেক বায়োস্প্রের এমডি রনীর খুব গভীর সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্কের জের ধরে এমডি রনী’র সংসার ভাঙ্গার উপক্রম হয়েছিল। সুত্রমতে, শারমিনের সম্পর্কের ফাঁদে পা দিয়ে এপর্যন্ত ১০/১২টি পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে।
ক্রিপ্টো মাইনিং ইন্টারন্যাশনাল নিয়ে অনুসন্ধানে জানা যায়, এই কোম্পানির মূল হোতা দুবাই পলাতক এরশাদ ও আল আমীন। আল আমীন দেশে আসতে পারে না কয়েক বছর আর নানা অভিযোগ কাঁধে নিয়ে এরশাদ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সুত্রমতে, ঢাকা এলে প্রকাশ্যে ঘুরাঘুরি করেন না, এমনকি বাংলাদেশি কোন নাম্বারেই ব্যবহার করেন না তিনি। দুবাই নাম্বার দিয়ে হোয়াটস অ্যাপ খুলে ব্যবহার করছেন।
এরশাদ, আল আমীন হাসান এদের হাত ধরে প্লাটিন কয়েন নামে কোম্পানি ২০১৮-২০১৯ সালে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যায় । তাদের নামে সি আই ডি ও ডিবিতে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। অনেককেই পথে বসিয়ে পালিয়ে যায় এরশাদ ও আল আমীন। ভোলার এরশাদ, আমেরিকা নাম ব্যবহার করে ক্রিপ্টো মাইনিং ইন্টারন্যাশনাল নামের নতুন সফটওয়্যার খুলে টাকা হাতিয়ে নেবার কারখানা বানিয়েছেন।
সুচতুর শারমিন কাজলকে টার্গেট করে মাঠে নামিয়েছে পুরোনো চক্রটি। এরইমাঝে এরশাদ শারমিনের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। ব্যবসায়ীক কাজের নামে কক্সবাজার থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন জায়গা ও দেশের বাইরে বেড়াতে যান। ফলে প্রথম প্রথম ভাল গ্রাহক না মেলায় পরবর্তীতে প্রিন্স সুমন, হাসান মিরপুর, টিটু, রাজশাহীর মামুন, চাপাই শিমুল, জয়পুরহাটের সাগর ও উত্তরার মনজিল – এদেরকে কথিত মডেল শারমিন ধীরে ধীরে এই কোম্পানির সাথে যুক্ত করান।
একটা সময়ে বিপুল পরিমান গ্রাহক হাতের মুঠোয় আসে।
সুত্রমতে, সম্পর্ক তৈরিতে দক্ষ ও পারদর্শী শারমিন কাজল মানুষকে কথা ও শারিরীক বাজে ইংগিতে মুগ্ধ করে নিতে পারেন সহজেই।
এরশাদ ও শারমিন মিলে ক্যাপ্টেন শাহদতের মতো হাজার লোকের কাছ থেকে ১০ কোটি টাকা নিয়ে দুবাই পালিয়ে যায়। ভুক্তভোগীরা বলছেন, এমটিএফই-এর এই পরিনতি না হলে হয়তো ক্রিপ্টো মাইনিং নিরবে আরো শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে যেত।
ভুক্তভোগী গ্রাহকদের কয়েকজনের সাথে কথা হয়। তারা জানান, এই বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত করে শারমিন কাজলকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আরো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে ।
শারমিন কাজলের প্রতারণার ফাঁদে পড়েন বিভিন্ন ব্যবসায়ী, চাকরিজীবি কোটি কোটি খুঁইয়েছেন। এভাবে গত পাঁচ বছরে শারমিন অন্তত দশ কোটি টাকার মালিক বনেছেন।
নারায়ণগঞ্জের ঝালকূড়িতে জমি কিনে ৫ তলা বাড়ি বানিয়েছেন তিনি। আছে ব্যাংক ব্যালেন্স। কিছুদিন পরপরই বিদেশ ভ্রমন করেন। ঢাকার দামী দামী রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা দেয়া তো আছেই।শারমিন কাজলকে যারা দশ বছর আগে থেকে চেনেন তাদেরও আশ্চর্যের সীমা নেই। আলাদিনের চেরাগ পেল কিনা !
ক্রিপ্টো মুদ্রা থেকে দেশীয় মুদ্রায় রুপান্তরের জন্য গ্রাহকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং মোবাইল ফাইন্যান্সশিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে। এমএফএসের সুবিধা ব্যবহার করে কিছু কিছু ব্যক্তিগত ও এজেন্ট মোবাইল সিমের মাধ্যমে এই অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি সিআইডি একটি অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে এ রকম একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্কের সন্ধান পায়। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা ও রংপুরসহ দেশের বেশ কিছু জেলায় এ রকম লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এসমস্ত কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ব্যক্তিদের মোবাইল সিমের মাসিক লেনদেনকৃত অর্থের পরিমাণও ব্যাপক। দেশের বিভিন্ন সুপরিচিত ব্যক্তি এমন নেটওয়ার্কের সাথে জড়িত বলেও জানিয়েছে সিআইডি সুত্র।
ভুক্তভোগীদের মতে, শারমিন কাজল ও এরশাদ- এরা সংঘবদ্ধ প্রতারক। নতুন নতুন কৌশল ও প্রতিষ্ঠান খুলে প্রতারনার জাল বিছিয়ে মানুষকে পথে বসিয়ে গা ঢাকা দেন। কিছুদিন লোক চক্ষুর আড়ালে গিয়ে এক বছর বা দুই বছর পর পর দেশে ফেরেন। দুই তিন জনকে হাতিয়ে আবার দুবাই বসে বসে টাকা আত্মসাত করেন । অনলাইনে জুয়া, এলএমএম কোম্পানির ছত্রছায়ায় মানুষকে প্রতারনার ফাঁদে ফেলে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া সংঘবদ্ধ চক্রটিকে আইনের আওতায় আনা না হলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির জন্ম হবে।