মোহাম্মদ রিয়াদ হোসেন, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম :::
চীনের সাংহাই শহরের আদলে বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ মডেলে গড়ে তুলতে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ করেছে সরকার। দেশের প্রথম এই সুড়ঙ্গপথের নামকরণ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’। টানেলের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। এখন উদ্বোধনের অপেক্ষা। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ২৮ অক্টোবর টানেল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বহুল প্রত্যাশিত ও স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু টানেলের সংযোগ পথের এক প্রান্ত হচ্ছে পতেঙ্গা অপর প্রান্ত শিল্প জোন হিসেবে খ্যাত দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা। টানেলের মাধ্যমে কর্ণফুলীর দুইপাড় সংযুক্ত হয়েছে। স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু টানেল ঘিরে নদীর দক্ষিণ পাড়ের আনোয়ারা, কর্ণফুলী, পটিয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামে বইছে দৃশ্যমান পরিবর্তনের হাওয়া। ইতোমধ্যে এই উপজেলায় দেশী বিদেশী বিনিয়োগ শুরু হয়েছে। এ টানেল ধরেই কক্সবাজার পর্যন্ত হয়েছে উন্নত সড়ক যোগাযোগ এবং পাশাপাশি রেল সংযোগ। সড়কের দুপাশে গড়ে উঠছে শিল্পকারখানা এবং আবাসন। কর্ণফুলীর উত্তর পাড়ে চট্টগ্রাম মহানগর। আর দক্ষিণ পাড় দ্রুতই রূপ পেতে যাচ্ছে উপশহরে, যা এতদিন পড়েছিল অনেকটা গ্রামীণ জনপদ হিসেবে। টানেল বাস্তবায়নে লাগছে উন্নয়নের ছোঁয়া। চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড হয়ে বঙ্গবন্ধু টানেলের ভেতর দিয়ে পিএবি সড়ক হয়ে যানবাহন উঠবে কক্সবাজার মহাসড়কে। এ লক্ষ্যে প্রস্তুত হয়েছে আনোয়ারা থেকে শিকলবাহা পর্যন্ত প্রায় আট কিলোমিটার ছয় লেনের সড়ক। শেষ হয়েছে দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন স্থাপনের কাজ। অক্টোবের মাসের মধ্যেই এ লাইনে ট্রেন চালানোর টার্গেট সরকারের। কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড় আনোয়ারায় আগে থেকেই রয়েছে বিভিন্ন ভারি শিল্পকারখানা। বঙ্গবন্ধু টানেল সেখানে শিল্পায়নের গতিকে আরও বেগবান করবে। চায়না ইকোনমিক জোন বাস্তবায়নকে বড় একটি ধাপ এগিয়ে দেবে এই টানেল। কেননা এর মাধ্যমে সুগম হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা। যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল এ পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন থেকে বদলে যেতে শুরু করেছে আনোয়ারা উপজেলা। টানেল নির্মাণের ফলে পাল্টে যাচ্ছে আনোয়ারা-কর্ণফুলীসহ পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামের চিত্র। বিশেষ করে সরকারের মেগাপ্রকল্প সমূহ উন্নয়নের পরিবর্তনের ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে আনোয়ারায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের দৃশ্যপট। বঙ্গবন্ধু টানেলকে ঘিরে আনোয়ারা উপজেলা নতুন করে রূপ পাচ্ছে উপশহরে। পরিবর্তন ঘটছে এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থায়। ভৌগোলিক কারণে আনোয়ারা উপজেলা একদিকে সমুদ্র বন্দরের পাশে অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণের ফলে আনোয়ারা হবে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে অন্যতম এক মাধ্যম।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসছে অভাবনীয় পরিবর্তন:: টানেলকে ঘিরে সরকারের মেগা প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের ফলে দক্ষিণ চট্টগ্রামে যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। ফলে আনোয়ারা উপজেলার সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটবে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের সমীক্ষা অনুযায়ী বছরে প্রায় ৭০ লক্ষাধিক ছোট বড় যানবাহন চলাচল করবে টানেলের ভেতর দিয়ে। এই বিশাল সংখ্যার গাড়ির চাপ সামাল দিতে টানেলের সংযোগ সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পিএবি সড়কের কর্ণফুলীর শিকলবাহা ওয়াই জংশন থেকে আনোয়ারা কালাবিবির দীঘির মোড় পর্যন্ত ৪০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ৮ কিলোমিটার ১৮ ফুট প্রস্থের এই সড়কটিকে ৬ লেনে উন্নীত করা হয়েছে। যার প্রস্থ হয়েছে ১৬০ ফুট। ১৬০ ফুটের ছয় লেনের মধ্যে ১২০ ফুটে হবে চারটি লেন, যা দিয়ে চলবে বড় বড় যানবাহন আর বাকি ৪০ ফুটে হবে দুটি লেন যা দিয়ে চলবে স্থানীয় ছোট যানগুলো। চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড হয়ে বঙ্গবন্ধু টানেলের ভেতর দিয়ে পিএবি সড়ক হয়ে যানবাহন উঠবে কক্সবাজার মহাসড়কে। এতে চট্টগ্রামের সঙ্গে কক্সবাজারের দূরত্ব কমেছে প্রায় ১৫ কিলোমিটার।
গড়ে উঠছে নতুন নতুন শিল্পকারখানা::
টানেলকে ঘিরে দক্ষিণ চট্টগ্রামে চায়না ইকোনমিক জোনসহ বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ চলছে। ১৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে জি টু জি পদ্ধতিতে আনোয়ারা গহিরায় এলাকায় ৭৭৪ একর জমিতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল চায়না ইকোনমিক এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এতে ৩৭১টি শিল্প কারখানা স্থাপন করা হবে। এসব কারখানায় প্রায় ১ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া গত বছরের নভেম্বরে আনোয়ারায় ৩৬০ মেগাওয়েট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পর্যটন খাতে আসছে আমূল পরিবর্তন::
টানেলের আশপাশে গড়ে তোলা হচ্ছে নতুন নতুন পর্যটন স্পট। পুরোনো বিনোদন কেন্দ্রগুলোর উন্নয়নের জন্য আসছে নতুন নতুন বাজেট। টানেল ঘিরে শিল্পকারখানা ও আবাসনের পাশাপাশি খুলবে পর্যটন শিল্পের নতুন দুয়ার। কর্ণফুলী নদীর মোহনায় আনোয়ারা উপজেলার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের কূল ঘেঁষে অবস্থিত পারকি সমুদ্র সৈকত। সৈকতের পাশে পর্যটন করপোরেশনের উদ্যোগে ১৩ দশমিক ৩৬ একর জমিতে ৭১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বিশ্বমানের অত্যাধুনিক পর্যটন কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০১৮ সালের নবেম্বরে শুরু হয়েছিল এ প্রকল্পের কাজ। ২০২৪ সালের জুনে এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে।
টানেলের কাজের অগ্রগতি বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ বলেন, টানেলের দুই সড়কপথের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। টোল প্লাজা ও অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। যান্ত্রিক ও বৈদ্যুতিক কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে। পুরো প্রকল্পের ৯৮ দশমিক ৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। অক্টোবরে উদ্বোধনের পর যান চলাচল শুরু হয়ে যাবে এবং এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক কাজও চলতে থাকবে। অ্যাপ্রোচ রোড, সার্ভিস এরিয়া, পুলিশের ফাঁড়ি নির্মাণ ও ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণের কার্যক্রম চলছে।
এইবাংলা /নাদিরা শিমু/Ns