তানভীর আহমেদ :::
কিশোর গ্যাং চট্টগ্রাম শহরের একটি আতঙ্কের নাম। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা হু হু করে বাড়ছে। কিশোর গ্যাং এখন পত্রিকার পাতার নিয়মিত শিরোনাম। শহর থেকে গ্রাম, পাড়ার মহল্লা, অলিতে-গলিতে গ্যাং পার্টির উৎপাতে জনমনে বিরাজ করছে এক ধরনের আতঙ্ক।শিশু-কিশোররা সাধারণত পারিবারিক বিশৃঙ্খলা, পরিবেশ ও প্রতিবেশীর প্রভাব, পরিপার্শ্বিক অবস্থা অপরাধীদের সঙ্গে সংমিশ্রণ অসৎ বন্ধুদের খপ্পর এবং বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাবে অপরাধী হয়ে ওঠে।
রবিবার (৬ আগস্ট) রাতে আজমীর নামের এক কিশোর গ্যাং লিডারকে গ্রেফতার করে বায়েজিদ থানাকে সোপর্দ করে র্যাব ৭। গত ১০ ই এপ্রিল তাদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজি, খুনের উদ্দ্যেশ্যে জখমের অভিযোগ করে মামলা দায়ের করেন বায়েজিদ বোস্তামী এলাকার জনৈক মেহেদী হাসান। কিশোর গ্যাং লিডার আসমান, সাগর, বাপ্পী, মঙ্গল, ফিরোজ আলম ফকিরের নামোল্লেখ করে এজাহার দাখিলের চারমাস পর এজাহারভুক্ত এক নং আসামী আজমীরকে গ্রেফতার করে র্যাব। তবে পুরো সময়টিতে পুলিশের তরফ থেকে সহযোগিতা পায় রৌফাবাদ এলাকার মনির হোসেনের ছেলে কিশোর গ্যাং লিডার ‘আজমীর মঈনুদ্দিন’।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরের বায়েজিদ থানা ছাত্রলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক মাইনুদ্দীন আজমীর (২৬)। যদিও একসময় ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলো, হঠাৎ করে ছাত্রলীগের পদ পেয়ে যান আজমীর। ছাত্রদলের মিছিলে অংশগ্রহণের ছবিও ভাইরাল হয়েছে তার। আজমীরের বিরুদ্ধে বায়েজিদ থানায় চাঁদা দাবি, হত্যাচেষ্টা ও অপহরণের অভিযোগে একাধিক মামলা রয়েছে।
সুত্রমতে, পুলিশের সাথে সুসম্পর্ক রেখে চলা এসব কিশোর গ্যাং সদস্যদের বিরুদ্ধে থানা সহজে কোন ব্যবস্থা নেয় না। আজমীরকে বেশ কয়েকদফা পুলিশ আটক করলেও থানা থেকেই নিরাপদ বের হয়ে যেতে সক্ষম হয় সে।
আজমীরসহ তিনজনের বিরুদ্ধে চাঁদার দাবিতে বাড়িতে হামলার অভিযোগে বায়েজিদ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন জান্নাতুল ফেরদৌস নামের একজন ভুক্তভোগী।গত ৩০ আগস্ট বায়েজিদ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হলেও র্যাবের হাতে আটক হবার আগ পর্যন্ত পুলিশের শেল্টারে এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন আজমীর।
অনুসন্ধানে জানা যায় নগরের পূর্ব নাসিরাবাদ, সিএন্ডবি কলোনী, আলফালাহ গলির আশপাশে রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের ছত্রছায়ায় বিস্তৃত হচ্ছে এমন অপরাধচক্র। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন গ্যাং।নগরীর ১৬ থানা জুড়ে ৫০টির বেশি কিশোর গ্যাং গ্রুপে অন্তত ৩ হাজার কিশোর সক্রিয়। এলাকার মাদক বেচা-কেনা, জমি দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, ফুটপাতে হকার বাণিজ্য, মারামারি, ইভটিজিংসহ নানা অপরাধে সক্রিয় এসব কিশোর গ্যাং সদস্যরা। কথিত বড় ভাইদের মদদে চলছে তাদের ভয়ানক সব কর্মকাণ্ড।
জিইসির মোড়, বাটারগলি, ভুঁইয়া গলি ও ষোলশহর এলাকার বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ক্ষমতাসীন দলের একজন কাউন্সিলরের ছত্রছায়ায় থেকে নানা অপকর্ম করে বেড়ায় সোলাইমান বাদশা, ফিরোজ, তানভীর ইমন । জিইসির মোড় এলাকা থেকে ষোলশহর পর্যন্ত ফুটপাতে চাঁদাবাজি করে সোলাইমান বাদশা, মঈনুদ্দিন আজমীর, ইমনের নেতৃত্বধীন কিশোর গ্যাং । জিইসি ও ষোলশহর থেকে অক্সিজেনগামী টেম্পো থেকেও নিয়মিত চাঁদা নেয় এই তিনটি গ্রুপ। ফিনলে শপিং সেন্টারের গলিতে থাকা প্রায় ৪০টি ভ্যান থেকে দৈনিক ১১৫ টাকা করে মাসে প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার টাকা চাঁদা তুলে সোলাইমান ও তানভীর ইমন।
সুত্রমতে, ষোলশহর স্টেশন, তুলাতুলি, সিগনাল এলাকা, বাটা গলি,ভুঁইয়া গলি, আল ফালাহ গলি, মেয়র গলিসহ আশপাশ এলাকায় মাদক ব্যবসা, ছিনতাই, চাদাঁবাজি, দখল বেদখল, অপহরণ, অবৈধ গেস্ট হাউস, অস্ত্র ব্যবসা, ভাড়াটে খুন করাসহ সব কিছুতেই তার গ্রুপের কেউ না কেউ জড়িত থাকে। ভয়ে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খোলে না। নাসিরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে ফ্লাইওভারের নিচে সোলাইমানের একটি নার্সারিও রয়েছে। নার্সারি সংলগ্ন একটি কক্ষও তৈরি করে, সেখানে লোকজনকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে এমন অভিযোগও রয়েছে সোলেমানের বিরুদ্ধে।
ব্যবসায়ী ও ভাসমান হকারার জানান, চাঁদা তুলতে সোলাইমান বাদশার নিজস্ব গ্রুপ রয়েছে। যেমন- রবিউল হোসেন তুহীন, তানভীর মুশফিক ইমন, ইসমাইল হোসেন, তৌহিদুল ইসলাম, মিঠু, ইয়াছিন ভুঁইয়া, কালা শামীম, ফারুক ও আসিফসহ আরো বেশ কয়েকজন রয়েছে যারা সোলাইমান বাদশার হয়ে ফুটপাত থেকে চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম করে বেড়ায়। তানভীর ইমন (শান্তিধারা আবাসিক ) ও ইয়াছিন জিইসি থেকে সানমার পর্যন্ত ফুটপাতে চাঁদা তুলে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি নগরের চকবাজার এলাকায় দুই কিশোর গ্যাং গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে পাঁচজন আহত হন। এ ঘটনায় আহত জিকু নাথের মা অঞ্জনা রানী নাথ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় কিশোর গ্যাংয়ের ১৩ সদস্যকে আসামি করা হয়। কাউকেই আইনের আওতায় আনতে পারে নি পুলিশ।
স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশের নিরবতার সুযোগ নিয়ে ফুটপাত দখল, চাঁদাবাজি, জুয়া বোর্ড, মাদকের ব্যবসা করছেন চকবাজারের চিহিৃত কিশোর গ্যাংগুলো। চকবাজার কাঁচাবাজার, ডিসি রোর্ড, কলেজ রোড়ে ভ্যানগাড়ি থেকে চাঁদা আদায়ে আধিপত্য বিস্তার করতে চলতি মাসেই অন্তত ছয়দফা সংঘর্ষে জড়িয়েছে তারা। চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিশেষ আস্থাভাজন এসব কিশোর গ্যাং এর দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজার এলাকার আলোচিত কিশোর গ্যাং লিডার ও উঠতি সন্ত্রাসী অন্তু বড়ুয়াকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিলো ২০২০ সালের শেষ দিকে। অন্তু বড়ুয়া চকবাজার বড়ুয়া পাড়ার দীপক বডুয়ার ছেলে। গেল তিন বছরে পুলিশের শেল্টারেই বিস্তৃত হয়েছে অন্তু বড়ুয়ার সাম্রাজ্য।
এর আগে গত ৬ ফেব্রুয়ারি নগরীর চান্দগাঁও থানাধীন কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায় চাঁদা না দেওয়ায় কিশোর গ্যাং সদস্যদের ছুরিকাঘাতে আজমির হোসেন নামে এক সিএনজি অটোরিকশা চালক আহত হন। এ ঘটনায় আহত অটোরিকশা চালক বাদী হয়ে কিশোর গ্যাং লিডার আজাদসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলা হলেও বহাল তবিয়তে আজাদসহ অন্য আসামিরা।গত বছরের ৮ এপ্রিল নগরের কোতোয়ালি থানাধীন চেরাগী পাহাড় দৈনিক আজাদী গলিতে দুই কিশোর গ্যাং গ্রুপের মারামারিতে প্রকাশ্যে কুপিয়ে নৃশংসভাবে খুন করা হয় আসকার বিন তারেক নামে এক কিশোরকে। এ ঘটনায় নিহতের পিতা বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলার আসামিদের অধিকাংশই কিশোর।
চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাং কালচার মুলত পরিচিতি পায় ২০১৮ সালের এপ্রিলে স্কুলছাত্রী তাসফিয়া আমিন হত্যা মামলার মধ্য দিয়ে। সেসময় আবিষ্কৃত হয় ‘রিচ কিডস’ নামে একটি কিশোর গ্যাং। মামলার প্রধান অভিযুক্ত আদনান মির্জা সেই গ্রুপটির নেতৃত্বে ছিল। তাদের বড় ভাই ছিল পাঁচলাইশ এলাকার মো. ফিরোজ ওরফে ডাকাত ফিরোজ। এ মামলার এজাহারনামীয় আসামিরা কারাগারেও যায়। ছাড়া পেয়ে পুনরায় সংগঠিত হয়। বিদেশে পলাতক চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ বাহিনীর অন্যতম নিয়ন্ত্রক ‘ফিরোজ’ এর কিশোর গ্যাং।
বিশ্লেষকদের মতে, সমাজের জন্য ক্যান্সার রুপি এই গ্যাং পার্টি জালের মতো সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, যৌন হয়রানি, চাঁদাবাজি, বখাটে, খুন, ছিনতাই, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদকের চোরাচালান চালান, গুম ও খুনের মতো সব নৃশংস, হিংস্র অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন কিশোর-যুবকরা। বিষয়টি শুধু অভিভাবকের জন্যই আতঙ্ক নয় বরং কিশোর অপরাধ একটি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর মহামারি। চট্টগ্রাম শহরের অধিকাংশ এলাকা দাপিয়ে বেড়ানো এসব কিশোর গ্যাং সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি বলে মনে করছেন নগরবাসী।
এইবাংলা/ তুহিন