নিজস্ব প্রতিবেদক ::::
ডেঙ্গু রোগীদের জন্য রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তিনটি ওয়ার্ড খোলা হয়েছে। কিন্তু রোগীর চাপে স্থান সংকুলান হচ্ছে না। সব শয্যা ভরে মেঝেতেও জায়গা হচ্ছে না। দেশে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরো দুজনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে আরো ৬৬১ জন। গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনে এসব তথ্য জানা যায়। মেঝেতেও জায়গা হচ্ছে না রোগীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দশম তলার করিডর ও ওয়ার্ড কেবিন ব্লক মিলিয়ে পুরুষ ওয়ার্ড এবং সপ্তম তলার করিডর ও শিশু জেনারেল ওয়ার্ড মিলিয়ে শিশু ডেঙ্গু ওয়ার্ড। তৃতীয় তলার করোনা আইসোলেশন সেন্টার ও করিডর মিলিয়ে মহিলা ওয়ার্ড।
এই তিনটি ওয়ার্ডের কোনোটিতেই শয্যা খালি নেই। তাই বাধ্য হয়ে রোগীরা করিডরের মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছে।
গতকাল সরেজমিন হাসপাতালটিতে ঘুরে দেখা যায়, তিনটি ওয়ার্ডের কোনোটিতেই মশারি টানানো হয়নি। প্রতিটির রোগীর হাতেই ক্যানোলা। কারণ বেশির ভাগ রোগীকে স্যালাইন দিতে হচ্ছে। মশারি না থাকার বিষয়ে হাসপাতালটির পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামানের ভাষ্য, করিডরে গরম অনেক বেশি হওয়ায় রোগীরা মশারি টানাতে চায় না। তবে এ বিষয়ে রোগীদের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নির্দেশ দিয়ে আসছে।
হাসপাতালটির পুরুষ ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, ভর্তি ১৫০ রোগীর ১৪০ জনের ঠাঁই হয়েছে করিডরে। ৫৫ জন আছে মেঝেতে। তাদেরই একজন রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা আবুবক্কর সিদ্দিক। তাঁর পাশে বসে হাতপাখায় বাতাস করছেন স্ত্রী নাফিজা আক্তার। তিনি নিজেও এক মাস আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এই হাসপাতালেই ছিলেন। নাফিজা আক্তার জানান, সাত দিন ধরে তাঁর স্বামী জ্বরে ভুগছিলেন। প্রথমে তাঁরা বুঝতে পারেননি। পরীক্ষার পর যখন জানতে পারলেন তার স্বামী ডেঙ্গু আক্রান্ত, তখন রোগীর শারীরিক অবস্থার অনেক অবনতি হয়ে গেছে। প্লাটিলেট নেমে এসেছে ১৫ হাজারে।
হাসপাতালটির নারী ওয়ার্ডে ভর্তি ১৩০ জন। শিশু ওয়ার্ডে ৯১ জন। এসব রোগীর বেশির ভাগ ঢাকার মুগদা, যাত্রাবাড়ী, দনিয়া ও আশপাশের এলাকার। ঢাকার বাইরে গাজীপুর, নরসিংদী ও নোয়াখালী থেকেও রোগী এসেছে। ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান বলেন, পাঁচ থেকে সাত দিন জ্বর-ডায়রিয়া থাকার পর বেশির ভাগ রোগী হাসপাতালে আসছে। প্রথমবার আক্রান্তরা বেশির ভাগ জ্বর, মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা নিয়ে আসছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার আক্রান্ত রোগীদের উপর্সগ কিছুটা আলাদা। জ্বর নেই, তবে ব্লাড প্রেসার কমে যাচ্ছে। কারো পেটে-বুকে পানি জমে যাচ্ছে, মস্তিষ্কে তীব্র প্রদাহ হচ্ছে, কারো কারো শরীরে পানি কমে গিয়ে কিডনি কাজ করছে না।তিনি বলেন, বেশির ভাগ রোগী বুঝতে পারছে না সে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। এতে শকে থাকা রোগী বাড়ছে। তারা বাড়িতে থেকে বিভিন্ন ওষুধ খেয়েছে, চিকিৎসা নিয়েছে। পরিস্থিতি গুরুতর হলে হাসপাতালে আসছে। ফলে শেষ মুহূর্তে অনেকেই মারা যাচ্ছে।

হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা :
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মূল চিকিৎসা হলো ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট। যেসব রোগী মুখে খাবার খেতে পারছে না, তাদের দেওয়া হচ্ছে নরমাল স্যালাইন। আর যারা মুখে খাবার থেকে পারছে, তাদের দেওয়া হচ্ছে খাবার স্যালাইন। এর বাইরে জ্বর বেশি হলে প্যারাসিটামল, সঙ্গে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ। চিকিৎসকরা রোগীদের তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। মুগদা হাসপাতালের তৃতীয় তলায় ছয় দিন ধরে ভর্তি যাত্রাবাড়ীর নার্গিস আক্তার। তিনি বলেন, ‘প্লাটিলেটের মাত্রা জানতে প্রতিদিনই রক্ত পরীক্ষা করাতে হয়। কিডনি পরীক্ষা, লিভারের পরীক্ষা করাতে হচ্ছে। এভাবে এ কয় দিনে আমার প্রায় ১০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে।’
গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি :
দেশে গত এক দিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত আরো দুজনের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে ভতি হয়েছে আরো ৬৬১ জন। এ নিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১১ হাজার ১১৬ জন। এর মধ্যে মারা গেছে ৬৪ জন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে মোট দুই হাজার ১২৯ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে এক হাজার ৪৯০ জন ঢাকার এবং ঢাকা বিভাগের বাইরের ৬৩৯ জন।
ডেঙ্গু পরীক্ষাটা বিনা মূল্যে করা দরকার :
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিয়ে রোগীদের এক ধরনের অনীহা আছে। এ জন্য ডেঙ্গু পরীক্ষাটা সরকারের বিনা মূল্যে করে দেওয়া উচিত। এতে পরীক্ষায় মানুষের আগ্রহ বাড়বে। মৃত্যুও কমে আসবে। তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। মশা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে রোগী আরো অনেক বাড়বে। তবে যদি দ্রুত ডেঙ্গু শনাক্ত করা যায়, সে ক্ষেত্রে মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব।’
জ্বর হলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা :
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, যেকোনো ধরনের জ্বর হলে পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ডেঙ্গু হয়েছে বলে সন্দেহ করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে দ্রুত পরীক্ষাটি করাতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সাধারণ জ্বর মনে করে যদি সময় অতিক্রম করে, তবে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়বে।
ডেঙ্গু আক্রান্তদের ৩৫% শিশু :
দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের ৩৫ শতাংশ শিশু। চলতি বছরে ৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ৯ হাজার ৮৭১ রোগীর তথ্য পর্যলোচনা করে এ তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পর্যালোচনায় আরো দেখা গেছে, আক্রান্তদের বেশির ভাগ কর্মক্ষম ও নারী। এ ছাড়া মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৮০ শতাংশেরই হাসপাতালে ভর্তির এক থেকে তিন দিনের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে।