::: তানভীর আহমেদ :::
শেষ পর্যন্ত ক্রিকেট থেকে বিদায় সিদ্ধান্ত বের হলে তামিম ইকবালের কন্ঠে। কান্না জড়িত কন্ঠে চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলন করে ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিলেন আবেগ আপ্লুত তামিম ইকবাল।
বৃহস্পতিবার দুপুরে হোটেল টাওয়ার ইনে সাংবাদিকদের তিনি এমন সিদ্ধান্তের কথা জানান। অবশ্য সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, গতকালের ম্যাচের সাথে তার ক্রিকেট ছাড়ার সিদ্ধান্তের কোন যোগসাজশ নেই।
গতকাল প্রথম ওয়ানডেতে হারের পর সংবাদ সম্মেলনে আসেন দলের সেরা পারফরমার তাওহিদ হৃদয়। আর আজ তো বাংলাদেশ দলের অনুশীলনই নেই। সংবাদমাধ্যমের সামনেও আসার কথা নয় দলের কারও। সেই কারণে সংবাদ সম্মেলনের কথা জানাজানি হবার পর কৌতূহলের সৃস্টি হয়।
কৌতূহলজাগানিয়া এই সংবাদ সম্মেলনে ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবাল- চট্টগ্রামের ছেলে চট্টগ্রাম শহরেই ক্রিকেট ছাড়ার ঘোষণা দিলেন।এমন সিদ্ধান্ত বিসিবি বা দলের মাধ্যমে না জানিয়ে , ব্যক্তিগত উদ্যোগে জানানোর বিষয় থেকে নানামুখী আলোচনার ডালপালা মেলতে গজাতে শুরু করেছে।
চট্টগ্রামে আফগানিস্তান সিরিজ কাভার করতে আসা সাংবাদিকদের তামিম কাল গভীর রাতে খবর পাঠান, আজ দুপুর ১২টায় সংবাদ সম্মেলন করে সংবাদমাধ্যমকে কিছু বিষয়ে জানাবেন। কী বিষয়, সে ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি রহস্য রেখে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হবার অনুরোধ করেন সাংবাদিকদের।এমন রহস্যময় সংবাদ সম্মেলনের ডাক গুঞ্জনের ডালপালা ছড়াবে, সেটাই স্বাভাবিক। শেষ পর্যন্ত বড় কোন সিদ্ধান্তের আভাসই সত্যি হলো।
তার ফর্ম নিয়ে তীর্যক কথাবার্তা ও সমালোচনা বছর দুয়েক ধরেই। উত্তাল উইলোবাজির জন্য যাকে বিশ্ব একনামে চিনতো, খোলা তরবারির ন্যায় ব্যাট দিয়ে প্রতিপক্ষ বোলারদের শাসন করায় যার জুড়িমেলা ছিল ভার। দেশের সেই এক নম্বর ওপেনার তামিম ইকবাল চেনা ছন্দে ও রূপে নেই কিছু দিন ধরে।
বরাবরের মতো স্বপ্রতিভ, সাবলীল আর অনায়াসে উইকেটের চারদিকে বাহারি স্ট্রোক খেলা তামিম দিনকে দিন কেমন যেন ম্রিয়মান, আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছিলেন। ব্যাটের তেজ কমে যাওয়ায় সীমিত ওভারের ফরম্যাটে তার স্ট্রাইকরেটও গেছে কমে। তা নিয়েও অনেক সমালোচনা, কথাবার্তা চারদিকে। যার ব্যাটিং দ্যুতি মাঠে আলো ছড়িয়েছে বহুদিন, সেই টিম বাংলাদেশের অন্যতম সেরা তারকা ও ব্যাটার তামিম কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছেন ধীরে ধীরে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইনজুরি।
মাথার উপর বিশাল চাপ নিয়ে বুধবার আফগানদের মুখোমুখি হয়ে ব্যর্থ হন তামিম। সেই ফজল হক ফারুকিই তার হন্তারক। আলগা শটে কিপারের হাতে ক্যাচ জমা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় পা যেন নড়ছিলই না তামিম ইকবালের।
জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে যা বলেছেন তামিম ইকবাল
“আফগানিস্তানের বিপক্ষে গতকালের ম্যাচটিই আমার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ। এই মুহূর্ত থেকে আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানাচ্ছি। সিদ্ধান্তটি হুট করে নেওয়া নয়। অনেক দিন ধরেই আমি ভাবছিলাম। ভিন্ন ভিন্ন কারণ আছে, আমার মনে হয় না বলার দরকার আছে। পরিবারের সঙ্গে কথাও বলেছি এটা নিয়ে। আমার মনে হয়েছে এটাই ঠিক সময়। আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিচ্ছি। আমি সবাইকে ধন্যবাদ দিব।’
‘আমি সব সময় একটা কথা বলেছি যে আমি খেলেছি… (কান্নার পর থেমে গেলেন)। আমি ক্রিকেট খেলি আমার বাবার স্বপ্ন পূরণের জন্য (আবার কান্না)… (আরও কিছুক্ষণ থেমে) কাজেই আমি নিশ্চিত না আমি তাকে কতটা গর্বিত করতে পেরেছি পুরো ১৬ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। আরও অনেকেই আছে যাদের ধন্যবাদ দিতে হবে। আমার সবচেয়ে ছোট চাচা যিনি ইন্তেকাল করেছেন, আকবর খান, উনার হাত ধরেই আসলে আমার প্রথম ক্রিকেট বলের টুর্নামেন্ট খেলা। আমি তাকে ধন্যবাদ দেই।’
‘এই এমএ আজিজে তপন দা নামে একজন কোচ আছেন যার কাছে আমি ছোটবেলা থেকে… (আবার আবেগে ভেঙে পড়ে নীরব।)। যার কাছে ছোটবেলা থেকে আমি অনুশীলন করেছি। তাকে ধন্যবাদ দেই।’
‘আমি ক্যারিয়ারে যত খেলোয়াড়ের সঙ্গে খেলেছি সবাইকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। যাদের সঙ্গে অনূর্ধ্ব-১৩, ১৭ বা নাইনটিন, এইটেন,প্রিমিয়ার লিগ, জাতীয় দল যাদের সঙ্গে খেলেছি সবাইকে ধন্যবাদ দেই। বিশেষ করে জাতীয় দলে যারা আমার সতীর্থ ছিলেন তাদের সবাইকে।’
‘ক্রিকেট বোর্ড অবশ্যই (ধন্যবাদ পাবে)। তারা আমাকে সুযোগ দিয়েছেন দেশকে লম্বা সময় প্রতিনিধিত্ব করার। এবং সব অধিনায়কদের বাংলাদেশের। আসলে আমার খুব বেশি কিছু বলার নেই। একটা জিনিস বলব আমি আমার সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করেছি, আমি সেরাটা দিত চেয়েছে (আবার গলা ধরে এলো)। আমি হয়ত নট গুড এনাফ, অথবা গুড এনাফ। কিন্তু যখনই মাঠে ছিলাম আমি শতভাগ দিতে চেয়েছি। আমি অনেক কিছু বলতে চাই আসলে। আপনারা দেখছেন আমি একদম কথা বলার অবস্থায় নেই। কিন্তু আমি আশা করি আপনারা পরিস্থিতিকে সম্মান করবেন। (আবার কান্না)। এটা কথা বলার মতন সহজ পরিস্থিতি না। আমি এত বছর ধরে খেলেছি, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর সহজ না। এত অল্প সময়ের নোটিসে আপনাদের ডাকা হইছে। আমি মিডিয়ার সবাইকে ধন্যবাদ দিচ্ছি।’
‘আমি একটা অনুরোধ করব, যারা সামনে ক্রিকেট খেলবে যাদের কথা আপনারা ভালো লিখবেন, খারাপ লিখবেন যাইহোক। ক্রিকেটে যেন থাকেন। সীমার বাইরে যাবেন না। ভালো লিখলে ভাল লিখবেন, খারাপ খেললে সমালোচনা করবেন। আপনারা সবাই বুঝতে পারেন যা মাঝে মাঝে সীমা অতিক্রম হয়ে যায়। যারা ক্রিকেট খেলছে এখন এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বছর বিশ্বকাপের জন্য। আমি আশা করি আপনারা দলের সদস্যের মত থাকবেন, সমর্থন দিবেন।’
‘আমি আবারও বলি ক্রিকেট খেলা শুরু করেছি বাবার স্বপ্ন পূরণের জন্য। কতটা করতে পেরেছি জানি না। হয়ত আরও অনেককে ধন্যবাদ দেয়ার ছিল, যদি নাম ভুলে গেলে ক্ষমা চাই। আমার মা, তাকে ভুলব কি করে! আমার ভাই, আমার স্ত্রী, আমার দুই সন্তান। আমার এই ভ্রমণে তারা অনেক ভুগেছে, আবার আনন্দের সময়ও ছিল। আমি তাদের ধন্যবাদ দেই। এরচেয়ে বেশি কিছু বলার নাই। একটাই বলব আমার টপিকটা এখানেই শেষ করে দেন। ইটস এ দ্য এন্ড অন্তত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য। এটাকে নিয়ে আর বেশি গুঁতাগুঁতি (ঘাটাঘাটি) কইরেন না। আমি সব সময় বলেছি দল সব সময় যেকোনো ব্যক্তির চেয়ে বড়। দুই ম্যাচ আছে এই সিরিজের আশা করি দল জিতবে। সবাইকে ধন্যবাদ।’
এইবাংলা /হিমেল