::: নিজস্ব প্রতিবেদক :::
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে সরকারের উপর পশ্চিমা দেশগুলোর ক্রমাগত চাপে চীন কিছুটা মুখ খুললেও চুপ রয়েছে রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থানকে সমর্থন জানিয়েছে চীন। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের চাপেন বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান এখনও স্পষ্ট নয়। তার আগেই চীনের সমর্থন সংকট বাড়াবে৷ বলে বিশ্লেষণ করছেন বিশ্লেষকরা।
তবে চীন ও রাশিয়া এই চাপকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করছে। অপর দিকে ভারত মনে করে, প্রতিবেশী দেশগুলোতে নির্বাচনকে সামনে রেখে দিল্লির জাতীয় স্বার্থে প্রভাব ফেলে এমন কোনো পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কারো নেয়া উচিত নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা অনেক বেশি। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব দেশকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশে এখনো শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সেকারণে নির্বাচনসহ নানা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়াকে পাশ কাটাতে চাওয়া বিপদজনক হবে। চীনের সমর্থন জানানোর কাছাকাছি সময়ে ছয় কংগ্রেস ম্যান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিন্কেনের কাছে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতির বিষয়ে চিঠি দিয়েছেন। বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভূমিকা চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের কাছে চিঠি লেখেন দেশটির ছয়জন কংগ্রেস সদস্য। তাঁরা হলেন উইলিয়াম আর কিটিং, জেমস পি ম্যাকগভার্ন, বারবারা লি, জিম কস্টা, ডিনা টাইটাস ও জেমি রাসকিন। তাঁরা সবাই যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন দল ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য। এই চিঠি নতুন করে মাঠ প্রশাসনের উপর চাপ তৈরি করেছে।
রাশিয়া আপাতত বাংলাদেশের উপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপের বিষয়ে চুপ। যদিও রাশিয়া জাতিসংঘে ভারতের অন্যতম সেরা অংশীদার। কৌশলগত অংশীদারিত্ব রয়েছে ভারত ও রাশিয়ার। দুই দেশের মধ্যে গভীর প্রতিরক্ষা সম্পর্ক কারও অজানা নয়। ভারত এখনও রাশিয়া থেকে অস্ত্র কিনছে। S-400-র মত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তার সর্বশেষ উদাহরণ। বিশ্লেষণ, ভারত মুখ খুলেনি তাই রাশিয়াও চুপ। তবে চীন বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগকারী দেশ। দেশের বড় বড় সব প্রকল্পের কাজ করছে চীনা প্রতিষ্ঠান। তাদের বিনিয়োগ নিরাপদ করতে বর্তমান সরকারের পাশে থাকছে দেশটি। কিন্তু চীন মুখ খুললেও ক্ষমতাধর দেশ হিসেবে নিরব রাশিয়া।
চীনের বিনিয়োগ নিয়ে বিশ্লেষকদের নানামুখী বিশ্লেষণ আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিতর্কের কেন্দ্রে থাকে ভূ-কৌশলগত মেরুকরণ বা হিসাব-নিকাশ। তবে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও ঋণসহ নানা বিষয় নিয়ে চীনের সঙ্গে পশ্চিমাদের দূরত্ব রয়েছে। বাংলাদেশেও চীনের ঋণ, বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বিতর্ক ও আলোচনা রয়েছে।বলার অপেক্ষা রাখে না, বিনিয়োগ বা অর্থনৈতিক সহায়তা এমন একটি বিষয়, যা একটি দেশের উন্নয়নের চালিকা শক্তি হতে পারে, আবার তা হতে পারে লুণ্ঠনের হাতিয়ারও।
বর্তমানে সরকারি বিভিন্ন খাতে চীনের বিনিয়োগ করার কথা ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। তবে বড় ও মাঝারি পর্যায়ে বিনিয়োগ হয়েছে ২০০ কোটি ডলার। অপরদিকে বাংলাদেশকে ৯৭ শতাংশ পর্যন্ত শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে চীন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংকট ঘনীভুত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে চীনের বাংলাদেশে শীর্ষ বিদেশি বিনিয়োগকারী হতে চাওয়া । আগামী পাঁচ বছরেই লক্ষ্য অর্জনের পরিকল্পনা দেশটির। চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন জানিয়েছেন, চীন বছরে বিনিয়োগ করবে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আইসিটি, সবুজ জ্বালানি, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, উচ্চমূল্যের পোশাক উৎপাদন ও পোশাক শিল্পের কাঁচামাল এবং যন্ত্রপাতি উৎপাদনে আগ্রহী চীন।
তবে অর্থনীতির সংকট কাটাতে চীনের এমন ইচ্ছা কতখানি কার্যকর ভুমিকা রাখতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণে বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যার মধ্যে ২৪ বিলিয়ন ডলার চীনের অনকূলে। আর গত অর্থবছরের চীনের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল মাত্র ৬৮ কোটি ৩৪ লাখ ডলার।
সমালোচকদের কেউ কেউ চীনের ঋনকে ফাঁদ হিসেবে দেখছেন। একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঋণদাতা দেশ হিসেবে জাপানের নাম উঠে আসলেও চীনও পিছিয়ে নেই। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ চীনা ঋণে। তবে ঋণ প্রদানে এই দুই দেশ এগিয়ে থাকলেও সরাসরি বিনিয়োগে পিছিয়ে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব দেশকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশে এখনো শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।বাংলাদেশে ৪১০ কোটি টাকার প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের, যা মোট বিনিয়োগের ১৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ। আর বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র চীনের বিনিয়োগ ১৩৪ কোটি ডলার। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ চীনের তিনগুণ।
বাংলাদেশের নির্বাচনে সব দলের অংশ গ্রহন, মুক্তমত, মানবাধিকার, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর চাপকে পাত্তা দিচ্ছে না সরকার। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রমানমন্ত্রীকে চীনের সমর্থন দেশের বৈদেশিক সম্পর্কে ভিন্নমাত্রা যোগ করতে পারে। অবশ্য বাংলাদেশে বিদেশিদের যে বিনিয়োগ তা সমকক্ষ দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। বাংলাদেশের প্রতিযোগী রাষ্ট্র ভিয়েতনামে ২০২২ সালে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল রেকর্ড ২৭ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। গত ৩০ বছরে দেশটিতে গড়ে ৭ বিলিয়নের বেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ এসেছে। অপরদিকে, ২০২২ সালে বাংলাদেশে বিনিয়োগ এসেছে ৩ দশমিক ৩৪ বিলিয়নের সামান্য বেশি।
এইবাংলা/ তুহিন