25.3 C
Dhaka
Thursday, October 2, 2025

কক্সবাজার ছাত্রলীগের ‘সাধারণ সম্পাদক’ মুকুটে শত কোটি টাকা

আরও পড়ুন

::: বিশেষ প্রতিনিধি ::: 

ইয়াবা অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে সারা দেশে পরিচিতি পাওয়া কক্সবাজার জেলায় ছাত্রলীগের পদপদবী যেন ‘ সোনার ডিম পারা হাঁস’। একারণে উঠতি বয়সী তরুনদের বড় অংশই টাকা বিনিময়ে পদ পদবি কিনে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছেন। এমনই একজন কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মারুফ আদনান। জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ তাকে বানিয়েছে শত কোটি টাকার মালিক।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মারুফ আদনান নেতৃত্বে আসার পর থেকে জমি দখল, মাদব বাণিজ্যে মোড়লগিরি করে অন্তত শত কোটি টাকা উপার্জন করেছেন। কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মারুফ আদনানের বিরুদ্ধে বিরোধপূর্ণ জমি দখলচেষ্টার অভিযোগও গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে।

তার ছত্রছায়ায় অসংখ্য যুবক জড়িয়েছেন মাদক পাচারে। ইয়াবা বাণিজ্য ও ভয়ংকর মাদক আইস ব্যবসা নিয়ন্ত্রন তাকে অস্বাভাবিক আর্থিক সাফল্য এনে দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন রাতারাতি আংগুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন জেলা ছাত্রলীগের এই নেতা।

জানা যায় কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সদ্য বিদায়ী কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল হক মুকুলের পুত্র জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মারুফ, আদনান। তিনি ছাত্রলীগের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই এমন কোন অপকর্ম নাই যাতে তার সংশ্লিষ্টতা নেই। বিভিন্ন আবাসিক হোটেলের অবৈধ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, জমির দখল, টেন্ডারবাজি, মাদক বাণিজ্য করে হাত পাকিয়েছেন মারুফ আদনান।

অভিযোগ রয়েছে উখিয়ার চিহিৃত মাদক ব্যবসায়ী, এজাহারভুক্ত দাগী আসামীকে ছাত্রলীগের আহবায়কের পদে বসিয়ে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করে আসছেন আদনান। খোঁজ নিয়ে জানা যায় মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চিহিৃত মাদক ব্যবসায়ী, ইয়াবা কারবারী পরিবারের সন্তান সালাউদ্দিনকে উখিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম, আহবায়কের পদে বসিয়েছেন আদনান।
আরেক ইয়াবা কারবারী আবদুস ছালাম প্রকাশ ইয়াবা সালামকে ছাত্রলীগে অর্ন্তভুক্ত করেছেন ইয়াবা ব্যবসা পরিচালনর স্বার্থে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্রলীগ নেতা জানিয়েছেন ছালাম শুধু ইয়াবা ব্যবসায়ীই নয় ; রহিঙ্গা সুন্দরী নারীদের সাপ্লায়ার হিসেবেও খ্যাতি আছে তার। মারুফ আদনানকে চাহিদা মোতাবেক নারী সরবরাহের কাজ সুনিপুণ হাতে পালন করেছেন এই ছালাম।

মারুফ আদনানের দখল সাম্রাজ্য :

গত বছরের ১৫ জুন কক্সবাজার শহরের প্রধান বানিজ্যকেন্দ্র কস্তরঘাট এলাকায় বাঁকখালী নদী তীর দখল করার অভিযোগ আছে আদনানের বিরুদ্ধে। উপকুলীয় প্যারাবন উজার করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা, বনের গাছ কাটার অভিযোগে ছাত্রলীগ নেতা মারুফ আদনানসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলো পরিবেশ অধিদপ্তর। অভিযোগে সত্যতা পাবার পর পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মাহবুবুল ইসলাম মামলাটি দায়ের করেন ।

মামলার নথি অনুযায়ী, কক্সবাজার শহরের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র কস্তরাঘাট এলাকা সংলগ্ন বাঁকখালী নদীর তীর দখলে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি৷ উপকূলীয় প্যারাবন উজাড় করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করার সত্যতা মেলেছে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে।

কক্সবাজারের এই ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে হোটেল ওয়াল্ডবীচ রিসোর্ট দখলের অভিযোগ রয়েছে। গেলো ২১ এপ্রিল ছাত্রলীগ নেতা মারুফ আদনানসহ সশস্ত্র সন্তাসী বাহিনী হোটেলে কর্মরত ম্যানেজারসহ ষ্টাফদের উপর হামলা চালায়,তাদের প্রাণে মারার হুমকি দেয়।হোটেলের সব কর্মচারীদের বের করে দিয়ে আদনান বাহিনী পুরা হোটেল দখল নেয়। এ ব্যাপারে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় গত দুই দিন পরে মামলা দায়ের করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী আবদুল্লাহ। (মামলা নং-৪১৮৪, ৩, /১)। পরে অবশ্য প্রভাবশালী মহলের তদবীবের ফলে ছাত্রলীগ নেতা মারুফ আদনানকে বাদ দিয়ে ১১ জনকে এজাহার নামীয় এবং অজ্ঞাত ১৫-২০ জনকে আসামী দেখানো হয়।

এদিকে, দখল করা সেই ওয়ার্ল্ড বিচ রিসোর্টের কফি শপের মালিক মো. ইসমাইলও সদর থানায় লুটপাট ও দখলের অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। থানায় জমা দেয়া লিখিত অভিযোগে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মারুফ আদনান, ধর্ষণ মামলার আসামি আশিক, একাধিক মামলার আসামি সোহাগসহ ৯ জনকে আসামি করেন তিনি। ইসমাঈলের জমা দেয়া সেই এজাহারে এক নম্বরে রাখা হয়েছিলো মারফ আদনানকে। অভিযোগপত্র অনুযায়ী  বেশ কয়েক দিন ধরে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে আসছিলেন অভিযুক্তরা। ২১ এপ্রিল মারুফ আদনানসহ ২০-৩০ সন্ত্রাসী কফি শপে ঢুকে মারধর, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় এবং কফি শপ দখলে নেয়। এ সময় ড্রয়ারে থাকা নগদ ২ লাখ ৩০ হাজার টাকাও ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এ ছাড়া ১০-১২ লাখ টাকার মালামাল ক্ষতি করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন ক্ষতিগ্রস্ত এই ব্যবসায়ী।

এদিকে,  কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মারুফ আদনানের বিরুদ্ধে দখলবাজির অভিযোগ করে গত ২৫ এপ্রিল বিকেলে তার  ছবি সম্মিলিত ব্যানার নিয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছে হোটেল মালিক ও কর্মচারীরা। কিন্তু কোন ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।

প্রতিবেদককে কফি শপের মালিক ইসমাইল জানান’ দখল ও ভাঙচুরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও শহরের একাধিক চিহ্নিত আসামি নেতৃত্ব দিলেও পুলিশ মামলা নিচ্ছে না।’

সুত্রমতে, দায়েরকৃত মামলাটির ৮নং আসামী নাজনীন আক্তার পুস্পা। এই পুস্পার, সাথে মারুফ আদনানের অবৈধ সর্ম্পকের কারনেই তার গাড়ী নিয়ে হোটেলটি দখল মিশনে যায় তার অনুসারীরা। মামলার ৭নং আসামী জিসান।

ভুক্তভোগী নাছির উদ্দীন চৌধুরী কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মারুফ আদনান ও তাঁর বাবা জেলা আওয়ামী লীগের সদ্য বিদায়ী কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল হক মুকুলের বিরুদ্ধে জমি দখল ও হত্যা চেষ্টার অভিযোগে কক্সবাজার জেলা প্রেস ক্লাব কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি কক্সবাজার পৌরসভার বিজিবি ক্যাম্প এলাকার সিকদারপাড়া সমাজ কমিটির সভাপতি।

নাছির উদ্দিন বলেন, ‘ পূর্ব সিকদারপাড়া এলাকায় ৮০ শতক পৈতৃক জমিতে দীর্ঘদিন ধরে তিনি সপরিবারে বসবাস করে আসছেন। জায়গাটি মূলত বাড়ি, বাগান, পুকুর ও নাল শ্রেণির জমি। ৫ই ফেব্রুয়ারী দুপুর দুইটার দিকে একদল লোক নিয়ে আদনানের বাবা মুকুল জমি দখল করতে যান। ‘

এ সময় নাছির ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিয়ে পুলিশের সহযোগিতা চান। পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে দখলকারীরা পালিয়ে যায়। এরপর থেকে মুকুল ও আদনানের পক্ষে কিছু লোক তাঁকে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন নাসির।

তাঁর বোনের ছেলের কাছ থেকে ৯০ শতক জমি পাওয়ার অব, অ্যাটর্নির সংগ্রহ করে মারুফ আদনান। পরে সাত দিনের মাথায় মারুফ, তাঁর বাবা মুকুল একটি বায়না দলিল তৈরি করেন। এই ৯০ শতক জমি থেকে ২০ শতক নাল জমি বিক্রয় দেখিয়ে জমির মোট মূল্য ১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ধার্য করে তারা৷ সেখান থেকে ৭০ লাখ টাকা পান মারুফ আদনান।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভাই-বোনের ওয়ারিশ নিয়ে একাধিক মামলা চলাকালে বোনের ছেলেরা ওই জমি ছাত্রলীগ নেতা মারুফের কাছে বিক্রি করে দেয়। ৫ ফেব্রুয়ারি লোকজন নিয়ে মারুফ জমি দখল করতে গেলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দেয়। পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। সেই জমির দখল নিয়ে বড় ধরনের সংঘর্ষের আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন স্থানীয়রা। পরে পৃথক সংবাদ সম্মেলনে উভয়পক্ষ নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে।

জানতে চাইলে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, উভয়পক্ষকে আদালতের রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে কেউ বিশৃঙ্খলা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ‘

অনুসন্ধানে জানা যায়, কক্সবাজারে মাদক ব্যবসায় জড়িত ছাত্রলীগের নেতাদের মধ্যে নয়জন ছাত্রলীগের জেলা কমিটির নেতা, দুজন উপজেলার নেতা, একজন সাবেক হলেও বর্তমানে যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা।

ইয়াবা পরিবারের সখ্যতা  :

আব্দু সালাম,  সালা উদ্দিন, সেলিম উদ্দিন, ওসমান জয়  কালু এই চার সহোদর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মারুফ আদনানের ছত্রছায়ায় ইয়াবা বাণিজ্য করছেন। এরমধ্যে আব্দু ছালাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী। কুমিল্লার চান্দিনায় ইয়াবাসহ গ্রেফতারও হয়েছেন। করা হয়েছিলো মামলাও ( এফআইআর কুমিল্লা চান্দিনা ১৮/৩২১)। উখিয়া থানায় তার বিরুদ্ধে আরও দুটি মামল্ রয়েছে (২০/২০০৯) ( ৯/২০০৯)।  তার ভাই সেলিম উদ্দিনের বিরুদ্ধেও ধর্ষণ,মাদক পাচারের বেশ কটি  মামলা আছে। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী। অপর ভাই আল বয়ান ইনিস্টিউটের শিবিরের নেতা ছিলেন। বর্তমানে আদনানের ছত্রছায়ায় থেকে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তার বিরুদ্ধেও হত্যা চেষ্টা মামলা রয়েছে৷ আরেকভাই ওসমান জয়ের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা, চাঁদাবাজি তিনটি মামলা রয়েছে।

এইবাংলা / হিমেল

- Advertisement -spot_img

সবশেষ খবর