::: রাহাত আহমেদ :::
আশির দশকে দেশে আওয়ামী রাজনীতির উত্তাল সময়ে যারা স্বৈরচার এরশার বিরোধী আন্দোলনের ভিত তৈরি করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন তাদের অন্যতম এ কে এম তারিকুল হায়দার চৌধুরী। স্বৈরাচার এরশাদের পতন হলেও ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর দেশ ছেড়ে আমেরিকায় পালিয়ে যেতে হয়েছে দুই ডজন মামলা কাঁধে নিয়ে। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যুবলীগের হাল ধরেন তারিকুল হায়দার চৌধুরী । যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী যুবলীগের আহবায়ক হবার পর থেকে তেরটি স্টেটে শক্তিশালী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন।
তারিকুল হায়দার চৌধুরী সাথে ছাত্রলীগের সস্পৃক্ততা শৈশব থেকে। তারিকের ভাই এহসানুল হায়দার চৌধুরী বর্তমানে রাউজান উপজেলা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। নিজের পিতা একেএম হায়দার মিয়া চৌধুরীও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। জানালেন ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকান্ড কিভাবে পুরো পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বাড়ি থেকে জহুর আহমেদ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী এহসানুল হায়দার চৌধুরীকে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যায় প্রশাসন। নিখোঁজ বড় ভাই এহসানুল হায়দার চৌধুরী বাবুলের হদিস মেলেনি অন্তত আটমাস। দীর্ঘদিন কোন খোঁজ খবর না পাবার কারণে পরিবারের সদস্যরাও মনে করেছিলেন মেরে ফেলা হয়েছে তাকে।
তারিকুল হায়দার চৌধুরী ভাষ্যমতে, ‘ আমরা ছোট ছিলাম। বড়ভাইকে তুলে নিয়ে যাবার পর ফিরে পাবার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। এমনকি আমার বাবা বাবুল ভাইকে জীবিত ফেরত পাবার আশা ছেড়ে দিয়ে তার চল্লিশা সম্পন্ন করে ফেলেছিলেন । দীর্ঘ আটমাস বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে নির্যাতনের পর এক সময় তিনি আমাদের অবাক করে জীবিত ফিরেছিলেন। ‘
বাবার ইচ্চায় তারিকুল হায়দার চৌধুরী চট্টগ্রামের বায়তুশ শরফ মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখান থেকে দাখিল পরীক্ষায় অংশ নেয়ার আগেই ছাত্রলীগ করার অপরাধে বহিষ্কার করা হয় তাকে। পরে নিজের গ্রামে গহিরা মাদ্রাসা থেকে দাখিল পরীক্ষায় অংশ অংশ নিয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন প্রথম শ্রেণীতে পাস করে। জানালেন মাদ্রাসা জীবনে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাথেই গড়ে উঠে তার যৌবনের ভালোবাসা। মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে দাখিল পাস করার পর চট্টগ্রামের ওমরগণি এমইএস কলেজে ভর্তি হন উচ্চ মাধ্যমিকে। সেখানেও প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে। দলছুট ডানপিটে তরুন হিসেবে এমইএস কলেজ ছাত্র সংসদের এজিএস নির্বাচিত হন। তখন ছাত্রদলের একছত্র আধিপত্য ছিলো কলেজটিতে। কলেজ ছাত্রলীগের সহ সভাপতি হিসেবে তারিকুল হায়দার চৌধুরী এমইএস কলেজে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। তারিকুল হায়দার চৌধুরী জানালেন, ওমর গণি এমইএস কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি তখন মামুনুর রশিদ মামুন। আশির দশক থেকে চট্টগ্রামের প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্নেহধন্য তারিকুল হায়দার চৌধুরী চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের ইতিহাসে নির্ভীক এক তরুনের নাম। চট্টগ্রামে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের বীর সেনানী।

এরশাদ ক্ষমতা নিয়ে ‘মার্শাল ল’ জারি করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল কেউ সামরিক শাসন বিরোধী মনোভাব পোষণ করলে ৭ বছর, আকারে-ইঙ্গিতে প্রকাশ করলে ১৪ বছর এবং গোপনে-প্রকাশ্যে কর্মকাণ্ড চালালে মৃত্যুদণ্ড হবে।
আলাপচারিতায় তারিকুল হায়দার চৌধুরী জানালেন স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে গ্রেফতার হয়ে পুলিশের নির্মম নির্যাতনের স্মৃতি। নেতা মহিউদ্দিনের নির্দেশে চট্টগ্রামে ‘ লাল বাস ঠেকাও ‘ আন্দোলন এবং আউটার স্টেডিয়ামে কর্ণেল ফারুকের সমাবেশ ঠেকাও’ কর্মসূচিতে জীবনের ঝুঁকি নেয়া দুর্ধর্ষ দুই তরুন তারিক ও মনি। দুইজনই যাত্রীবাহী বাসে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানোর পর চট্টগ্রামের দামপাড়া এলাকা থেকে পুলিশ ও এরশাদ সমর্থকদের হাতে ধরা পড়েন।
তারিকুল হায়দার চৌধুরীর ভাষ্যমতে, দিনটা ছিলো ১৯৮৭ সালের ৭ই নভেম্বর।
বাসে বিষ্ফোরণের পরপরই তৎকালীন পুলিশ কমিশনার রকিবুল হুদার নির্দেশে মোহাম্মদ আলী রোড় থেকে শুরু করে ওয়াসা পর্যন্ত পুরো এলাকা কর্ডন করে ফেলে পুলিশ। পুলিশ ও উৎসুক জনতার ধাওয়া খেয়ে দামপাড়া গলির ভেতর দিয়ে দুজন পালানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন।
‘ আমি এবং মনি -দুইজন গ্রেফতার এড়াতে দৌড়াচ্ছি। পেছন পেছন মানুষ, সাথে পুলিশও। আমাদের টার্গেট ছিলো গলির দেয়াল আর খাল টপকে কোনভাবে জহুর আহমেদ চৌধুরীর বাসায় যদি ডুকা যায়। কিন্তু উৎস্যুক মানুষের দৌড়ানি খেয়ে মাঝপথে মনি রাস্তায় পড়ে যায়। তখন আমি থেমে তাকে তুলি। পুলিশ খানিকটা পেছনে ছিলো, আমরা গলির ভেতরে। মানুষের রোষানল থেকে কোনভাবে মনিকে ছাড়িয়ে আবার দৌড় শুরু করি। আমরা উচু উচু সীমানা দেয়াল টপকে কোনভাবে পালানোর চেষ্টা করছিলাম। ইতিমধ্যে আবারও রাস্তায় পড়ে যায় মনি৷ ধরা পড়ে পুলিশের হাতে। আমি তাকে রেখেই আরেকটি দেয়াল পালানোর চেষ্টা করি। গিয়ে পড়লাম আরেক বস্তিতে। সেখানে বাড়ির মহিলারা আমাকে দেখে ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করা শুরু করলে পেছনে থাকা মানুষজন আমাকে ধরার জন্য এগুতে থাকে। সেমিপাকা সেই বাড়ি আজও চোখে ভাসে। ভেতর থেকে বটি হাতে তেড়ে আসা মহিলার চিৎকারে আমি আবারও দেয়াল টপকে পালানোর আয়োজন করি। এবার গিয়ে পড়লাম খালে। সেই খালে পানির চেয়ে ময়লা আবর্জনাই ছিলো বেশে। বিভিন্ন বাড়ির আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে খাল। সেই খালে গলা পর্যন্ত আবর্জনা ডিঙিয়ে আমার আর মাহতাবউদ্দিন ভাইদের বাসা পর্যন্ত যাবার সুযোগ হলো না । একটু একটু সন্ধ্যা নেমেছে। খালের প্রান্তে ওয়ালের কাছাকাছি আসতে পুলিশের টর্চ আমার উপর। সাথে আমার দিকে তাক করা পুলিশের বন্দুক। ধরা দিতেই হলো। ধরা পড়ার পর বেদম পিটুনিতে আমি হুঁস হারাই। হুস ফিরেছে পুলিশের ভ্যানে। সেই ভ্যানে আমাকে পাঁজাকোলা করে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হলো আমাকে। একই ভ্যানে রাখা ছিলো আগে থেকে ধরা পড়া ‘মনি ‘। তাকেও বেদম পিটুনি দেয়া হয়েছে ; বেচারা কথাই বলতে পারছে না। গাঁয়ে আমাদের শার্ট গেন্জি কিছুই নেই। পালানোর দৌঁড়ে দুজনের জুতাও উদাও৷ ‘
এভাবেই কথা হচ্ছে এ কে এম তারিকুল হায়দার চৌধুরী সাথে । স্মৃতির খেরোখাতা খুলে বলা শুরু করেছেন সেদিন আটক হবার পরের গল্পো।
১৯৮৭ সালের ৭ই নভেম্বর রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার ডাকে সারাদেশে ৭২ ঘণ্টা অবরোধ ডাক দেয়া হয়। চট্টগ্রাম শহরে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। একদিকে পুলিশ অন্যদিকে এরশাদের ভাড়াটে গুন্ডা। সেই আন্দোলনের আগুনে পুড়ে পুড়ে ছাত্রনেতা তারিকুল হায়দার চৌধুরীর উত্থান। পরবর্তীতে অবরোধের আন্দোলনে বাঁকে মহিউদ্দিন চৌধুরীর নির্দেশে লাল বাসে পিকেটিং করতে গিয়ে তারিক চৌধুরী এবং মনি গ্রেফতার হন ১৯৮৭ সালের ৮ ডিসেম্বর।
তারিকুল হায়দার চৌধুরীর ভাষ্যমতে, তৎকালীন রকিবুল হুদা নির্দেশে আমাদের দুইজনকে তিনদিন তিনরাত লালদীঘির পাহাড়ে এসবি অফিসে নিয়ে অনেক শারীরিক নির্যাতন করা হয়। ওখানে গুদামের মতো একটা বড় ঘর ছিলো। সেই ঘরের দুই দিকের দুই দেয়ালে আমরা দুজন। ঘরের ছাদ থেকে দড়ি ঝোলানো আছে বেশ কিছু। দেয়ালে শুধু ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। প্রথম রাতে আমাদের দুইজনকে বেদড়ক মারা হয়। সকালে নতুন দুই কর্মকর্তা এসে আবার শুরু করে মারধর। মার খেয়ে মনি বেহুশ, আমি আধমরা। ওরা আমাদের কাছে কয়টা অস্ত্র আছে, ককটেল কে বানায় – এসব জানতে ক্রমাগত শারীরিক মানসিক নির্যাতন শুরু করে। জিজ্ঞেসাবাদের সময় পুলিশ কর্মকর্তা সিগারেটের আগুন দিয়ে আমাদের শরীর পুড়িয়ে দেয়। বুটের লাথিতে অন্তত তিনবার বেহুশ হয় মনি। আমার অবস্থাও শোচনীয়।
এরপর সেখান থেকে কোতোয়ালী থানায় নেয়া হয়। ধারাবাহিক মারধরের কারণে আমাদের দুইজনের কারো হাঁটার অবস্থা নেই। কোর্টে চালান দেবার পর অস্ত্র ও বিষ্ফোরক আইনে ডিটেনশন দিয়ে জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়। সেইবার আমার মা যখন কোর্টে আমাকে দেখতে আসেন, আমার অবস্থা দেখে তিনি কোট বিল্ডিং এ বেহুশ হয়ে যান। কোর্ট হাজতে পুলিশকে কিছু টাকা দিয়ে বাড়তি সুবিধা নেবার ব্যবস্থা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কলেজ থেকে মিছিল নিয়ে কোর্ট চত্বরে আমাদের মুক্তির দাবি জানানো হচ্ছে। বাড়তি সুবিধা হিসেবে কোর্ট হাজতরুম থেকে অন্য একটা রুমে আমাদের নিয়ে হাতের বাঁধন খুলে দেয়া হয়, খাবার পাঠানো হয়। মায়ের সামনে তিনদিন পর খাবার খেয়েছি। কারাগারের ছয়মাসেই মায়ের হার্ট ডিজিজ হয় আমার দুশ্চিন্তায়। ধীরে ধীরে আমার চিন্তায় চিন্তায় মৃত্যুবরণ করেছেন তিনি। সেইবার প্রথমে আমাদের একমাসের ডিটেনশন দেয়। পরবর্তীতে দুই মাস ডিটেনশন ; তারপর আরও তিন মাস – মোট ছয় মাসের ডিটেনশন। শুরুতে আমি ও মনি দুজনের শরীর হিম হয়ে গিয়েছিল ভয় আর নির্যাতনে। এরপরের জীবন তো কারাগারে। কারাগারে তখন বন্দি সাবেক মেয়র আ জ ম নাসির উদ্দীন, মনোয়ার হোসেন ( ছাত্র ইউনিয়নের)। নাসির ভাই সম্পর্কে আমার খালাতো ভাই। কারাগারে সিনিয়র যারা ছিলো তারা খুব আপসোস করতো আমার জন্য। কারণ তখন সামরিক আইন অনুযায়ী পনের বছরের জেল অবধারিত আমাদের দুইজনের। ১৯৮৮ সালের ২৪ শে জানুয়ারির গণহত্যার খবর মেলে কারাগারে। আমি, মনি, নাসির ভাই – জেলের ভেতর। ‘

মামলার নথি অনুযায়ী ১৯৭৪ সালের ৮ ধারার ২ এবং ৩(১) উপধারা অনুযায়ী তারিকুল হায়দার চৌধুরীকে আটকাদেশ দেয়া হয়েছিলো। সরকার বিরোধী আন্দোলনের একজন ভয়ানক ও দুর্ধর্ষ রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে চিহৃিত করা হয় তারিকুল হায়দার চৌধুরীকে। অভিযোগ আনা হয় সরকার বিরোধী আন্দোলনে ককটেল, বোমা, বিস্ফোরক সরবরাহ করে সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য পালনে বিঘ্ন সৃস্টির পাশাপাশি জনসাধারণের জানমালের ক্ষতিসাধনের।
মুক্তিযুদ্ধের শেকড় :::
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের তৃনমুলের কর্মী তারিকুল হায়দার চৌধুরী পুরোদস্তুর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। দেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয়া মেজ ভাই এহসানুল হায়দার চৌধুরী বাবুল – মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদই গ্রহন করেন নি। আপন ফুফা শেখ ম. আলমগীর ও তার বাবা মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী দুজনই শহীদ হয়েছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধে। যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার অন্যতম স্বাক্ষী শহীদ শেখ আলমগীরের স্ত্রী। ওই মামলায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাজা হয়েছিল।তারিকুল হায়দার চৌধুরীর ছোট ফুফুর শ্বশুর শেখ মোজাফফর আহমদ ছিলেন স্বদেশপ্রেম ও স্বদেশচেতনায় ভরপুর এক অনন্য পুরুষ। মুক্তিযুদ্ধের প্রাণ দেয়া চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শেখ মোজাফফর আহমদ ছিলেন নানা গুনে গুণান্বিত।
প্রাসঙ্গিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ, আওয়ামী লীগের পাশাপাশি মোজাফফর আহমেদ চৌধুরীর দিকে এগুতে থাকে তারিকুল হায়দার চৌধুরীর কথপোকথন।
তিনি এক প্রতিভাধর মানুষের উপমা। নানা দিকে বিকশিত হয়েছে তার প্রতিভা। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সাহিত্যিকও ছিলেন, ছিলেন বনেদি ব্যবসায়ী । শেখ মোজাফফর আহমদ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরন করেছেন। লিখেছেন গল্প, উপন্যাস, কবিতা, গজল, হামদ, নাত ও নাটক।‘ছিন্নবানী’ নামে উপন্যাস ও ‘বাঙলার পতন’ নামে নাটক তার উল্লেখযোগ্য সৃস্টি। ‘বাঙলার পতন’ নামক নাটকটির জন্য তিনি রাজরোষে পড়েছিলেন । ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী সরকার স্বাধীনতার চেতনায় রচিত নাটকটিকে বাজেয়াপ্ত করে। ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত নাটকটির সরকারি নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে। সে বছর হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দি প্রধানমন্ত্রী হলে নাটকটির উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী শেখ মোজাফফর আহমদ লেখাপড়া অসম্পূর্ণ রেখে ১৯২৭ সালে ১৯ বছর বয়সে যোগ দেন চট্টগ্রাম বন্দরে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের জেটিতে। দুই বছর পরে স্বাধীনতাচেতা এই বীরমুক্তি সৈনিক ১৯২৯ সালে সামরিক শিক্ষা গ্রহন করেন কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামের টেরিটোরিয়াল ফোর্সের হায়দ্রাবাদ রেজিমেন্টের অধীনে। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের এগারোজন প্রতিষ্ঠাতার অন্যতম একজন ছিলেন শেখ মোজাফফর আহমদ। একইসাথে ভাষা আন্দোলনের অদম্য এক ভাষা সৈনিকের নাম ‘ মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী ‘। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেখ মোজাফফর আহমদের খুব নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ১৯৫৫ সালে তিনি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৭১ সালের ৩০ শে মার্চ, পাকিস্তানীদের হাতে চট্টগ্রাম শহরের পতন ঘটলে তার ২য় পুত্র আলমগীরকে ( তারিকুল হায়দার চৌধুরীর ফুপা) নিয়ে তিনি রাউজানের এয়াছিন নগর গ্রামে আত্মগোপন করেছিলেন। সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ ও সামরিক শক্তি সঞ্চয় করে পাকিস্তানী বাহিনীর উপর পরিকল্পিত আক্রমন রচনার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এয়াছিন নগরে তারিকুল হায়দার চৌধুরীর বাড়িতে তার অবস্থানের বিষয়টি ফাঁস হয়ে যায়।শেখ মোজাফফর আহমদ পুত্র শেখ আলমগীরকে নিয়ে রাউজান থেকে মাইজভান্ডার যাবার পথে রাজাকার সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী হাটহাজারী বাস স্টেশনে গড়া তোলা পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে তাদের তাদের ধরিয়ে দেয়। এরপর থেকে তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরেয়ে আনার জন্য মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী ব্যবসা বাণিজ্যে ব্রতি হন। আগ্রাবাদ বাদামতলির মোড়ে নিজের জায়গায় তার চার সন্তান জাহাঙ্গীর, আলমগীর (শহীদ) , খুরশিদ ও শহীদ- এদের নামের প্রথম অক্ষর নিয়ে ‘জেকস’ বেকারী চালু করেন। সহসাই ‘জেকস’ শহরের একটি রুচিশীল অভিজাত বেকারি হিসেবে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। ব্যবসায়িক সাফল্যের পাশাপাশি এই বেকারীই হয়ে উঠে রাজনীতির তীর্থক্ষেত্র। আওয়ামী লীগের দুই শীর্ষ নেতা এম এ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরী এবং অন্যান্য নেতাকর্মীদের আনাগোনায় চট্টগ্রামের এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘জেকস’ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যালয়ে রুপ নিয়েছিলো।
১৯৮৯ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে দায়ের করা বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলায় আদালত ফ্রিডম পার্টির ১১ সদস্যকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন, এ খবরটি এখন পুরোনো। কিন্তু এই খবরের সঙ্গে বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কর্ণেল ফারুকের সেই সময়কার সহযোগীদের উত্তানের উদাহরণ সাম্প্রতিক । স্বৈরচার বিরোধী আন্দোলন চলাকালীন সময়ে চট্টগ্রামের আউটার স্টেডিয়ামে কর্ণেল ফারুকের জনসভা অসীম সাহসিকতার সাথে পন্ড করে দেবার মিশন সফলকারীদের অন্যতম তারিকুল হায়দার চৌধুরী।
চট্টগ্রামে কর্ণেল ফারুকের কোন সমাবেশ হতে দেয়া যাবে না -এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর এমন নির্দেশে তারিকুল হায়দার চৌধুরীর কাছে সেই ঝুঁকি নেবার স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বল করে ভাসে। প্রস্তুতি অনুযায়ী ঠিক সমাবেশের মঞ্চে উঠার সময় প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়েন কর্ণেল ফারুক। সমাবেশস্থলে পুলিশের কড়া পাহারা ডিঙিয়ে মুহুর্মুহ কটকেল বিস্ফোরণে পন্ড করা হয় সেই সমাবেশ। বিস্ফোরণের ধোঁয়া দিকবিদিক ছুড়ে পালিয়ে যায় ফারুকের অনুসারীরা। এই ঘটনায় ফ্রিডম পার্টিসহ স্বৈরাচার এরশাদের সহযোগীদের মনোবলে ছিঁড় ধরে৷
যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে জীবনে যুদ্ধ নামেন তারিকুল হায়দার চৌধুরী। রাজনীতিতে দুরে সরে যাবার সময়টা দীর্ঘ হলোও৷ ২০০৪ সালে দলের সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা হবার পরে আবার রাজনীতিই তাকে কাছে টেনে নেয়। যুক্তরাস্ট্রে যুবলীগের রাজনীতির হাল ধরেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র যুবলীগের আহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব নেবার পর আমেরিকার তেরটি অঙ্গরাজ্য যুবলীগের কমিটি গঠন করেন।
জানা যায়, যুবলীগের শক্তিশালী ধরতে গিয়ে দলের হাইব্রিড নেতাদের তোপের মুখে পড়েছেন তারিকুল হায়দার চৌধুরী। ২০১১ সালে যুবলীগের সহ সভাপতি হন। সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে ২০১৫ সালে তারিকুল হায়দার চৌধুরীকে আহবায়ক করে ২৫ সদস্যের যুক্তরাষ্ট্র যুবলীগের আহবায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর ঘরের শত্রুই প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় তার। এতোকিছুর মাঝেও নিউইয়র্কে চারটি ব্রুরো কমিটি, একটি সিটি কমিটি, একটি স্টেট কমিটি, নিউজার্সি স্টেট কমিটি, মিসিগান স্টেট কমিটি, ডেনবার্গ, ভার্জিনিয়া, ফ্লোরিডা, ক্যালিফোর্নিয়া, পেনসিলভেনিয়া স্টেট কমিটিসহ ১৪ টি স্টেটে যুবলীগের সংগঠন গড়ে উঠেছে তারিকুল হায়দার চৌধুরীর নেতৃত্বে। দল ক্ষমতায় থাকার কারণে বিভিন্ন দল থেকে যুবলীগে ভীড় করা অনুপ্রবেশকারীদের ষড়যন্ত্রের মুখে পড়েন তিনি। রাজনীতি করে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তিনি। ছাত্রলীগ থেকে উঠে আসা তারিক ২০১৮ সালে হামলার শিকার হন সেখানে। শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রে গেলে অনুপ্রবেশকারীগের হিড়িক পড়ে সেখানে। হাইব্রিড নেতাদের উষ্কানিতে তার উপর হামলা করেছে অনুপ্রবেশকারীরা।
নিজের পরিশ্রমে ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী তারিকুল হায়দার চৌধুরী। কিন্তু যুবলীগের শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ তাকে ব্যবসায়িকভাবে পিছিয়ে দেয়। জীবনের পঁয়ত্রিশ বছর বিনিয়োগ করে যে দলের আদর্শের পেছনে ঝুঁকি নিতে গিয়ে নিজের মা’কে হারিয়েছেন , জীবন বাঁচাতে বিদেশ পাড়ি দিতে নিজের পৈতৃক জমি বিক্রি করেছেন – সেই দলের কিছু প্রতিক্রিয়াশীল নেতার কূটচালের কারণে মাঝে মাঝেই হতাশ তারিকুল হায়দার চৌধুরী ভাবেন ‘ যৌবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় বিনিয়োগ করে কি তবে ভুল করেছি ‘।
(চলবে)