::: রাকিব হোসেন মিলন, লক্ষ্মীপুর :::
আমার ঢাল নাই কুল নাইরে আমি কোথায় গিয়ে থাকবো এখন….এমন আর্তনাদ লক্ষ্মীপুর জেলার দক্ষিন উপকূলীয় অঞ্চল রামগতির আলেকজান্ডার ইউনিয়নের এক নদীভাঙ্গা গৃহহীন ফিরোজ বকসীর।কথা বলে জানা গেলো ভালো বংশ ও বনেদ ঘরের সন্তান এই ফিরোজ বকশি। নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে আজ সংসার জীবনে একছেলে ও একমেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন ফিরোজ।
নদীই বাংলাদেশের দেশের প্রাণ। আবার এ নদীই সর্বনাশ ডেকে এনেছে ফিরোজের মতো অসংখ্য মানুষের জীবনে। এ জন্যই মেঘনার আরেক নাম কীর্তিনাশা। নদী দিয়ে যে জলধারা বয়ে যায়, যাওয়ার পথে সে শুধু মাঠ ফসলে ভরিয়ে দিয়ে যায় না, অনেক সময় আশপাশের মাঠ, তীরবর্তী গ্রাম ভেঙেচুরে দেয়। তাই নদীভাঙন ফিরোজের জীবনের নীরব ঘাতক।
জলবায়ু বিশ্লেষকদের মতে, আমাদের দেশের নদীগুলো প্রায় ক্ষেত্রেই আঁকাবাঁকা। সে জন্য ভাঙনের প্রকোপও বেশি। যে জমিটুকু ভাঙে, তার কিছু অংশ নদীর অন্য পাড়ে জড়ো করে, তৈরি করে চর। তার কিছুটা থেকে যায় নদীর গর্ভে। এর ফলে নদীর পানি ধারণক্ষমতাও যায় কমে। বাকি অংশটুকু স্রোতের তোড়ে সাগরে গিয়ে পড়ে। এর ফলে মোহনায় গজিয়ে উঠে চর বা দ্বীপ। ভাঙ্গনের কারণে তীরবর্তী মানুষের জীবন উদ্বাস্তুর মতোই।
ফিরোজের মুখ থেকে জানা যায় নদীভাঙ্গনের ফলে অসহায় হয়ে তারা আর যখন থাকার আশ্রয়ের কোনো সূযোগ পাচ্ছিলেন না, তখন আশ্রয় নিয়েছেন পাশ্ববর্তী চর বাদাম এলাকার একখন্ড জমিতে। সেটিও অন্যের জমি।
বর্তমানে নিজে শারীরিক নানা জটিলতায় ভূগছেন । টাকার অভাবে চিকিৎসা নিতে পারছেন না। অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে পরিবারের আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যায়।যখন ফিরোজের সাথে কথা হচ্ছিল তখন তার চেহারায় ফুটে উঠেছে দুশ্চিন্তা আর অসহায়ত্ব । দশম শ্রেনীতে পড়ুয়া মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তার ভাজ পড়েছে অসহায় বাবা ফিরোজের কপালে।ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যে পরিবারকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন আজ নিজের অসুস্থতা আর আয় রোজগারহীনতার কারনে পুরো পরিবারের কাছেই অবহেলিত তিনি। মানুষের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে চলতে হয় তাকে।
কথায় আছে আগুনে পুড়লে অন্তত ঘর ভিটিটা থাকে কিন্তু নদী ভাঙ্গলে আর কিছুই থাকে না।এমন চিত্র রামগতি উপজেলার প্রতিটি নদী ভাঙ্গন কবলিত এলাকায়। মেঘনার ভয়াল গ্রাসে তাদের জীবন এখন বিপর্যস্ত। সাম্প্রতিক শুরু হয়েছে কালো বৈশাখীর ঝড় ও প্রতিকূল বাতাস। আবারও বেড়ে চলছে অন্তহীন নদীভাঙন। মানুষের এই আতংকের যেন শেষ নেই।লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার মেঘনা উপকূলে তীব্র ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বিদ্যালয় ভবন, বসতবাড়ি, গাছপালা, ফসলি জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
প্রবল জোয়ারে মেঘনার পানি বৃদ্ধি পেলে ভাঙন ভয়াবহ রূপ নেয়।সামনের বর্ষাকে ঘিরে তাই উপকূলীয় মানুষের দুশ্চিন্তা আরও বেড়েছে। নদী ভাঙ্গনের কারণে মানুষের ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হচ্ছে দিন দিন। সর্বহারা হচ্ছে রামগতি অঞ্চলের গ্রামীণ জনপদ।প্রতিনিয়ত ভাঙনে নদীর তীরবর্তী ওই এলাকার লক্ষাধিক মানুষ চরম আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠায় রয়েছেন।
উপকূলের মেঘনার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের ভাষ্য, এবারের ভাঙনের ভয়াবহতা বিগত সময়ের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। বিভিন্ন জরিপ থেকে জানা যায় গত ১৫ বছরে লক্ষাধিক মানুষ মেঘনার ভাঙ্গনে ভিটেমাটি হারিয়ে বাস্তুহারা হয়েছে।
আব্দুর রহিম নামে এক বৃদ্ধ জানান গত ৩০ বছরে মেঘনার ভয়াবহ ভাঙনে লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার প্রায় ১৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা বিলীন হয়েছে। চোখের সামনে নির্মমতা দেখেছে ভাঙ্গন কবলিত পরিবারের ছোট্ট শিশুরা। নিজের চোখের সামনেই প্রান প্রিয় প্রতিষ্ঠানটি নদীগর্ভে বিলিন হতে দেখে চোখে অন্ধকার দেখছেন।
এই নদীগর্ভে বিলীন হওয়া আলেকজান্ডার ইউনিয়নের চরবালুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ১৯৯৫ সালে স্থাপিত হয়। স্কুলের নতুন ভবনটি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নির্মাণ করে প্রাথমিক শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর। নদীর তীব্র জোয়ারের আঘাতে ওই এলাকার একমাত্র এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি নদীতে ভেসে যায়।
বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মফিজুল ইসলামের চোখের পানিতে এখনো স্মরন করে। স্কুল পাশ্ববর্তী এলাকাবাসী সেই স্কুলের হারিয়ে যাওয়া স্কুলের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন । গল্পে গল্পে মফিজুল ইসলামের সাথে আড্ডা হয়।তিনি জানান, নদী ভাঙ্গন কবলিত মানুষের জীবনের করুন চিত্র। জানালেন, বিদ্যালয়টিকে তিনি তিলে তিলে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।প্রথমে এটি রেজিষ্টার্ড ছিলো পরে জাতীয়করন করা হয়।মফিজুল ইসলাম চাকুরী জীবনে অবসর নিলেও এখনও ভয়াল সেই চিত্র ভুলে যান নি।
যুগের পর যুগ রামগতি অঞ্চলের মানুষের এই কষ্ট দেখার কেউ নেই বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এলাকাবাসী। তাঁদের দাবী অধিক ভাঙ্গন কবলিত এলাকাগুলোতে এ বছর বর্ষার আগে ভাগেই জিও ব্যাগ ডাম্পিং করতে না পারলে বিশাল একটি অংশ জনগোষ্ঠী বাস্তুহীন হওয়ার ভয়াবহ ঝুঁকি রয়েছে।
উল্ল্যেখ্য মেঘনার ভাঙন রোধে তিন হাজার ৮৯ কোটি ৯৬ লাখ ৯৯ হাজার টাকার একটি প্রকল্প সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন হয়েছে।এতো বড় বাজেটের কাজে যাতে অনিয়ম না হয় সেজন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন উপকূলীয় এলাকা রামগতির অবহেলিত জনগোষ্ঠী। তাঁরা বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একজন মানবিক নেত্রী ও মা সম্বোধন করে যত দ্রুত সম্ভব এই নদীর বাঁধ ও তীরের কাজ সম্পন্ন করার অনুরোধ করলেন।
সবার গল্পোই ফিরোজের মতো। ছোট্ট শিশুদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করে প্রিয় জন্মভূমি রামগতির কোল জুড়ে বসবাস করার সুযোগ চান তারা।ছোট্ট শিশুরা আর তাদের প্রানপ্রিয় স্কুল হারাতে চায় না।নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে এলাকার মানুষ আর গৃহহীন কিংবা ভূমিহীন হতে চান না।স্বাভাবিক জীবনযাপনের স্বপ্নে বিভোর মেঘনার উপকূলীয় রামগতি অঞ্চলের মানুষ।
বিভিন্ন সংস্থার হিসাব মতে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রায় ৪০ লাখ লোক নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে। সে সঙ্গে ২ হাজার বর্গকিলোমিটারেরও বেশি এলাকা বিলীন হয়েছে নদীগর্ভে। বর্তমানে প্রতিবছর নদী ভাঙনে গৃহহীন উদ্বান্তু লোকের সংখ্যা দুই থেকে আড়াই লাখ হারে বাড়ছে। এতে বছরে ৩শ’ থেকে ৫শ’ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। তবে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ হচ্ছে এক হাজার কোটি টাকার বেশি। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেডক্রস এন্ড রেড ক্রিসেন্ট সোবাইটি (আইএফআরসিএস) এর দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান বব ম্যাকরো গত ২০১৫ সাল নদী ভাঙনকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
এইবাংলা /হিমেল