::: তানভীর আহমেদ, নেওয়াজ তুহিন :::
চট্টগ্রাম বন্দরের বহি:নোঙ্গরে বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের কাজের জন্য ‘ শিপ হ্যান্ডিলিং অপারেটর’ হিসেবে ২৩ টি প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে অনেকটাই গোপনে। কঠোর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে গেল বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম বন্দরের ‘শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর’ হিসেবে ২৩টি প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে লাইসেন্সের অনুমোদন দেয়া হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান বদলি হয়ে বন্দর ত্যাগ করার শেষ মুহুর্তে বোর্ড সভায় এসব প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বর্হিনোঙরে বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের কাজ করবেন এসব শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটররা। বোর্ড সভায় অনুমোদন দেয়া হলেও যারা লাইসেন্স পেয়েছেন তাদের তালিকা প্রকাশ করেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ।
অভিযোগ উঠেছে প্রতিটি লাইসেন্সের বিপরীতে চার কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন করা হয়েছে। লাইসেন্স প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীক অভিজ্ঞতা নয়, রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া হয়েছে শিপ হ্যান্ডিলিং অপারেটরের লাইসেন্স। সুত্রমতে, যুবলীগের রাজনীতিতে পরিচিত মুখ এমন তিনজনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানও পেয়েছে লাইসেন্সের অনুমোদন। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বন্দর কেন্দ্রিক সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে ডক ব্যবস্থাপনা বোর্ড বাতিল করে বার্থ অপারেটর পদ্ধতি চালু করেছিলো যৌথবাহিনী। সে নিয়মে বন্দর জেটিতে এখন ১২ আর বহির্নোঙরে দায়িত্ব পালন করছে ৩২ টি অপারেটর। খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, ওয়ান-ইলেভেনের সংস্কারে বন্দরের পণ্য লোডিং-আনলোডিংয়ের ক্ষেত্রে এমন নীতিমালায় স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা এসেছিল।
শিপ হ্যান্ডিলিং অপারেটর হিসেবে বর্তমানে কার্যক্রম চালানো ৩২ টি প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে নতুন অপারেটর অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সুত্রমতে, নতুন শিপ হ্যান্ডিলিং অপারেটর লাইসেন্স দেয়া হলে জাহাজ থেকে পণ্য খালাসে প্রতিযোগিতামুলক দর নির্ধারন করা সম্ভব হবে এমন যুক্তির আড়ালে শত কোটি টাকা ঘুষ বাণিজ্য করা হয়েছে। সুত্রমতে প্রতিটি লাইসেন্স অনুমোদন দেবার জন্য ‘ঘুষ’ লেনদেন হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা।
নতুন শিপ হ্যান্ডিলিং অপারেটর লাইসেন্স দেয়া হলে জাহাজ থেকে পণ্য খালাসে প্রতিযোগিতামুলক দর নির্ধারন করা সম্ভব হবে এমন যুক্তির আড়ালে শত কোটি টাকা ঘুষ বাণিজ্য করা হয়েছে। সুত্রমতে প্রতিটি লাইসেন্স অনুমোদন দেবার জন্য ‘ঘুষ’ লেনদেন হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা।
আমদানিকারকদের অভিযোগ, বন্দরকে ঘিরে গড়ে উঠা সিন্ডিকেটের কারণে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে শিপিং এজেন্টরা পণ্য খালাসে তাদের পছন্দমত দাম ও প্রতিযোগিতামূলকভাবে দক্ষ অপারেটর নিয়োগ করতে পারেন না।চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে খোলা পণ্য নিয়ে জাহাজ এলে পণ্য খালাসের জন্য শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর এসোসিয়েশন তাদের ইচ্ছেমতো পর্যায়ক্রম অনুসারে অপারেটর নিয়োগ করে, এমন অভিযোগ রয়েছে ।
সুত্রমতে, বন্দরের চেয়ারম্যান, সচিব ও পরিচালক-পরিবহন – এই ৩জনের সমন্বয়ে যাচাই-বাছাই কমিটি করা হয় শিপ হ্যান্ডিলিং অপারেটর লাইসেন্স অনুমোদনের জন্য । এই কমিটি ২০২১, ২২ ও ২৩ সালে জমা হওয়া দেড়শ’র বেশি আবেদন যাচাই-বাছাই করলে নতুন লাইসেন্স অনুমোদন দেয়া হয় নি। কিন্তু চেয়ারম্যানের বদলি আদেশের পর গোপনে অনুমোদন দেয়া হয়েছে নতুন ২৩ টি শিপ হ্যান্ডিলিং অপারেটর।
চেয়ারম্যানের বদলি আদেশের পর গোপনে অনুমোদন দেয়া হয়েছে নতুন ২৩ টি শিপ হ্যান্ডিলিং অপারেটর
তবে, চট্টগ্রাম বন্দরে নতুন শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর নিয়োগ কেন অবৈধ হবে না, সে বিষয়ে রুল জারি করে গেল বৃহস্পতিবার বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানসহ তিনজনকে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট বিভাগের একটি ডিভিশন বেঞ্চ। একইসঙ্গে এ কার্যক্রমের ওপর ৬ মাসের স্থগিতাদেশও দিয়েছেন হাইকোর্ট। এসটি এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক তারেক কামাল উচ্চ আদালতে রিট করার পর ৬ মাসের স্থগিতাদেশ দেয় আদালত।
সুত্রমতে, বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল শাহজাহানের বদলি আদেশের পর চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর এবং মহেশখালীর মাতারবাড়িতে কোন ধরনের দরপত্র আহ্বান ছাড়াই নতুন অপারেটরদের লাইসেন্স দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। রিটকারীর অভিযোগ অনুযায়ী শিপ হ্যান্ডিলিং অপারেটর লাইসেন্স অনুমোদনে চট্টগ্রাম বন্দরের ২টি প্রবিধান লঙ্ঘন করা হয়েছে।
শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরদের সংগঠনের পরিচালক জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, বিধি অনুযায়ী, নতুন অপারেটর নিয়োগ দিতে হলে টেন্ডার আহ্বান করতে হবে। এক্ষেত্রে সেটি করা হয় নি। ১৯৭২ সালেও বেশকিছু অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে স্টভিডোরিং লাইসেন্স অনুমোদন দেয়া হয়েছিলো ‘।
‘ বিধি অনুযায়ী, নতুন অপারেটর নিয়োগ দিতে হলে টেন্ডার আহ্বান করতে হবে। এক্ষেত্রে সেটি করা হয় নি। ১৯৭২ সালেও বেশকিছু অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে স্টভিডোরিং লাইসেন্স অনুমোদন দেয়া হয়েছিলো ‘।
নতুন ২৩ টি লাইসেন্স অনুমোদন দেবার বিষয়ে
বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডিলিং এন্ড বার্থ অপারেটরস এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডিলিং এন্ড বার্থ অপারেটরস এসোসিয়েশনের দাবি অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে এভাবে লাইসেন্স দেবার কারণে পেশাদারিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হবার পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম প্রকাশ না করলেও জানা গেছে তালিকার শুরুতেই আছে সালুটিকর এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তালিকার চার নম্বরে আছে বরিশাল সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকনের খুলনা ইউনিয়ন এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড। পাঁচ নম্বরে বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিস নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান। শিপিং খাতে পূর্বঅভিজ্ঞতাবহীন এই প্রতিষ্ঠানটিও বর্তমান সরকারের প্রতাপশালী এক মন্ত্রী পরিবারের।
শিপ হ্যান্ডিলিং অপারেটরের লাইসেন্সের অনুমোদন পেয়েছে সমুদ্র থেকে তেল চুরির মতো অভিযোগ উঠা চসিকের কাউন্সিলর জাবেদের মালিকানাধীন এস ট্রেডিং । চট্টগ্রামের একই মন্ত্রীর আরেক ভাইও শেয়ারে নিয়েছেন শিপ হ্যান্ডিলিং অপারেটরের লাইসেন্স। এছাড়া, একই পরিবারের দুই ভাই দুটি ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে পেয়েছেন অপারেটর লাইসেন্স। একটির নাম গফুর এন্ড ব্রাদার্স। হাতে আসা তালিকা অনুযায়ী এমএইএস কলেজ ছাত্রসংসদের সাবেক জিএস, নগর যুবলীগ নেতা আরশাদ আলম বাচ্চুর প্রতিষ্ঠান এবি কর্পোরেশনও পেয়েছেন শিপ হ্যান্ডিলিং অপারেটরের লাইসেন্স। সুত্রমতে, আরো একটি অনুমোদন পাওয়া ‘অপারেটর লাইসেন্সের মালিকানায় রয়েছে বাচ্চুর শেয়ার।
ঠিকানা অনুযায়ী লাইসেন্সের জন্য মনোনীত এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চট্টগ্রামের ১৬টি। ঢাকার প্রতিষ্ঠান আছে ৫টি। আর যশোর এবং খুলনার ১টি করে। তালিকা অনুযায়ী কে এ এস ট্রেডিং, আরিয়ান ট্রেডার্স লি., খুলনা ইউনিয়ন এন্টারপ্রাইজ লি., বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিসেস, এন এমটি-এমএসএন লি., ব্রিজেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লি., জিডি হারবার সার্ভিসেস, লামিসা এন্টারপ্রাইজ, পোর্ট হারবার ইন্টারন্যাশনাল, গুড অ্যালায়েন্স সার্ভিসেস লি., আহমেদ মেরিটাইম লজিস্টিকস, আর কে করপোরেশন, শাহী শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং, মা ট্রেডিং, এস ট্রেডিং, তাইফুল এন্টারপ্রাইজ, কিউ এন এস গ্লোবাল লজিস্টিকস লি, কেয়ার শিপিং অ্যান্ড ফ্রেইট লি: , ওশেন কন্ট্রাক্টিং অ্যান্ড সাপ্লাইং ফার্ম, গফুর ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, এস এস কনসাল্টিং লি. এবং এ বি করপোরেশন- নতুন অপারেটর লাইসেন্সের অনুমোদন পেয়েছে।
দরপত্র আহবান না করার বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তারা বলছেন, ‘ দরপত্র আহ্বান করতে হয় তালিকাভুক্তির সময়। লাইসেন্স অনুমোদন দেয়ার সময় নয় দরপত্র আহবান করার নিয়ম নেই। এছাড়া ১৫ বছরে বন্দরের বহির্নোঙ্গরে কার্গো ও জাহাজ হ্যান্ডলিং তিনগুণের বেশি বাড়লেও সেই তুলনায় বাড়েনি নতুন অপারেটর। ‘
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন , ‘ নতুন অপারেটর নিয়োগের প্রয়োজন থাকলে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সমন্বয়ে গঠিত নিরপেক্ষ কমিটির মাধ্যমে পদক্ষেপ নেয়া যায়। তাতে বিতর্ক থাকবে না। মনোপলি ভাঙতে পারলে ব্যবসায়ীদের জন্য ভালো, তবে হুট করে নতুন অপারেটর অনুমোদন দেয়া হলে প্রশ্ন তৈরি করাটাই স্বাভাবিক। ‘
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নথি অনুযায়ী শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরের জন্য গেল তিন বছরে ১শ ৬৩টি আবেদন জমা পড়েছে। সবকটি আবেদন সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকেই ২২-২৩ জনের নামে লাইসেন্স দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেয়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। তবে গোপনে অনুমোদন ও ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ সম্পর্কে প্রকাশ্যে কিছু বলতে নারাজ বন্দরের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে জানতে বন্দরের সচিব ওমর ফারুকের সাথে যোগাযোগের চেস্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেন নি। আর লাইসেন্স অনুমোদন দিয়েই নিরবে চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়েছেন সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল শাহজাহান। এরমধ্যে মঙ্গলবার ( ২রা মে) চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ সোহাইল দায়িত্ব ভার গ্রহন করেছেন।
এইবাংলা / তুহিন