নাদিরা শিমু, চট্টগ্রাম :::
পটিয়ায় নির্বাচনী সংঘাত সহিংসতা বাড়ছে দিন দিন। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হুইপ সামসুল হক চৌধুরীর ছেলে শারুনের বিরুদ্ধেই সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বিস্ফোরিত হচ্ছে ভোটের মাঠে। জানা গেছে হুইপ সামসুল হক চৌধুরী ও তার পুত্র শারুনের হাতে নির্যাতিতরাই অবস্থান নিয়েছে নৌকার প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলামের পক্ষে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত ও বির্তকিত কিছু নেতার দ্বিমুখী অবস্থানের ফলে নৌকা প্রার্থীর প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে।
ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর গণসংযোগ ও প্রচার গাড়িতে দুই দফা হামলা হয়েছে। শনিবার প্রথম দফায় উপজেলার কুসুমপুরা ইউপির শান্তিরহাটস্থ জিরি মাদ্রাসা গেটে সকাল ১১টায় হামলার ঘটনায় এক নারী ও হুইপের ভাই ফজলুল হক চৌধুরী মহব্বতসহ ৫ জন আহত হন।সন্ধ্যায় ২য় দফা হামলার ঘটনা ঘটে পশ্চিম কুসুমপুরা ইউপির পান্না পাড়া এলাকায়। ওই ঘটনায় হুইপের গাড়ি বহরে গুলি চালানোর পাশাপাশি রাম দা, হকিস্টিক ও লাঠি দিয়ে ৬টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয় ৩ জন। ওই ঘটনায় হুইপের ছোট বোনসহ ২০ জন আহত হয়। আহতদের পটিয়া হাসপাতালে নেয়া হলে গুরুতর বিবেচনায় ৪–৫ জনকে চমেক হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়।
হামলা প্রসঙ্গে সামসুল হক চৌধুরীর বোন সুলতানা বলেন, সকালে আমার ভাইকে সড়কে অবরুদ্ধ করে রেখে আমার আরেক ভাইকে লাঞ্চিত করে। পরে বিকালে আমার ওপর হামলা করে তারা। এই দুই ঘটনায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীর লোকজন জড়িত। আমরা এর বিচার চাই।’
চমেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক (এসআই) নুরুল আলম রাতে আশেক জানান জানান, স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক মনির হোসেন (৪৩), প্রার্থীর বোন সুলতানা ইয়াসমিন রেখা (৪২) এবং রাসেল (৩৩) ও কাসেম (৩৫) নামের মোট ৪ জন হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
দুই মেয়াদে সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সামসুল হক চৌধুরী কেন, কাদের হামলার শিকার হচ্ছেন, এমন প্রশ্ন রাজনীতির মাঠে।
বিশ্লেষকদের মতে, জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন পটিয়া আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতারা। তিনি তার বশংবদ ‘এমপি লীগ’ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে দলের নির্বাচিত কমিটি ভেঙে দিয়ে জামায়াত-হাইব্রিড-অনুপ্রবেশকারীদের ঠাঁই দিয়েছেন – এমন অভিযোগ হাটে ঘাটে মাঠে। বাবার ক্ষমতায় অবৈধ উপার্জনের টাকায় বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত সারুন নিজের অনুসারীদের নিয়ে গঠন করেছেন সমর্থক গোষ্ঠী। নানান বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে অল্প বয়সেই তিনি এসেছেন গণমাধ্যমে আলোচনায়। আওয়ামীলীগের মনোনয়নে বাবা সংসদে যাওয়ার টিকিট পাওয়ার পর তিনিই হয়ে উঠেছেন অঘোষিত সংসদ সদস্য।ক্ষমতার আস্ফালনে চট্টগ্রামে কোন অঘটন মানেই তার সামনে কিংবা পেছনে পেছনে দেখা যায় হুইপপুত্র নাজমুল করিম চৌধুরী শারুনের হাত। এসব কারণেই নির্বাচনের প্রচারণায় গিয়ে সংক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষের হাতে লাঞ্চিত হচ্ছে স্বতন্ত্র প্রার্থী সামসুল।
জানা যায়, মোরশেদ নামের এক ব্যাংক কর্তকর্তার আত্মহত্যা প্রচোরণাকারী হিসেবে শারুনের নাম আসার পর সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়। আত্মহননের পথ বেছে নেয়া সেই ব্যাংক কর্মকর্তার স্ত্রী ইসরাত চৌধুরী সরাসরি হুইপ পুত্র শারুনের নাম বলেছিলেন। শারুনের সাঙ্গপাঙ্গসহ বেশ কয়েকজনকে অভিযুক্ত করছেন, ভুক্তভোগী পরিবার। হুইপ সামশুল হক চৌধুরী, হুইপ পুত্র শারুন ও হুইপের ভাই নবাব চৌধুরীর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা -জনতার সমাবেশ আওয়ামী লীগ সমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।
জানা গেছে, হুইপ সামসুল হক চৌধুরী ও তার ছেলে শারুনের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমা পড়ছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রে, প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে। দুই মেয়াদে এমপি হবার পর প্রভাব খাটিয়ে যেসব নেতাকে বাদ দেওয়া হয়েছে তারাই নির্বাচনের মাঠে মোতাহেরুল ইসলামের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২৮৯ চট্টগ্রাম পটিয়া-১২ সংসদীয় আসনের আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বর্ষীয়ান মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরীর পক্ষে একাট্টা জেলা এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। তারা প্রতিদিন নির্বাচনী মাঠে নৌকা প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন।
বিপরীতে টানা তিন বারের সংসদ সদস্য এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত সামশুল হক চৌধুরী স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় তার পক্ষে দলের তেমন কেউ নেই, উল্টো পিতা-পুত্রের হাতে নির্যাতিতরা ভিড়েছেন নৌকার প্রার্থীর পক্ষে। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী সামসুল এবার নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে বিএনপি জামায়াতের নেতা ও দলছুট নেতা কর্মীদের উপর ভর করছেন।
আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা, মুক্তিযোদ্ধা দিদারুল আলম চৌধুরীকে টেলিফোনে অশ্লীল বাক্যবানের অভিযোগ উঠার পরও ক্ষমতার দাপট সারুনকে সুরক্ষা দেয়। সামশুল হক চৌধুরী শুধু একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে লুঙ্গি খুলে পেটানোর হুমকিই দেননি, চট্টগ্রামের আর একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা দিদারুল আলমকেও হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই অডিও ক্লিপ ভাইরাল হয় । এরপরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়, একে-47 দিয়ে শারুনের মুহুরমুহ গুলির ভিডিও। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীরাই বলছেন, অদৃশ্য শক্তিতে বার বারই ধরা ছোয়ার বাইরে থেকে যায়, শারুন। এভাবেই ক্ষমতার পটপরিবর্তনে সারুন যেন ভোটের মাঠে নির্যাতিতদের মুল টার্গেট।
শামসুল হক চৌধুরী ও তার পুত্র নাজমুল হক চৌধুরী সারুনের বিরুদ্ধে শত বছরের পুরনো পটিয়া থানা মসজিদ দখল করে বহুতল মার্কেট নির্মাণের অভিযোগও ঘি ঢেলেছে ক্ষোভের আগুনে। নিজেদের কার্যসিদ্ধির জন্য পাল্টে দিয়েছিলেন সেই মসজিদের নামও। এমন অনৈতিক কার্যকলাপের প্রতিবাদ করায় হুইপ ও তার পুত্রের রোষানলে পড়েছিলেন পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তাও। পটিয়া থানা পুলিশের মসজিদ দখল করে বহুতল মার্কেট নির্মাণকে কেন্দ্র করে পুলিশ প্রশাসনে দেখা দেয় তীব্র অসন্তোষ।
এছাড়া পটিয়ায় ক্ষতিপূরণ বা জমি অধিগ্রহণ না করেই এক্সক্যাভেটর চড়িয়ে দিয়ে কৃষিজমির মাটি কেটে নেবার পর তীব্র অসন্তোষ দাঁনা বাধে কৃষকদের মনে। পটিয়ায় ১ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অধীন ১১টি খাল খনন ও বেড়িবাঁধ নির্মাণকাজ করতে গিয়ে ক্ষতিপূরণের টাকা বঞ্চিত করা হয়েছে কৃষকদের। এছাড়া ওই প্রকল্পের আওতায় ৩০ কিলোমিটার খাল খনন ও বেড়িবাঁধ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিলো।
স্থানীয়দের অভিযোগ , শত শত একর কৃষিজমি ধ্বংস করে সীমানা চিহ্নিতকরণ ছাড়াই অপরিকল্পিতভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কৃষি জমির ক্ষতিপূরণ কিংবা জমি অধিগ্রহণ না করে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এক্সক্যাভেটর দিয়ে কাটা হয় কৃষিজমির মাটি। খালের প্রস্থ ৮৫ ফুট, গভীরতা ১৬ থেকে ১৮ ফুট এবং নিচে ২০ ফুট হওয়ার কথা থাকলেও নিয়ম মানা হয় নি।
জানতে চাইলে হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের সত্যজিৎ বিশ্বাস বলেন, আবাদি জমি খনন করে বেড়িবাঁধের জন্য মাটি নিতে গিয়ে আইল পর্যন্ত কেটে ফেলা হয়েছে। এ কারণে নতুন করে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে সীমানা বিরোধের। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা ক্ষতিপূরণও পাননি।
একই অভিযোগ পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর গোফরান রানার। তিনি অভিযোগ করেন, খালের পরিবর্তে ফসলি জমিতে পুকুরের মতো গর্ত করে মাটি এনে নির্মাণ করা হচ্ছে বাঁধ। ভরাট করা হচ্ছে ফসলি জমি। প্রভাবশালী সিন্ডিকেট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশ করে কৃষকদের ওপর জুলুম করছে। কেউ ভয়ে মুখ খুলছেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সীমানা নির্ধারণ করে দেবার পরও সাংসদ সামসুল হকের প্রশ্রয়ে কৃষকদের জমি কেটে ফেলেছেন ঠিকাদার। এচাড়া সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দেওয়া হয়, যাতে গরিব কৃষক প্রতিবাদ করতে না পারেন। তখন খাল খননের নামে এমন অর্থ লোপাটের প্রতিবাদ করতে না পারা কৃষকরাও সংক্ষুব্ধ। নির্বাচনের মাঠে নিজেদের হক বুঝে নিতে একাট্টা তারা।
স্বতন্ত্র প্রার্থী শামসুল হক চৌধুরীর নির্বাচনী কার্যক্রমে বাধা দেয়া ও হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে নৌকার প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলাম বলেন, ‘ আমরা ভোটে জিততে চাই, হামলা করার দরকার কি? হুইপ ও তার পুত্রের নির্যাতনের শিকার সাধারণ মানুষ নির্বাচনকে প্রতিবাদের উপলক্ষ হিসেবে। জনরোষ থেকে তারা নিরাপদ থাকতে পারছেন না। নৌকার সমর্থকরা কোন সহিংসতার সাথে জড়িত নয়, জড়িত হবেন না। ‘
পটিয়ায় সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ এবং সংক্ষুব্ধ জনতার ক্ষোভের বিষয়ে জানতে সামসুল হক চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলেও, নির্বাচনের প্রচারণায় ব্যস্ত থাকার অজুহাতে তিনি সাড়া দেন নি।
প্রসঙ্গত, পটিয়া উপজেলার ১টি প্রথম শ্রেনীর পৌরসভা ও ১৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এই সদসীয় আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী ভোটের মাঠে আবির্ভূত হয়েছেন ত্রানকর্তা হিসেবে। তিনি একই সাথে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার সাথে ঈগল প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রাথী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন দলছুট নেতা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত বর্তমান সাংসদ সামশুল হক চৌধুরী। এলডিপি নেতা এবারের নির্বাচনে বিএনএম প্রার্থী হিসেবে নোঙ্গর প্রতীকে শিল্পপতি এম এয়াকুব আলীসহ এখানে আরো ৬ প্রার্থী থাকলেও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে এই তিন প্রার্থীর মধ্যে।