নিজস্ব প্রতিবেদক :::
পছন্দের থানা পেতে সপ্তাহ ধরে দৌড়ঝাঁপ শেষে বাঁশখালী থানার চেয়ার পেয়েছেন মহাসড়কে ডাকাতি ও চাঁদাবাজিকান্ডে সমালোচিত সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদ। সীতাকুণ্ড থানায় রাজকীয়ভাবে নিয়োগও পেয়েছিলেন তিনি। সীতাকুণ্ড থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ডেকে এনে দিনে দিনে চেয়ারে বসানো হয়েছিলো খুলনা রেন্জ থেকে চট্টগ্রামে যোগ দেয়া তোফায়েল আহমেদকে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অবাধ করতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) বদলির নির্দেশ দেওয়ার পর কপাল খুলেছে ওসি তোফায়েল আহমেদের। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে তার বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ তদন্তে তদন্ত কমিটি গঠনের দিনই বাঁশখালীর মতো থানায় বদলির সুখবর পেয়েছেন তিনি।
নির্বাচনের এক মাস আগে সারাদেশে ওসি বদলিতে নজিরবিহীন ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। সুত্রমতে, চট্টগ্রামে সর্বনিম্ন পঞ্চাশ লাখ টাকা ঘুষ নেয়া হয়েছে প্রতিটি ওসির বিপরীতে। শুধু চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থানায় ওসির চেয়ারে রদবদলে দুই কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন হয়েছে দাবি সুত্রটির।
চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে দেশের অন্যতম বৃহৎ বিদ্যুৎ প্রকল্প অবস্থিত যেখানে শতাধিক বিদেশি শ্রমিক -কর্মকর্তা কর্মরত রয়েছে৷ নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনার অজুহাতে সীতাকুণ্ডের বিতর্কিত ওসি তোফায়েল আহমেদকে বাঁশখালী থানায় পদায়ন সুবৃহৎ এই প্রকল্পের নিরাপত্তা ও পরিবেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে, এমন অভিযোগ পৌঁছে গেছে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের টেবিলে। দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প গ্রুপ আবুল খায়ের গ্রুপের ক্রাপবাহী ড্রামট্রাক সুপরিকল্পিতভাবে ডাকাতির অভিযোগ উঠা ওসি তোফায়েল আহমেদের পদায়ন করা হয়েছে বাঁশখালী থানায়।
ওসি তোফায়েল তার বর্তমান কর্মক্ষেত্রে
১৯৬ কারখানায় চাঁদাবাজি করে বাংলাদেশ পুলিশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করেছে এমন সংবাদ একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হবার পরদিনই তাকে বাঁশখালীতে পদায়ন করা হয়। অথচ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থানা এলাকার ১৯৬ কারখানা থেকে মাসে দেড় কোটি টাকা ‘চাঁদাবাজি’ র অভিযোগ উঠা সেই ওসি তোফায়েল আহমেদের বিরুদ্ধে একজন পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলো পুলিশ সদর দপ্তর।
অভিযোগপত্র অনুসারে , সীতাকুণ্ডের ১৯৬টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান, চোরাই জ্বালানি তেল ও জাহাজের পুরোনো আসবাব বিক্রির দোকান, ড্রামের কারখানা, পুরোনো লোহা বিক্রেতা, পরিবহন চালক—কেউই বাদ যান নি চাঁদাবাজি থেকে। পুলিশ সদর দপ্তর ওসি তোফায়েলের বিরুদ্ধে যেদিন তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সেদিনই তাকে আরেকটি থানায় প্রাইজ পোস্টিং দেয়া হয়েছে,যেখানে দেশের অন্যতম বৃহৎ কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প অবস্থিত।
পুলিশের ঘনিষ্ঠ একটি সুত্র জানায়, সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ নতুন নয়। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে শিপইয়ার্ডে মো. রাসেল নামে এক শ্রমিককে হত্যার পর মরদেহ গুম করার অভিযোগ গড়ায় আদালত পর্যন্ত। মরদেহ গুমের অভিযোগ এনে আদালতে মামলার জন্য আবেদন করেন ভুক্তভোগী শ্রমিকের বাবা মো. ইউনুস মিয়া। চলতি বছরের ১ অক্টোবর চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুল হকের আদালতে সীতাকুণ্ডের ওসি তোফায়েলসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করে ভুক্তভোগী শ্রমিকের বাবা।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী তোফায়েল আহমেদ ২০০৮ সালে এসআই (নিরস্ত্র) হিসেবে চাকুরীজীবন শুরু করেন পুলিশের খুলনা পুলিশ লাইনে। ২৩ শে ডিসেম্বর ২০১৬ সালে পদোন্নতি পেয়ে ওসি হন তিনি। ২০২২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম রেঞ্জে যোগ দেওয়ার আগের পুরো চাকরিজীবনই খুলনা রেঞ্জে। পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জে যোগ দেওয়ার ২৬ দিনের মাথায় সীতাকুণ্ডের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি। চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার শফিউল্লাহর সাথে খুলনা জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় কাজ করেছেন তিনি। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে খুলনা রেঞ্জে প্রায় ৬ বছর ছিলেন চট্টগ্রামের বর্তমান পুলিশ সুপার । পরে পুলিশ সুপার হিসেবেও কিছুদিন খুলনায় দায়িত্ব পালন করেন। সেই সুবাধে সীতাকুণ্ড থানায় যোগ দেবার পর থেকে ঘুষের স্বেচ্ছাচারিতা সংবাদের শিরোনাম হলেও বহাল তবিয়তে থেকেছেন গুরুত্বপূর্ণ এই থানার চেয়ারে। চট্টগ্রামের শ্রেষ্ঠ ওসি হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছেন মাদক উদ্ধার, জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ অবদান রাখায় স্বীকৃতি হিসেবে।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কর্মরত এক সংবাদকর্মী জানান, থানায় যোগদানের পর হতে তোফায়েল আহমেদ একই থানার মহিলা মুন্সি কনস্টেবল নাসরীনকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন সময় ধর্ষন করে আসছিলেন। এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরে পুলিশের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ সেই মহিলা মুন্সীকে অন্যত্র বদলি করে দেয়া হলেও নিশ্চিন্ত থেকেছেন তোফায়েল ।
জানা যায়, তোফায়েল আহমেদ ওসি ডিবি হিসেবে খুলনায় কর্মরত থাকা অবস্থায় জেলার শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তার ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করেছেন। সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে নানা ধরনের অপকর্ম জড়ান তিনি ।
আরেকটি সুত্রের দাবি, জেলার শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ হবার কারনে ওসি তোফায়েল সীতাকুণ্ডের সার্কেল অফিসারকেও নানাভাবে মানসিক নির্যাতন করেছেন। তার ভয়ে অধিনস্থ পুলিশ কর্মকতারাও তটস্থ থাকেন। জেলার শীর্ষকর্তার ঘনিষ্ঠ হবার কারণে সীতাকুণ্ড থানায় যোগদানের পর থেকে তিনি চট্টগ্রাম জেলার ওসিদের বদলির তদবির বানিজ্য করে আসছেন; সুত্রটির দাবি।
সীতাকুণ্ড থানার একটি সুত্রমতে, ওসি তোফায়েল এতটা নারী লিপ্সু যে শিল্প প্রতিষ্ঠান ‘কেএসআরএম গ্রুপ’ হতে সীতাকুণ্ড থানার ইন্টেরিয়রের কাজ দেখবাল করার জন্য একজন সুন্দরী নারী থানায় আসলে তিনি ওই নারীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে চট্টগ্রাম খাগড়াছড়ি পার্বত্য অঞ্চলে নিয়ে গিয়ে অনৈতিক মেলামেশা করতে বাধ্য করেন। বিষয়টি জানাজানি হবার পর লাখ টাকায় চাপা দেয়া হয়েছে সেই সংবাদ।
তোফায়েল আহমেদ সীতাকুণ্ডের শিপইয়ার্ড ব্যবসায়ী ইকবালকে নিয়ে প্রায় সময় নারী জুয়া মদ নিয়ে আড্ডা মজে থাকেন, এমন তথ্যও মিলেছে অনুসন্ধানে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তার কাছে পুলিশিং এর চেয়ে নেশার প্রাধান্য বেশি। তিনি প্রায় সময় নেশায় বুঁদ থাকেন।
সুত্রমতে, তোফায়েল আহমেদের বিরুদ্ধে পুলিশ হেডকোয়ার্টার আইজিসেলে অর্ধ শতাধিক পৃষ্ঠা সম্বলিত অভিযোগপত্র জমা পড়েছে। যার প্রেক্ষিতে গত ৭ ই ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে, তদন্ত কমিটি তদন্ত কার্যক্রম শুরুর আগেই বাঁশখালীর মতো থানায় বদলি করে পুরস্কৃত করা হয়েছে তাকে।
আইজিসেলের সুত্রমতে, তোফায়েল আহমেদের সীতাকুণ্ড থানায় ওসি হিসেবে যোগ দেবার বিষয়টিও ছিলো রাজকীয়। তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদকে এসপি কার্যালয়ে ডেকে এনে একই দিন চেয়ারে বসেন তিনি। রীতি অনুযায়ী থানার চার্জ বুঝিয়ে দেবার সুযোগ মেলেনি সীতাকুণ্ড ছেড়ে আসা ওই ওসির।