গুল নাহার, ঢাকা :::
আবাসিক এলাকায় কোন বাণিজ্যিক স্থাপনা কিংবা আবাসিক ভবনের বাণিজ্যিক ব্যবহার বৈধ নয়-রাউজকের এমন আইন যেন শুধুই মুখের বুলি। বাস্তবে রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকার অধিকাংশ ভবনই ব্যবহৃত হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে। এতে করে আবাসিক এলাকার পরিবেশই শুধু নষ্ট হচ্ছে না, বরং সরকারও রাজস্ব (বাণিজ্যিক) থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
রাজধানীর উত্তরা মডেল টাউন আবাসিক এলাকার ৩ নং সেক্টর। ১৮ নং রোড়ের ৩১ নং প্লটের মালিকের কব্জির জোরের কাছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এমন আইন পরাভূত হয়েছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আবাসিক ভবনের অনুমতি নিয়ে ভবন নির্মাণ করলেও সেখানে ভাড়া দেওয়া হয়েছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এ বিষয়ে চলতি বছরের ২৩ শে অক্টোবর ভবনের পাঁচ তলার বাসিন্দা মোক্তার হোসেন রাজউকের কাছে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন। ভবনের নির্মাতা ডোমইনোর পক্ষ থেকে জমির মালিককে চিঠি দেয়া হয়েছে ; কিন্তু সেই চিঠির কোন তোয়াক্কাই করছেন জমির মালিক। ফলে একই ভবনে গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করা ফ্লাটের পরিবেশ নিয়ে চাপে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
আইন অনুযায়ী রাজধানীতে ভবন নির্মাণ, ব্যবহার, সম্প্রসারণের জন্য রাজউকের অনুমোদন নিতে হয়। রাজউকের নাকের ডগায় উত্তরা মডেল টাউনের ১৮ নং রোড়ের ৩১ নম্বর প্লটে আবাসিক ভবনটি সম্প্রসারণ করে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করছেন জমির মালিক । আবাসিক ভবন হিসেবে নকশা অনুমোদন করা হলেও ভবনটির বিভিন্ন ফ্লোরে ভাড়া দেয়া হয়েছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান । আলো-বাতাস চলাচলের কোনো ব্যবস্থা নেই। এই ভবন নিয়ে নানা রকম নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি দৈনিক এই বাংলার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।২০১৯ সালে রাজধানীর আবাসিক এলাকার কোনো আবাসিক ভবনের পার্কিংয়ের স্থান বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা যাবে না বলে নির্দেশ দিয়েছিলো হাইকোর্ট। কিন্তু উত্তরা মডেল টাউনের এই ভবনের পার্কিং ব্যবহার করা হচ্ছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিয়ে বাণিজ্যিকভাবেই।
২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দিয়েছিলেন আবাসিক এলাকার মধ্যে বাণিজ্যিক ভবন গড়ে তোলা যাবে না। এই নির্দেশনা পাওয়ার পর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও গৃহায়ণ ও গণপূর্ত অধিদফতর পৃথকভাবে তদন্ত করে। সংস্থাগুলোর তদন্তে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় আবাসিক ভবনের বাণিজ্যিক ব্যবহার যেমন ধরা পড়েছিলো, তেমনিভাবে বাণিজ্যিক ব্যবহার করতে গিয়ে মালিকরা ভবনের নকশা পাল্টে ফেলেছেন এমন অসংখ্য নজির প্রকাশ্যে আসে। এরপর ২০১৯ সাল পর্যন্ত রাজধানীর উত্তরায় আবাসিক ভবনের বাণিজ্যিক ব্যবহার বন্ধে অভিযান চালায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।২০১৯ সালে বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের পর সে বছরের এপ্রিলে ঢাকার ১০ তলার উপরের ভবনগুলোর ওপর একটি মাঠ পর্যায়ের জরিপ চালায় রাজউক। জরিপে দেখা যায়, এগুলোর মধ্যে রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই ৪৭৫টি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। বাকি ১ হাজার ৩৪৩টি ভবন অনুমোদিত নকশার বাইরে উপরের দিকে কিংবা পাশে বাড়ানো হয়েছে।
রাজধানীর পশ্চিম থানাধীন উত্তরা মডেল টাউন আবাসিক এলাকার তিন নম্বর সেক্টরের ৩১ নং প্লটে আবাসন নির্মান প্রতিষ্ঠান ডোম-ইনো ভবন নির্মাণ করেছে। ভবনের নাম দেয়া হয়েছে ডোম ইনো এভিনেন্ট। দশ তলা এই ভবনের বেশ কিছু ফ্লাট ভাড়া দেয়া হয়েছে বায়িং হাউজকে।
রাজউকের নথি অনুযায়ী উত্তরা জোন ২/১ এর অধীনে আবাসিক ভবন হিসেবে অনুমোদন গ্রহণ করা হয়েছে এই প্রকল্পের । এই আবাসিক ভবন বানিজ্যিক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, জমির মালিক ক্ষমতার দাপটে নিজের ইচ্ছেমতো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিয়েছেন ফ্ল্যাট।
ভবনটির নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ডোম ইনোর কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার এহসানুর রহমান জানান, ‘ ভবনটি বানিজ্যিক কোন কাজে ব্যবহার রাজউক নিয়ম বর্হিভুত। আবাসিক ফ্লাটে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ভাড়া দেবার ফলে আবাসনের পরিবেশ নস্ট হয়েছে। এছাড়া আবাসিক ভবনে বানিজ্যিকের ব্যবহারের ফলে ফ্ল্যাটের রেজিষ্ট্রেশন, অকুপেন্সি, ইউটিলিটি সংযোগ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। একারণে ভবনটিতে বানিজ্যিক অফিস ভাড়া না দেবার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। এভাবে কোন ফ্যাট বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দেওয়া হলে তার দায়ভার উক্ত ব্যক্তির উপর পড়বে এবং দায়ভার ডোম-ইনো বহন করবে না।’
স্থানীয়রা জানান, জমির মালিক আবাসিক এলাকার এই ভবনটিতে বায়িং হাউজের অফিস ভাড়া দিয়ে আসছে দীর্ঘ দিন যাবত। তার এই ভবনটি বানিজ্যিক কাজে ব্যবহার করছে। যা রাজউকের ভবন নির্মাণ আইনের লঙ্ঘন ।
সরেজমিনে গিয়ে এই আবাসিক ভবনের বাণিজ্যিক ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে জমির মালিক পক্ষের কাউকে পাওয়া যায় নি। বাড়ির দাড়োয়ানদের মালিকের মুঠোফোনের নাম্বার চাইলে দিতে অস্বীকৃতি জানান। তবে বিভিন্ন ফ্লাটে বসবাসকারীরা জানান, জমির মালিক নিজেদের ফ্ল্যাট বায়িং হাউজকে ভাড়া দিয়েছেন। স্বপরিবারে বিদেশে বসবাস করেন তারা। বায়িং হাউজের গ্রাহকদের সকাল সন্ধ্যা আনাগোনার কারনে আবাসিক ভবনের কোন পরিবেশই নেই।
এ বিষয়ে জানতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ইমারত পরিদর্শক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পর ইতিমধ্যে ভবনটির মালিক কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নোটিশ অনুযায়ী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরানো না হলে ইমারত আইন ব্যবস্থা নেয়া হবে।