ফারজানা মুন্নী ||
কা রো কাছে সিলেটের সুন্দরবন আর কারো কাছে বাংলাদেশের আমাজন – চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের কারণে পর্যটকরা এভাবেই সংজ্ঞায়িত করেছেন রাতারগুলকে। সিলেট শহরতলী থেকে ২৬ কিলোমিটার দুরে গোয়াইনঘাটে অবস্থিত রাতারগুল। দেশের বিভিন্ন জেলার সৌন্দর্য পিপাসু পর্যটকরা রাতারগুলো ভীড় করা শুরু করে প্রতিদিন, তবে বর্ষকালেই রাতারগুলোর রূপ বৈচিত্র্য উপড়ে উঠে।
এর আসল সৌন্দর্য তখনই টের পাওয়া যায় যখন নৌকা দিয়ে আপনি এর ভিতরে প্রবেশ করবেন। পুরোটা বন যেন পানির ওপর ভাসছে। বিশাল আকৃতির গাছগুলোর গোড়া পানির নিচে আর ডালপালা পানির ওপরে। এই দৃশ্য আপনি বাংলাদেশের রাতারগুল আর সুন্দরবন এলাকা ছাড়া আর কোথায়ও পাবেন না।
গোয়াইনঘাটের গোয়াইন নদীকে ঘিরে এই জলাভূমি গড়ে উঠেছে।রাতারগুল জলাবন বা বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা (রাতারগুল) বা রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির জলাবন এবং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, যা সিলেটের গোয়াইনঘাটে অবস্থিত।
এই বনের আয়তন ৩,৩২৫.৬১ একর, আর এর মধ্যে ৫০৪ একর বনকে ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এছাড়াও ২০৪.২৫ হেক্টর বনভুমিকে ৩১ মে ২০১৫ তারিখে বাংলাদেশের বন অধিদপ্তর বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা ঘোষণা করে। জীববৈচিত্র্য এবং সৌন্দর্যের জন্য পৃথিবীর মাত্র কয়েকটি জলাবনের মধ্যে অন্যতম এটি। এই বনকে বাংলাদেশ সরকারের বনবিভাগের অধীনে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
চোখ ধাঁধানো জলাবন
চিরসবুজ এই বন গুয়াইন নদী এবং চেঙ্গির খালের সাথে সংযুক্ত । এই জলাভূমিতে সবচেয়ে বেশি জন্মায় করচ গাছ যার বৈজ্ঞানিক নাম- Millettia pinnata।
সাধারনত বর্ষাকালে এই বন ২০–৩০ ফুট পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে রাতারকগুল। বাকি সারা বছর, পানির উচ্চতা ১০ ফুটের মতো থাকে। বর্ষাকালে এই বনে অথৈ জল থাকে চার মাস – এই সময়টিই পর্যটকদের জন্য উপযোগী। শুষ্ক মৌসুমে ছোট ছোট খালগুলো হয়ে যায় পায়ে-চলা পথ। আর তখন পানির আশ্রয় হয় বন বিভাগের খোঁড়া বিলগুলোতে। সেখানেই আশ্রয় নেয় রাতারগুলের জলজ প্রাণীকুল।
ঢাকা থেকে যেভাবে যাওয়া যাবে
বাসে-ঢাকা থেকে সিলেট বাস যায়। যেকোনো দূরপাল্লাগামী বাস কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে পারেন।ঢাকা- সিলেট বাস ভাড়া- ৭০০ টাকা(নন এসি), আর এসি ৯০০-১২০০ টাকা। সকল ঢাকাগামী বাস সিলেটের কদমতলী এলাকায় আপনাকে নামিয়ে দিবে।
ট্রেনে-ঢাকার কমলাপুর থেকে সিলেটের ট্রেনে সিলেট স্টেশন আসা যায় । ভাড়া সীট জনপ্রতি ২৬৫ থেকে ৮০০ টাকা। ট্রেনে যেতে চাইলে অবশ্যই ট্রেনের টিকিট আগে থেকে বুকিং করে রাখলেই ভালো।
বিমান যোগে-আপনি আকাশপথে সিলেট আসতে চাইলে ঢাকার হযরত শাহজালার আনর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে সিলেটগামী যেকোনো এয়ারলাইনসে যেতে পারবেন। আপনাকে সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরে নামিয়ে দিবে। ভাড়া পড়বে প্রায় ৩০০০ টাকা সাত হাজার টাকার মত।
রাতারগুল কোথায় খাবেন এবং থাকবেন-
রাতারগুল থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। খাবার দুই একটা হোটেল পাবেন। তবে টুকটাক চা নাস্তা করতে পারবেন। রাতারগুল ঘুরে আরেকটি স্পট ঘুরে সিলেট শহরে গিয়ে রাত কাটানোটাই ভালো অপশন।
রাতারগুল যাবার উপযুক্ত সময়-
সারাবছর রাতারগুল যাওয়া যায় তবে বর্ষাকালে বেশী সুন্দর। বর্ষায় নৌকা দিয়ে আসল সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। শীতকালে পানি শুকিয়ে যায় তাই নৌকা দিয়ে পুরোটা ঘুরে দেখা সম্ভব হয় না।
সিলেট থেকে রাতারগুল যাওয়ার উপায়-
রাতারগুল যাবার জন্য সিলেটের কদমতলী থেকে সরাসরি সি এন জি যায়। যেতে সময় লাগে ১ ঘন্টার মত। ভাড়া পড়বে-৬০০ টাকা প্রায়( শুধু রাতারগুল যাওয়া আসা)। তবে রিজার্ভ করে না গেলে আসা যাওয়া মিলিয়ে কম খরচ হবে ।
রাতারগুলের পাশাপাশি অন্যান্য স্পট দেখতে চাইলে সারাদিনের জন্য সি এন জি রিজার্ভ করলেই ভালো। সারাদিন রিজার্ভ ভাড়া ১২০০-১৫০০ টাকা। ৪-৫ জন যেতে পারবেন এক সি এন জি তে। লেগুনা রিজার্ভ করেও যেতে পারেন, ২০০০-২৫০০ টাকা নেবে।সি এন জি নামিয়ে দিবে চৌরাঙ্গি ঘাটে। ঘাট থেকে নৌকা ভাড়া করে রাতারগুল ভ্রমন করতে হবে।
রাতারগুল যাবতীয় খরচ-
রাতারগুল এন্ট্রি ফি ৫০ টাকা (বয়স্ক এবং বাচ্চা উভয়ের জন্য প্রযোজ্য) স্টুডেন্ট আইডি কার্ড থাকলে ২৫ টাকা।এবং বিদেশীদের জন্য ৫০০ টাকা নির্ধারন করা হয়েছে। নৌকা ভাড়া ৭৫০-৮০০ টাকা ( সরকার কতৃক নির্ধারিত)।
বর্ষাকালে পুরোটা নৌকায় ঘুরে দেখতে প্রায় দুই ঘন্টার মত সময় লাগে। রাতারগুলের বন পাড়ি দিয়ে একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে।ওয়াচ তাওয়ারের নিচে নৌকা বেধে ওপরে সিঁড়ি দিয়ে যেতে হয়। এর ওপর থেকে পুরো রাতারগুল দেখা যায়। নদীর পানি,সবুজ বন আর আকাশের রঙ একসাথে এতো সুন্দর দৃশ্য যা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়।
রাতারগুল ভ্রমনে সতর্কতা-
১) যেহেতু বন্য এরিয়া তাই বিষাক্ত সাপ ও বিভিন্ন পোকা মাকড় থাকতে পারে।
২) কোনো বন্য প্রানীর দেখা পেলে তাদের উত্ত্যক্ত করা থেকে বিরত থাকুন।
৩) নৌকাপথে যাবার সময় বনের ভিতরে কোনো প্রকার খাবার বা খাবারের প্যাকেট ফেলবেন না।বনের পরিবেশ নষ্ট হয়।
৪) রাতারগুলে প্রচুর মাছ রয়েছে। জনসাধারনের জন্য এখানে মাছ ধরা সম্পূর্ন নিষেধ।
৫) ওয়াচ টাওয়ারে শিশুদের নিয়ে অসতর্কভাবে ওঠা থেকে সম্পূর্ন বিরত থাকুন।
৬) রাতারগুলে জোঁকের দেখাও পাওয়া যায়। তাই সাবধান।
৭) বনের ভিতরে গাছপালা বা ডাল ভাঙ্গা এবং পাতা ছিঁড়া থেকে বিরত থাকুন।
কিছু টিপস-
১) রাতারগুলে খাবার হোটেল পাবেন না । তাই খাবার বা নাস্তা সিলেট শহর থেকে সেরে আসলেও ভালো। অথবা সাথে করে নিতে পারেন৷
২) রাতারগুল ভ্রমনের পাশাপাশি চলে যেতে পারেন সাদাপাথর অথবা বিছানাকান্দি।রাতারগুল থেকে সি এন জি রিজার্ভ ভাড়া ৩০০ টাকা ।
৩) এক নৌকায় ৫-৬ জন যেতে পারবেন। সুতরাং ৫ জন অথবা ১০ জনের গ্রুপ করে আসলে ভালো।সিএনজি এবং নৌকা দুই ক্ষেত্রেই সুবিধা পাবেন।
৪) অফ সীজনে পানি শুকিয়ে যাওয়াতে চৌরাঙ্গি ঘাট থেকে হেঁটে সামনে গেলে নৌকা পাওয়া যাবে।