25.6 C
Dhaka
Thursday, October 2, 2025

দখল দূষণে বিপর্যস্ত চট্টগ্রামের জীবননালী কর্ণফুলী

আরও পড়ুন

নির্বিচারে নগরবাসীর গৃহস্থালি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের শিল্পবর্জ্য , অনিয়ন্ত্রিত পরিবেশ দূষণ,  ক্রমাগত  দখলের কারণে ধীরে ধীরে  মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে  বন্দরনগরী চট্টগ্রামের জীবননালীখ্যাত কর্ণফুলী নদী। কর্ণফুলী নদীর সুরক্ষায় নয় হাজার কোটি টাকার সরকারি প্রকল্প থেকে শুরু করে হাইকোর্টের নির্দেশনা ও মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন—কোনো কিছুই সুরক্ষা দিতে পারছে না লুসাই কণ্যা কর্ণফুলীকে।নদীর উভয় তীর দখল করে গড়ে তোলা হচ্ছে শত শত আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন। এসব ভবনের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীর পানিতে। এই দখল বর্জ্যের কারণে একসময়ের প্রমত্ত কর্ণফুলী ক্রমাগত সংকুচিত হতে হতে যেন বিলীনপ্রায় খালে পরিণত হয়েছে।

নদী কর্ণফুলী নদী রক্ষায় নানা সময়ে রাজনীতিবিদরা যেমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন,  নির্দেশনা এসেছে আদালত থেকেও। এছাড়াও, এটি দখল ও দূষণমুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছে জাতীয় নদী সংরক্ষণ কমিশন। এসবের জেরে তিন বছর আগে কর্ণফুলীকে দূষণ ও দখলমুক্ত করতে একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছিলো। আলোর মুখ দেখেনি সেটিও।

কর্ণফুলী ও হালদা নদীকে রক্ষায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের নানা উদ্দ্যেগও কাজে লাগে নি। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী আক্ষেপ করে জানালেন, ‘ বন্দর, জেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে বেপজা সবাই নদীর তীর ইজারা দিচ্ছে। যারা নদীর দুই তীর দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করছেন তারা রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী । তীর দখল করে বেসরকারি কনটেইনার টার্মিনাল  গড়ে তোলা হয়েছে। ড্রাই ডক নির্মান করা হচ্ছে – কোনভাবেই কর্ণফুলী নদীকে সুরক্ষা দেয়া সম্ভব নয়। ‘

মনজুর আহমেদ বলেন, শুধু চট্টগ্রামবাসীর জন্য নয়, সারাদেশের জন্য কর্ণফুলী নদী গুরুত্বপূর্ণ। এখানে দূষণ আছে। দূষণের চেয়েও দখল বেশি। এসব কারণে নৌ চলাচল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।বিভিন্ন সময়ে  আমরা পরিদর্শন করেছি ।  জেলা প্রশাসক, সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম বন্দরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সমস্যার সমাধান হয়েছে অল্প, বেড়েছে বেশি। দখলের পরিমাণও বেড়েছে। ‘

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বলছে কর্ণফুলী নদী দখল করে চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় তৈরি হচ্ছে ব্যক্তিমালিকানাধীন ‘ড্রাই ডক’। এতে নদী সংকুচিত হচ্ছে। নদীসংক্রান্ত আইন ও হাইকোর্টের রায় লঙ্ঘন করে এই স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। কর্ণফুলী নদীর বাম তীরে আনোয়ারা উপজেলার বদলপুরা মৌজায়, সাগরের মোহনা থেকে দুই কিলোমিটার উজানে এই ড্রাই ডক তৈরি হচ্ছে। যেখানে এই নির্মাণকাজ চলছে, নদীর ঠিক অন্য পারে একইভাবে নদী দখল করে আরও স্থাপনা তৈরি হয়েছে, কিছু স্থাপনা তৈরির প্রস্তুতিও চলমান। কর্ণফুলী নদীতেই একেবারে নদীর ভিতরের জায়গা দখল করে বেশ কয়েকটি ডক ইয়ার্ড, মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র করা হয়েছে।

মেরিন একাডেমির পাশে কর্ণফুলী ড্রাই ডক গড়ে উঠেছে নদী দখল করে। ড্রাই ডকটির আশপাশে আরও বেশ কিছু অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠলেও  চোখ বন্ধ প্রশাসনের।

এভাবে বছরের পর বছর ধরে নাব্যতা কমে যাওয়ার কারণে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কেন্দ্রিক নৌ-বাণিজ্য। একইসাথে  লাগামহীন দূষণে ঝুঁকিতে পড়েছে জনস্বাস্থ্য ও নদীর জলজ বাস্তুতন্ত্র।স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, কর্ণফুলীর বহু উদ্ভিদ ও মৎস্য প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে, বহু প্রজাতি আজকাল কর্ণফুলীতে দেখাই যায় না।

১৯৫৩ সালে তৎকালীন পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভেলাপমেন্ট কর্পোরেশন (পিআইডিসি) উন্নতমানের কাগজ উৎপাদনের জন্য নদীর তীরে কর্ণফুলী পেপার মিল প্রতিষ্ঠা করে। নিষ্কাশন ও পরিশোধনের কোন সুব্যবস্থা না থাকায় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ মিলের বর্জ্য পদার্থ নদীতে ফেলা শুরু হয়। সেই থেকে কর্ণফুলী নদীর পানি দূষিত হতে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মাত্রাতিরিক্ত দূষণের ফলে কর্ণফুলী থেকে দ্রুত মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীর মাছের উৎসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাছের প্রজনন কমে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের মোহনায়। ফলে সাগরে মাছের মজুদের পরিমাণও দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে।

এ নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বছরে প্রায় পঞ্চাশ  হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় হলেও দখলে-দূষণে মুমূর্ষু হয়ে পড়েছে সোনার ডিম পাড়া হাঁস কর্ণফুলী নদী।

- Advertisement -spot_img

সবশেষ খবর