24.5 C
Dhaka
Friday, October 3, 2025

‘ কালুরঘাট ফেরির ইজারা ‘ ভাঙতে শুরু করেছে সিন্ডিকেট

আরও পড়ুন

::: তানভীর আহমেদ :::

কালুরঘাট সেতু সংস্কারকারকালীন সময়ে ফেরি চলাচলের ইজারা নিয়ে গড়ে উঠা সিন্ডিকেট অবশেষে ভেঙেছে। বুধবার  (২ রা আগস্ট) ফেরি ইজারার টেন্ডার ড্রপ করেছে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। ঠিকাদারদের প্রতিযোগিতামুলক অংশগ্রহণে সরকারের অন্তত অর্ধ কোটি টাকা রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে।

ছয় মাসের জন্য ফেরি ইজারা নিতে আগ্রহী প্রতিষ্ঠান মেলেনি এমন খোঁড়া যুক্তিও ঠিকলো না। চতুর্থ ও পঞ্চম দফা টেন্ডারে মাহফুজ এন্টারপ্রাইজ নামের একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান ফেরির ইজারা নিতে দর প্রস্তাব জমা দিলেও সপ্তম দফা টেন্ডারে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক প্রতিষ্ঠান টেন্ডারে অংশ নিয়েছে।

জানা যায়, সপ্তম দফা টেন্ডারে   মাহফুজ এন্টারপ্রাইজ দরপ্রস্তাব করেছে এক কোটি ৫৫ লাখ টাকা ৮০ হাজার টাকা। সর্বশেষ টেন্ডারে প্রতিষ্ঠানটি ১ কোটি সাত লাখ টাকা দরপ্রস্তাব জমা দিয়েছিলো। আমরীন এন্টারপ্রাইজ প্রস্তাব করেছে এক কোটি চল্লিশ লাখ নয়শত তিরাশী টাকা। সুলতান ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান দর প্রস্তাব জমা দিয়েছে এক কোটি টাকা। একে এন্টারপ্রাইজ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান ১ কোটি আটারো লাখ ৭৫ হাজার টাকা দর প্রস্তাব জমা দিয়েছেন।’

ফেরি ইজারা নিতে আগ্রহী সিন্ডিকেটের কারণে দর মিলছে না – উল্লেখ করে দৈনিক এই বাংলা সংবাদ প্রচার করলে নড়েচড়ে বসে সড়ক ও জনপদ বিভাগ। পুনরায় রি টেন্ডার করার কারণে প্রায় ৪৯ লাখ টাকা বৃদ্ধি করেছে একই দরপ্রস্তাবকারী। টেন্ডারে অংশ নিয়েছে বেশ কটি প্রতিষ্ঠানও।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল যোগাযোগ শুরুর আগে সংস্কার কাজের জন্য তিন মাসের জন্য কালুরঘাট সেতু বন্ধ করে দেওয়া হয় গত মঙ্গলবার দুপুরে। নদীর ওই অংশ পারাপারের জন্য চালু করা হয় ফেরি। সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান  ফেরি সার্ভিস চালুর জন্য ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা যায় নি। যত দ্রুত সম্ভব ফেরি চালু করা হবে। এরই মধ্যে ৩টি ফেরি সেতুর নিচে রাখা হয়েছে । দুইটি  ফেরি চলাচল করবে। অপরটি রিজার্ভে থাকবে। ‘

চট্টগ্রামের দু:খখ্যাত কালুরঘাট সেতুর সংস্কারের ধুয়ো তুলে কোটি কোটি টাকা লোপাট করার অভিযোগ  সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমার বিরুদ্ধে। কালুরঘাট সেতু মেরামত কাজ শেষ করে কক্সবাজার রুটে ট্রেন চলাচল শুরুর পরিকল্পনা নতুন করে লুটপাটের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আগামী ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পুরনো কালুরঘাট সেতু মেরামত কাজ শেষ করে কক্সবাজার রুটে ট্রেন চলাচল উদ্বোধনের কথা রেলপথ মন্ত্রণালয় জানালেও একটি সংঘবদ্ধ চক্রকে ফেরির ইজারাদার হিসেবে নিয়োগে ‘সময়ক্ষেপন’ করা হয়েছে।

চট্টগ্রামের কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপর রেলওয়ে কাম সড়ক সেতুটি নির্মিত হয়েছিল ১৯৩০ সালে। নানা ইতিহাসের সাক্ষী এবং উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামকে সংযুক্তকারী এ সেতুকে ২০০১ সালে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা দেওয়া হয়।এরপরও সেতুটির ওপর দিয়ে চলাচল করছে ট্রেন থেকে শুরু করে সব ধরনের হালকা ও ভারী যানবাহন। এ সেতুতে ১০ টনের বেশি ভারি যানবাহন নিষিদ্ধ।তবে ট্রেন চলে ঘণ্টায় মাত্র ১০ মাইল বেগে। অবকাঠামো একবারেই নড়বড়ে।

কিন্ত কালুরঘাট  ফেরি থেকে টোল আদায়ের জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগ পরপর ছয় দফা টেন্ডার আহ্বান করার পরও টেন্ডারে একটি সিন্ডিকেট ছাড়া কেউই অংশ নিতে পারে নি।  সরকারি অর্থ লুটপাটের  পরিকল্পনা অনুযায়ী ফেরি ইজারায় আভ্যন্তরীণ  সমঝোতা হয়েছে  । প্রথম তিন  দফা টেন্ডারে কোন প্রতিষ্ঠানই আগ্রহ দেখান নি ফেরির ইজারা নিতে। চতুর্থবার রি টেন্ডারে দুটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেন। চতুর্থ বারের টেন্ডারে দুটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। পঞ্চম দফা টেন্ডার আহবান করা হলে জমা পড়ে একটি প্রতিষ্ঠানের দরপত্র। এক কোটি সাত লাখ টাকা দর কোড করে সিন্ডিকেটভুক্ত একমাত্র প্রতিষ্ঠান।

পরে ষষ্ঠ দফা টেন্ডার আহ্বান করা হলে ছয়টি প্রতিষ্ঠান সিডিউল ক্রয় করে।  ১১ ই জুলাই ষষ্ঠ বারের দরপত্র ড্রপিংএর দিনে কোন প্রতিষ্ঠানই দরপত্র জমা দেয় নি। অনুসন্ধানে জানা যায়  ছয় প্রতিষ্ঠানের নামে দরপত্র ক্রয় তরে  ‘একই ব্যক্তি ‘। দরপত্র ক্রয় করে জমা না দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলো হলো  আমরিন এন্ড ব্রাদার্স, মাওয়া এন্টারপ্রাইজ, মাহফুজ এন্ড ব্রাদার্স, মেসার্স ফ্লোরা ব্রাদার্স এন্ড ব্রাদার্স, আমরিন এন্ড মাওয়া জিবি, আমরিন এন্ড মাওয়া – ফ্লোরা ব্রাদার্স লিমিটেড।পরের বার রি টেন্ডার করার কথা থাকলেও পঞ্চম দফা টেন্ডারে অংশ নেয়া একটি প্রতিষ্ঠানের দরকে বিবেচনায় নিয়ে সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা ফেরিটির ইজারা চুড়ান্ত করার সুপারিশ করেছিলেন । ফলে প্রতিযোগিতামুলক দরে ফেরির ইজারা প্রক্রিয়া সিন্ডিকেটের ছক অনুযায়ী বাধাগ্রস্ত হয়।৬ থেকে ৭ মাসের জন্য ফেরির টোল আদায়ের টেন্ডারে কোনো প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখাচ্ছে না ; এমন অজুহাতে সিএস তৈরি করতে উঠেপড়ে লাগে চক্রটি ।

পরপর তিন দফা টেন্ডার আহ্বান করা হলেও তাতে কোন প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়নি বলে জানান সড়ক ও জনপথ বিভাগ চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা।

পঞ্চমবার দরপত্র জমা দেয়া একমাত্র প্রতিষ্ঠান মাহফুজ এন্ড ব্রাদার্স  ও ষষ্ঠবার দরপত্র ক্রয় করা বাকি পাঁচ প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত  মনসুর আলম পাপ্পী ও তার সহোদর ববি আলম। ‘ মাহফুজ এন্ড ব্রাদার্স’ এর নামে এক কোটি সাত লাখ টাকা দর কোড করার নেপথ্যে মনসুর আলম পাপ্পী। সুত্রমতে, নতুন করে রি টেন্ডার না করে মাহফুজ এন্ড ব্রাদার্সকে ইজারা দেয়া সুপারিশ করতে ঘুষ লেনদেন করা হয়েছিলো দেড় কোটি টাকা। সিন্ডিকেটের পরিকল্পনা মতো  তড়িঘড়ি করে ইজারা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার সুপারিশ করেছিলেন নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা।

জানা যায়, দরপত্রে কোন প্রতিষ্ঠান অংশ নিতে আগ্রহী নয় ; এমন ধুয়ো তুলে সড়ক ও জনপথ বিভাগের নিজস্ব উদ্যোগে টোল আদায় করার ছক তৈরি করে নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা। তিনি একই পদ্ধতিতে কোন টেন্ডার ছাড়াই বিভাগীয় পদ্ধতির টোল আদায়ের নামে পোর্ট এক্সেস রোডের ‘ ঠিকাদার দিয়ে’ টোল আদায় করছেন প্রায় দেড় বছর ধরে।এই বিষয়ে লিখিত অভিযোগ জমা দেয় একটি প্রতিষ্ঠান। পরে পুনরায় টেন্ডার করার সিদ্ধান্ত নেয় সড়ক ও জনপদ বিভাগ।

জানতে চাইলে সড়ক ও জনপদ বিভাগ চট্টগ্রামের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জাহেদ হোসেন বলেন, ফেরি ইজারায় সিন্ডিকেটের বিষয়ে লিখিত  অভিযোগ পাবার পর রি টেন্ডার করা হয়েছে । যেহেতু আগ্রহী প্রতিষ্ঠান বেড়েছে পুনরায় টেন্ডার আহবান করা হবে। ‘

চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতু ‘সড়ক ও জনপদ ‘ বিভাগের কাছে যেন সোনার ডিম পাড়া হাঁস। ফেরি চলাচলের  এপ্রোচ সড়ক নির্মানের কথা বলে লুটপাট করা হয়েছে অন্তত তিন কোটি টাকা। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায় সড়কটি পূর্ব থেকেই বিদ্যমান ছিলো। অথচ একই এপ্রোচ সড়ক নির্মানের কথা বলে লুটপাট করা হয়েছে সরকারি অর্থ।

জানা যায় , মেয়াদোত্তীর্ণ কালুরঘাট সেতুর চাপ কমাতে সড়ক ও জনপদ বিভাগ প্রায় ৪ কোটি ১০ লাখ টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করে । সেতু থেকে প্রায় ২০০ গজ দূরে কালুরঘাট ফরেস্ট ডিপো এলাকায়  এই প্রকল্পের কাজ দেখানো হলেও সড়কটি অনেক আগেই বিদ্যমান ছিলো। চট্টগ্রামের সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) তথ্য অনুযায়ী , বোয়ালখালী অংশে ফেরি চলাচলের জন্য ঘাট নির্মাণে ব্যয় করা হয়েছে  ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। আর পূর্ব মোহরা বা শহরের অংশে ব্যয় করা হয়েছে  ২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।

কয়েক দিনের মধ্যে শুরু হচ্ছে চট্টগ্রামের ৯২ বছরের পুরনো কালুরঘাট সেতুর সংস্কারকাজ। দোহাজারী-কক্সবাজার রুটে ট্রেন চলাচল শুরুর আগে সেতু মজবুত করতে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংস্কারকাজের সময় বন্ধ থাকবে সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন ও যানবাহন চলাচল। তবে যানবাহন বিকল্প পদ্ধতিতে চলাচলের জন্য সেতুর নিচ দিয়ে ফেরি সার্ভিসের ব্যবস্থা করেছে  সড়ক ও জনপদ বিভাগ। কালুরঘাট সেতুর সংস্কার শেষ না হওয়া পর্যন্ত টোলের মাধ্যমে ফেরি সার্ভিস চলবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেহেতু সিন্ডিকেট ভাঙতে শুরু করেছে  ফেরিটির ইজারা প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা গেলে রাজস্ব বাড়বে সরকারের। আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে তাই ইজারার নিয়ম অনুযায়ী  পুনরায় টেন্ডার আহবান করা উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এইবাংলা/ তুহিন

- Advertisement -spot_img

সবশেষ খবর