নাদিরা শিমু :::
চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে প্রবাসীদের আনা ২৫ টন কার্গো পণ্য খালাস করা হয় নি। ‘এ’ ফর্ম জমা দেবার পরও চারমাস ধরে এসব পণ্য ছাড় না করার কারণে ওয়ারহাউজের মাশুল গুনতে হবে প্রবাসীদের। শাহ আমানত বিমানবন্দরে কার্গো পণ্য খালাস এবং কার্গো ফ্লাইট বন্ধ থাকার বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হবার পরও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় নি। ঈদে পাঠানো প্রবাসীদের ২৫ মেট্রিক টন পণ্য নষ্ট হচ্ছে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের ওয়্যারহাউসে। চার মাস ধরে বন্ধ ব্যাগেজ রুলের আওতায় আনা প্রবাসীদের কার্গো পণ্যের খালাস। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাগেজ রুলের নামে তাদের বঞ্চিত করা অযৌক্তিক। তবে কাস্টমসের দাবি নিয়মের বাইরে থাকা পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শাহ আমানত বিমানবন্দরের কার্গো হাউজে স্তুপ করে রাখা এসব পণ্য থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। ধারনা করা হচ্ছে শুকনো খাবার জাতীয় পণ্য পচে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। তবুও কাস্টমস কমিশনারের গোঁয়ার্তুমির পারদ নামে নি।
চট্টগ্রামের কাস্টমস কমিশনার নাজিউর রহমানের কাছে এই বিষয়ে জানতে চেয়ে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেন নি। তবে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শাহ আমানত বিমানবন্দরে প্রবাসীদের আনা কার্গো পণ্য নিয়ে ঝামেলাটা মুলত কমিশনারের ব্যক্তিগত। কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পণ্য খালাস বন্ধ রাখা হয়েছে। অথচ প্যাসেঞ্জারের তথ্য যাচাই করা হয়েছে ; তাদের ‘এ’ ফর্ম জমা নেয়া হয়েছে। ছাড় বন্ধ রাখতে কমিশনার কার্গোতে বাণিজ্যিক পণ্য আনার ধুঁয়ো তুলেছেন। এক্ষেত্রে উনার যুক্তি একশো কেজির উপরে আনা পণ্য বাণিজ্যিক হতে পারে। কিন্তু ব্যাগেজ রুলে যৌক্তিক পরিমানের কথা বলা হয়েছে ; কার্গো পণ্যের ক্ষেত্রে একশো কেজির কোন সীমারেখা আইনে নেই। এসআরও তে প্রবাসীদের ব্যাগেজ রুলের আওতায় আনা যাবে এমন ২৬ ধরনের পণ্যের কথা বলা হয়েছে সেগুলোর ওজন পাঁচশো কেজিও হতে পারে। ‘
উপ কাস্টমস কমিশনার বদরুজ্জামান মুন্সি বলেন, ‘ ব্যাগেজ রুলের অপব্যবহার করে বাণিজ্যিক পণ্য আনা ঠেকাতে এসব কনসাইনমেন্ট আটকে রাখা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে আইপি জমা দিলে প্রবাসীদের আনা এসব পণ্য ছাড় করা হবে। ‘
সহকারী কাস্টমস কমিশনারের বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী আবুল হাসেম বলেন, ‘ প্রবাসীরা চোরাচালানের সাথে জড়িত নয়। তারা আত্নীয় স্বজনের জন্য উপহার নিয়ে আসেন। নিজের পরিবারের জন্য শুল্ক পরিশোধ করে পণ্য আনেন। তাদেরকে আইপি সংগ্রহ করতে বলা মানেই হাইকোর্ট দেখানো। তারা তো বাজারে বিক্রি করার জন্য এসব পণ্য আনেন নি। নিজ পরিবারের ব্যবহারের জন্য আনা পণ্যের আইপি সংগ্রহ করার নজির দেশের কোথাও নেই। ‘
সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী ইমাম হোসেন বলেন, প্রবাসীদের কষ্টে উপার্জন করা ঘাম ঝরানো টাকায় কেনা পণ্য খালাস আটকে রেখে দেশের ক্ষতি করা হচ্ছে। কার্গো ফ্লাইট বন্ধ করে বিমানবন্দরের রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ক্ষতির সম্মুখীন। শাহ আমানত থেকে ফিরতি কার্গো ফ্লাইটে করে চট্টগ্রামের রপ্তানকারকরা মধ্যপ্রাচ্যে সবজি পাঠাতে পারছেন না। ঢাকা দিয়ে সবজি মধ্য প্রাচ্যে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন রপ্তানিকারকরা। খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে রপ্তানি আয় কমে যাচ্ছে। এগুলো একটার সাথে আরেকটা কানেক্টেট। রাস্ট্রের ক্ষতির তোয়াক্কা না কার্গো খালাস বন্ধ করে দেয়ার মতো এমন হটকারি সিদ্ধান্ত কার স্বার্থে নিয়েছেন কমিশনার; এটি খুঁজে বের করা জরুরি। ‘
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ড. শিরিন আহমেদ মনে করেন, চলমান অর্থনৈতিক সংকটে প্রবাসীদের আনা কার্গো পণ্য ছাড় করা বন্ধ রাখার প্রভাব পড়বে ভোক্তা পর্যায়ে। একই সাথে ডলারের উপর চাপ বাড়বে।
তিনি বলেন, প্রবাসীরা নিজেদের সাথে করে গুঁড়ো দুধ, স্যাম্পু, চকলেট, প্রসাধনী, গৃহস্থালি পণ্য এনে থাকেন। এখন যদি সেগুলোর একটি অংশ বাজারেও যায় তাহলে আমদানির উপর চাপ কমবে। কারণে সে হয়তো পাঁচটি দুধ এনেছে ; তিনটি নিজের পরিবারের জন্য। ধরেন দুটি বাজারে বিক্রি করা হলো। তাহলেও তো পাঁচটি দুধের টিনের চাহিদা কমেছে। কারণ চাহিদা থাকার কারণে ডলার সংকটের মধ্যেও বিদেশ থেকে তো নিয়মিতভাবে দুধ আমদানি করতে হচ্ছে। ধরে নিলাম ওই প্রবাসী নিজের ব্যবহারের অতিরিক্ত পণ্য পাইকারি দোকানে বিক্রি করে দিলো ; এমন পরিস্থিতিতেও ডলারের উপর স্বল্প মেয়াদে চাপ কমে। ‘
অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম ও শাহ আমানত বিমানবন্দরে কার্গো পণ্য খালাসে জটিলতা তৈরি করে রাখার কারণে কার্গো বাবত লাভের গুড় পৌঁছে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থার পকেটে। ইমিরেটস,ফ্লাই দুবাই, সৌদি এয়ার, কাতার এয়ার, ইউএস বাংলা -এই ছয়টি ফ্লাইটের যাত্রীদের ব্যাগেজ এলাউয়েন্সের অতিরিক্ত পণ্যের জন্য বাড়তি চার্জ দিতে হচ্ছে যাত্রীদের। ফ্লাইটে সবচেয়ে ব্যয়বহুল অংশ হলো ব্যাগেজ (লাগেজ) চার্জ। এয়ারলাইনসগুলো এজন্য টিকিটের দামের বাইরেও বাড়তি টাকা নেয়। এ কারণে ব্যাগেজের বাড়তি খরচের কারণে ফ্লাইটে প্রবাসীদের দেশে ফেরা হয়ে যাচ্ছে ব্যয়বহুল। জানা যায়, বিদেশ থেকে দেশে ফেরার সময় ফ্লাইট ও শ্রেণীবেদে ওজন চার্জ ছাড়াই ত্রিশ থেকে চল্লিশ কেজি মালামাল বিনা খরচে আনতে পারেন একজন যাত্রী।কোন যাত্রীর এয়ারপোর্টে পণ্যের ওজন বেশি হলে তারা সেটি তাৎক্ষণিক কার্গো করে দিতেন। এখন যেহেতু সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর ও শাহ আমানত বিমানবন্দরে কার্গো ফ্লাইট চালু নেই বাধ্য হয়ে চারগুন বেশি চার্জে নিয়মিত ফ্লাইটে এসব পণ্য আনতে হচ্ছে। এতে প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের অপচয় হচ্ছে। ‘
প্রবাসী বাংলাদেশিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রতিটি এয়ারলাইন্সের টিকিট প্রতি যাত্রী কত কেজি ওজনের লাগেজ সঙ্গে নিতে পারবেন তা নির্ধারিত। কোন এয়ারলাইন্স ২০ কেজি আবার কোন এয়ারলাইন্স ৪০ কেজি পর্যন্ত লাগেজ বহনের সুবিধা দেয়। একারণে বাড়তি পণ্য দেশে পৌঁছে দিতে দুবাই এয়ারপোর্টের কাছাকাছি স্থানে বেশকিছু কার্গো হাউজ গড়ে উঠেছে। একই পরিস্থিতি সৌদি আরব এবং কাতারেও। এয়ারপোর্টে আসার পর কোন যাত্রী যদি অতিরিক্ত পণ্য নিয়ে ঝামেলায় পড়েন, কার্গো হাউজগুলো তাৎক্ষণিক সেটি বুকি নিয়ে নিজেরাই বাড়তি পণ্য এয়ারপোর্ট থেকে সংগ্রহ করেন। পরে কার্গো হাউজ সেই পণ্য ‘কার্গো ফ্লাইটে’ করে গন্তব্যে পৌঁছে দিতেন। এখন কার্গো ফ্লাইট বন্ধ, সেকারণে কার্গো হাউজের ব্যবসাও লাটে উঠেছে। উল্টো যাত্রীরা কার্গো পণ্য খালাস করতে না পেরে সৌদি, দুবাইয়ের ওইসব কার্গো হাউজের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। একই সাথে দেশে ফেরার খরচ ( লাগেজ চার্জ) বেড়ে গেছে ৫০ থেকে একশো ডলার।
সংশ্লিষ্টদের মতে, চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে প্রতিনিয়ত অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক রুটে যাত্রী বাড়ছে। এই বিমানবন্দরে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যে যোগাযোগ শুরু করেছে ইতিহাদ, এমিরেটস এবং কাতার এয়ারওয়েজ। অনিয়ম কার্গো ফ্লাইট, কার্গো পণ্য খালাস নিয়ে ধারাবাহিক জটিলতার কারণে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে রেটিং কমে যাবে শাহ আমানতের।
এইবাংলা /তুহিন