বড় কাটরা ও ছোট কাটরা, এগুলো শুধু স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন নয়, বরং বাংলার মুঘল আমলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের এক অমূল্য দলিল। সময়ের সাথে সাথে গেলেও আজও এ স্থাপনাগুলো ঢাকার ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
১৭শ’ শতকের শুরুর দিকে বাংলায় মুঘল শাসন দৃঢ় ভিত্তি লাভ করে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে ঢাকাকে বাংলার সুবাহ বা প্রদেশের রাজধানী করা হয়। সেই সময় থেকেই ঢাকার নগরায়ন শুরু হয় এবং নদীবন্দরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে বাণিজ্যকেন্দ্র।
ব্যবসায়ীরা আসতে শুরু করেন আরব, পারস্য ও ইউরোপ থেকে। ফলে এখানে প্রয়োজন হয় অতিথিশালা বা সারাইখানার, যেখানে আগত ব্যবসায়ী, ভ্রমণকারী ও সরকারি দূতেরা অবস্থান করতে পারবেন। এ চাহিদা থেকেই মুঘল আমলে নির্মিত হয় বড় কাটরা ও ছোট কাটরা।
বড় কাটরা: মহিমার প্রতীক
১৬৪৪ সালে মুঘল সুবাদার শাহশুজা ঢাকায় বড় কাটরার নির্মাণকাজ শুরু করেন। বলা হয়, এটি মূলত তাঁর রাজপ্রাসাদ হিসেবেই নির্মিত হয়েছিল। তবে পরবর্তীতে এটি ব্যবহৃত হয় ব্যবসায়ীদের সারাইখানা ও সরকারি অতিথিশালা হিসেবে। “কাটরা” শব্দটি এসেছে আরবি “কাত্রা” থেকে, যার অর্থ আঙিনা বা প্রাঙ্গণঘেরা ভবন।
বড় কাটরার নকশা ছিল মুঘল স্থাপত্যের অনন্য উদাহরণ। বিশাল আয়তাকার প্রাঙ্গণের চারপাশে ছিল দ্বিমঞ্জিলা ভবন। পূর্ব দিকে প্রধান প্রবেশদ্বারটি ছিল দৃষ্টিনন্দন খিলানযুক্ত। প্রবেশের পর দেখা যেত প্রশস্ত আঙিনা, যা নানা কার্যক্রমের কেন্দ্র ছিল। ভবনের নিচতলায় ছিল গোদামঘর ও দোকান, আর উপরের তলায় অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা। বলা হয়, এখানে একসময় ২০০ জন পর্যন্ত যাত্রী অবস্থান করতে পারতেন।
স্থাপত্যশৈলীতে মুঘল আমলের সূক্ষ্মতা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। অত্যন্ত সুন্দর এবং মনোমুগ্ধকর কারুকার্য, খিলান, গম্বুজ ও সুষমা-ভিত্তিক নকশা এ স্থাপনাকে গৌরবময় করে তুলেছিল। যদিও সময়ের সাথে সাথে অনেকাংশ ভেঙে পড়েছে এবং দখলদারদের অবহেলায় বিকৃত হয়েছে, তবুও এর মূল কাঠামো আজও দর্শকদের ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দেয়।
ছোট কাটরা: সরল সৌন্দর্যের নিদর্শন
১৬৬৪ সালে সুবাদার শায়েস্তা খাঁর আমলে ছোট কাটরার নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল বলে ইতিহাসবিদদের ধারণা। ছোট কাটরা আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট হলেও স্থাপত্যে ছিল একেবারে নিখুঁত। এটি মূলত মুঘল কর্মকর্তাদের সারাইখানা হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
ছোট কাটরার স্থাপত্যে রয়েছে সমমিতি ও কারুকাজের সমন্বয়। আয়তাকার প্রাঙ্গণের চারদিকে ছিল ছোট ছোট কক্ষ। খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বার, লাল ইটের দেয়াল ও চুনসুরকির প্রলেপ একে গাম্ভীর্য দান করেছিল। ছোট কাটরা ব্যবসায়ী ও ভ্রমণকারীদের স্বল্পমেয়াদি অবস্থানের জন্য আদর্শ ছিল।
আজও যারা পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকায় যান, তারা ছোট কাটরার ভগ্নপ্রায় কাঠামো দেখে থমকে দাঁড়ান। ইতিহাসের ছাপ থাকা সত্ত্বেও এ ভবনটিও দখলদারদের কারণে অনেকটা বিকৃত হয়ে গেছে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভূমিকা
কাটরাগুলো শুধু অতিথিশালা নয়, বরং ব্যবসায়ী ও ভ্রমণকারীদের মিলনকেন্দ্র ছিল। এখানে দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীরা অবস্থান করতেন, ব্যবসার পরিকল্পনা করতেন, এমনকি বাণিজ্যিক চুক্তিও হতো। ঢাকার মসলিন বাণিজ্যের সাথে কাটরার সম্পর্ক ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বিদেশি ব্যবসায়ীরা এখানে থেকে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগ করতেন এবং পণ্য রপ্তানির পরিকল্পনা করতেন।
এছাড়া কাটরাগুলো সামাজিক আড্ডার স্থান হিসেবেও পরিচিত ছিল। ভ্রমণকারীরা এখানে বসে তাঁদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতেন, কবিতা আবৃত্তি বা সংগীত পরিবেশন হতো। এভাবে কাটরা ছিল এক অর্থে বহুজাতিক সাংস্কৃতিক বিনিময়ের কেন্দ্র।
বর্তমান অবস্থা ও সংকট
দুঃখজনক হলেও সত্য, বড় কাটরা ও ছোট কাটরার বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। দীর্ঘদিনের অবহেলা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং স্থানীয় দখলদারদের কারণে ঐতিহাসিক এই স্থাপনাগুলো প্রায় ধ্বংসের কাছাকাছি। অনেক জায়গা ভেঙে বসতবাড়ি বা দোকান তৈরি হয়েছে। মূল কাঠামোর কারুকাজ মুছে গেছে।
ইতিহাসবিদ ও স্থাপত্যবিদরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানাচ্ছেন, এসব স্থাপনা সংরক্ষণের জন্য জরুরি উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কিছু পদক্ষেপ নিলেও তা পর্যাপ্ত নয়। পর্যটকদের আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে এগুলোকে পুনর্গঠন করা গেলে দেশের ঐতিহ্য যেমন রক্ষা পাবে, তেমনি অর্থনীতিতেও অবদান রাখবে।
সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
বড় কাটরা ও ছোট কাটরা শুধু ইট-পাথরের স্থাপনা নয়, এগুলো আমাদের ইতিহাস ও পরিচয়ের অংশ। এগুলো ধ্বংস হলে হারিয়ে যাবে বাংলার মুঘল ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সংরক্ষণ ও পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে এগুলোকে পর্যটনকেন্দ্রে রূপান্তর করা সম্ভব।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি সঠিক পরিকল্পনা নেওয়া হয়, তবে এগুলোকে ঢাকার ঐতিহাসিক ট্যুরিজম সার্কিটে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এতে পর্যটকরা লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিলের পাশাপাশি বড় কাটরা ও ছোট কাটরাও ঘুরে দেখতে পারবেন। এভাবে প্রাচীন ঢাকার ঐতিহ্য নতুন প্রাণ ফিরে পাবে।
ঢাকার ইতিহাস শুধু কেল্লা বা প্রাসাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং বড় কাটরা ও ছোট কাটরার মতো স্থাপনাগুলোও এ নগরের সমৃদ্ধ অতীতের সাক্ষী। এগুলো শুধু স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন নয়, বরং বহুজাতিক বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের কেন্দ্র ছিল। আজ অবহেলার কারণে ধ্বংসের পথে হলেও যথাযথ পদক্ষেপ নিলে এগুলো আবারও জাগ্রত হতে পারে।
ঢাকার ইতিহাস জানতে চাইলে বড় কাটরা ও ছোট কাটরাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই সময় এসেছে সরকার ও নাগরিক সমাজ একসাথে এগিয়ে আসার, যেন এই অমূল্য ঐতিহ্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম বেঁচে থাকে।
এই বাংলা/এমএস
টপিক