ইসলাম এমন এক জীবনব্যবস্থা, যা মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শিষ্টাচার, সম্মান ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। ইসলামী সভ্যতার সৌন্দর্য কেবল ইবাদত বা আইন-কানুনে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর প্রাণশক্তি নিহিত রয়েছে মানুষের প্রতি আচরণে। ইসলাম বলে, যে সমাজে আল্লাহভীতি ও মানবমর্যাদার বোধ গভীর, সেই সমাজেই প্রকৃত ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
রাসূলুল্লাহ (সা.) মানুষের সম্মানবোধকে আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধার সঙ্গে সম্পর্কিত করেছেন।
এই প্রেক্ষাপটে মহানবী (সা.) এক হাদিসে তিন শ্রেণির মানুষের প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন—
عَنْ أَبِي مُوسَى الْأَشْعَرِيِّ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ مِنْ إِجْلَالِ اللَّهِ إِكْرَامَ ذِي الشَّيْبَةِ الْمُسْلِمِ، وَحَامِلِ الْقُرْآنِ غَيْرِ الْغَالِي فِيهِ وَالْجَافِي عَنْهُ، وَإِكْرَامَ ذِي السُّلْطَانِ الْمُقْسِطِ
‘আবূ মূসা আল-আশ’আরী (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ নিশ্চয়ই বৃদ্ধ মুসলিমকে সম্মান করা, কুরআনের ধারক-বাহক ও ন্যায়পরায়ণ শাসকের প্রতি সম্মান দেখানো মহান আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অন্তর্ভুক্ত।’ (আবু দাউদ, হাদিস ৪৮৪৩)
হাদিসের ব্যাখ্যা
১. “إِنَّ مِنْ إِجْلَالِ اللَّهِ” — ‘আল্লাহকে সম্মান করার অন্তর্ভুক্ত’ এখানে إجلال অর্থ সম্মান, শ্রদ্ধা, মর্যাদা ও ভক্তি।
২. “إِكْرَامَ ذِي الشَّيْبَةِ الْمُسْلِمِ” — ‘বৃদ্ধ মুসলিমকে সম্মান করা’ এখানে বলা হয়েছে, ইসলামে বার্ধক্যকে অবহেলার নয়, বরং মর্যাদার প্রতীক বলা হয়েছে। বৃদ্ধ মুসলিমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন মানে তাঁর অতীত আমল, ইবাদতের অভিজ্ঞতা, ও দ্বীনের দীর্ঘ সম্পর্ককে শ্রদ্ধা করা।
“ مَا أَكْرَمَ شَابٌّ شَيْخًا لِسِنِّهِ إِلاَّ قَيَّضَ اللَّهُ لَهُ مَنْ يُكْرِمُهُ عِنْدَ سِنِّهِ ” .
“যে ব্যক্তি একজন বৃদ্ধকে তার বার্ধক্যের কারণে সম্মান করে, আল্লাহ তাকে তার বৃদ্ধ বয়সে সম্মান প্রদান করবেন।” (তিরমিজি, হাদিস: ২০২২) অর্থাৎ, আল্লাহ তাঁর জন্য এমন মানুষ সৃষ্টি করবেন যারা তাঁকে একইভাবে শ্রদ্ধা করবে। সমাজে প্রজন্মগত সৌজন্য, আদব ও শ্রদ্ধা ইসলামী সভ্যতার একটি মৌলিক মূল্যবোধ। এই হাদিস সেই সংস্কৃতির ভিতকে মজবুত করে।
৩. “وَحَامِلِ الْقُرْآنِ” — ‘কোরআনের ধারক-বাহককে সম্মান করা’ এখানে حامل القرآن বলতে হাফেজ বা আলেম উভয়কেই বোঝায়, আর এই হাফেজ আলেম বলতে প্রচলিত ধারায় শুধু মাদরাসায় পড়ে হাফেজ বা মাওলানা হওয়া উদ্দেশ্য নয়।
৪. “وَإِكْرَامَ ذِي السُّلْطَانِ الْمُقْسِطِ” — ‘ন্যায়পরায়ণ শাসককে সম্মান করা’ এখানে বলা হয়নি সুলতান (শাসক) মাত্রকে, বরং المقسط — অর্থাৎ “ন্যায়পরায়ণ শাসক”। কারণ ইসলামে শাসকের প্রতি আনুগত্য শর্তসাপেক্ষ—সে যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে এবং আল্লাহর বিধান মেনে চলে। ন্যায়পরায়ণ শাসককে সম্মান করা আল্লাহর বিধানকে সম্মান করার সমতুল্য, কারণ সে পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে। রাসুল (সা.) বলেছেন: “ন্যায়পরায়ণ শাসক হবে আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিদের অন্যতম এবং কিয়ামতের দিন তিনি আরশের ছায়ায় আশ্রয় পাবেন।” (বুখারি, হাদিস : ৬৬০)
ইসলামী সমাজব্যবস্থায় শাসকের প্রতি বিদ্বেষ নয়, বরং ন্যায়ভিত্তিক সহযোগিতা, উপদেশ ও দোয়ার মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এই হাদিস ইসলামী সভ্যতার এক মহান নৈতিক নীতিকে প্রতিফলিত করে— “যে আল্লাহকে ভালোবাসে, সে আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করবে; আর আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ পায় তাঁর প্রিয় বান্দাদের সম্মান করার মাধ্যমে।”