24 C
Dhaka
Friday, October 3, 2025

সাজ্জাদের শিষ্য ‘মামুন’, সামলাচ্ছেন গুরুর সাম্রাজ্য

আরও পড়ুন

::: রাহাত আহমেদ :::

চট্টগ্রামের আলোচিত এইড মার্ডারের মাস্টার মাইন্ড বিদেশে পালিয়ে থাকা শিবিরের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ দীর্ঘদিন থেকে পালিয়ে বেড়ালেও চট্টগ্রামে তার দাপট কমেনি কিঞ্চিত পরিমানও। গুরু সাজ্জাদের সাম্রাজ্য পাহারা দিচ্ছেন শিষ্য আবদুল্লাহ আল মামুন। শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদের নামে চট্টগ্রাম শহরের বায়েজিদ থানার ওয়াজেদিয়া, চালিতাতলী, হাজীরপুল, চান্দগাঁও এলাকার শমসের পাড়া, পাঁচলাইশ থানার বিবিরহাট এলাকায় চাঁদাবাজি চলছে নিরবে। ভূঁইপোড় সংগঠন ‘বাংলাদেশ জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদ’এর নেতা পরিচয় দিয়ে সাজ্জাদের চাঁদাবাজি ও বাহিনীর সমন্বয় করছে ‘আব্দুল্লাহ আল মামুন’।

সাজ্জাদের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করা মামুনের নির্দেশনায় চলা  ৬ জনের নিয়ন্ত্রণে ৫টি গ্রুপে সদস্য  রয়েছে প্রায় চল্লিশ জন। এরা সাধারণত তৃণমূল পর্যায়ে  থেকে ৫ ধরনের কাজ করে। বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের মোবাইল নাম্বার ও পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা তাদের প্রধান কাজ। এসব বিষয়ে সেকেন্ড লেভেলকে অর্থাৎ সাজ্জাদের সেকেন্ড ইন কমান্ডদের অবহিত করে পরবর্তী নির্দেশনা নেয়া। নির্দেশনা অনুযায়ী চাঁদার দাবিতে ব্যবসায়ীকে ফোন করে হুমকি দেয়া। প্রয়োজনীয় অস্ত্র মজুদ ও ব্যবহার করা এবং চাঁদার টাকা গ্রহন করে সেকেন্ড ইন কমান্ড মামুনকে পৌঁছে দেয়া।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সাজ্জাদের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে সক্রিয়  মামুন ক্ষমতাসীন দলের ভুঁইপোড় সংগঠনের ছায়া নিয়ে নিম্ন  পর্যায়ের  পাঁচজনকে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। তারা হলেন মো: ফিরোজ, মুন্না , সরওয়ার ওরফে বাবলা, নূরনবী ওরফে ম্যাক্সন ও মঈনুদ্দিন রাশেদ ওরফে ভাগিনা রাশেদ।  ইতিমধ্যে এদের মধ্যে সরওয়ার  এবং মো: ফিরোজ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছে। এইড মার্ডার ছাড়াও একটি অস্ত্র মামলায় ২১ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত নুর নবী ওরফে ম্যাক্সন গেল বছর ভারতের কোলকাতায় আশ্রয়দাতা এক নারীর হাতে মারা গেছেন।

শিবির ক্যাডার  সাজ্জাদের সহযোগী আবদুল্লাহ আল  মামুন, বেলাল উদ্দিন মুন্না  , চট্টগ্রামের দুর্ধর্ষ শিবির ক্যাডার ও পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ২২ মামলার আসামি নুরনবী ওরফে ম্যাক্সন সম্পর্কে পুলিশের কাছে চাঞ্চল্যকর তথ্য রয়েছে। তথ্যের ভিত্তিতে   গত বছর বেলাল উদ্দিন মুন্না(৪৩), মোঃ নাজিম উদ্দিন হিরুকে (৩৪) গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী  সাজ্জাদের চাঁদাবাজি ও জমিদখল, কন্ট্রাক কিলিং কাজের সমন্বয় করছেন আবদুল্লাহ আল মামুন।

প্রতিবেদকের হাতে আসা একটি অডিও রেকর্ড অনুযায়ী মামুনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সাজ্জাদের রেখে যাওয়া অস্ত্রের ভান্ডার। ফরমায়েশ অনুযায়ী মামুনের বাড়ির দাঁড়োয়ানের কাছ থেকর কিশোররা অস্ত্র সংগ্রহ করে আনেন। সেই অডিওতে চট্টগ্রামের আরেকজন পরিচিত সন্ত্রাসীকে মামুনের অস্ত্রভান্ডারের বর্ণনা দিতে শুনা যায়। বর্ণনা অনুযায়ী বেশকটি একে ২২,  এক নলা বন্দুক, বিদেশী রাইফেল, টুটু, রিভলভার রয়েছে মামুনের কাছে।

প্রতিবেদকের হাতে দুটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় প্রকাশ্যে অস্ত্রহাতে রাস্তায় অবস্থান নিয়েছে কিছু কিশোর। স্থানীয়দের কাছে জানতে চাইলে তারা কিশোর গ্যাংটির নিয়ন্ত্রক হিসেবে প্রকাশ করেছেন মামুনের নাম।

২০০০ সালের ১২ জুলাই চট্টগ্রামে আট ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী হত্যায় নিম্ন আদালতে ফাঁসির দণ্ড পাওয়া  সাজ্জাদ, এরআগেই গ্রেপ্তার এড়াতে ২০০৪ সালের দিকে দুবাই পালিয়ে যান।  সাজ্জাদকে ধরতে ইন্টারপোলে ‘রেড নোটিস’ এখনও ঝুলছে। গেল সপ্তাহে একটি মামলায় সাজ্জাদকে কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

চট্টগ্রামে ২২ বছর আগে অস্ত্র উদ্ধারের মামলায় তিনজনকে ২০ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত। তাঁরা হলেন ‘শিবির ক্যাডার’ হিসেবে পরিচিত সাজ্জাদ আলী খান, দেলোয়ার হোসেন ওরফে আজরাইল দেলোয়ার ও আলমগীর ওরফে বাইট্টা আলমগীর। গত বুধবার প্রথম অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ মো. কামাল হোসেন শিকদার এ রায় দেন।সরকারি কৌঁসুলি এম এ ফয়েজ  বলেন, আদালত তিন আসামিকে অস্ত্র মামলায় ১৭ বছর এবং পুলিশের কাজে বাধাদান ও হামলার দায়ে ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডসহ ২০ বছর করে কারাদণ্ড দেন। দীর্ঘ বাইশ বছর পরে কারাদণ্ড পাওয়া  আজরাইল দেলোয়ার ক্রসফায়ারে নিহত হন দেড় যুগ আগে।

সাজ্জাদের সাম্রাজ্য পাহারা দিতে শিল্পএলাকা খ্যাত বায়েজিদ, বিবিরহাটে শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ে তিনটি কিশোর গ্যাং প্রতিষ্ঠা করেছেন আব্দুল্লাহ আল  মামুন। জানা যায়,  এসব কিশোরদের কাছেই তুলে দেয়া হয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদের অস্ত্রভান্ডার। কিছুদিন আগে একটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অস্ত্রসহ ধরা পড়লে, তাদের স্বীকারোক্তিতে ফাঁস হয় আব্দুল্লাহ আল মামুনের নাম। এ ঘটনায় একটি মামলাও করে পুলিশ। (মামলা নং- ১৩৬/১৬)।

গত বছর চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী থানার চালিতাতলী এলাকায় একটি তোষক কারখানায় আগুন দেওয়ার পর  আলোচনায় আসে বিদেশে বসে শিবিরের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদের চাঁদাবাজি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে তার সহযোগীরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-বাড়িতে গিয়ে চাঁদা দাবি করেন। দাবি মতো টাকা না পেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় সেসব প্রতিষ্ঠান কিংবা বাড়িতে। আর বিদেশে বসে পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন সাজ্জাদ। দেশে পুরো প্রক্রিয়া দেখভাল করার দায়িত্ব আবদুল্লাহ আল মামুনের কাঁধে। আর মামুনের হয়ে কিশোর গ্যাং  দেখভাল করেন ওয়াজেদিয়া এলাকার জনৈক এনাম।

অনুসন্ধান জানা যায়, ২০০২ সালে ভিন্ন নামে  জাল পাসপোর্ট তৈরি করে মধ্যপ্রাচ্যে পালিয়ে যান সাজ্জাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী  এই আবদুল্লাহ আল  মামুন। প্রতিবেদকের হাতে আসা পাসপোর্ট অনুযায়ী ‘নিজের নাম’ ‘পিতার নাম ‘ পরিবর্তন করে মামুন পাসপোর্টটি সংগ্রহ করেছিলেন ২০০২ সালের ১৯ শে মে। সেই পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয় ২০০৭ সালের ১৮ ই মে। ‘ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ‘ নামে সেই জাল পাসপোর্টটি তৈরি করেছিলেন মামুন। নিজের পিতার নাম মোহাম্মদ ইউনুচ হলেও পাসপোর্টে লিখেছেন ‘ মোহাম্মদ আলী’। হাটহাজারী উপজেলার দক্ষিণ মাদার্শার ঠিকানা ব্যবহার করে এই জাল পাসপোর্ট তৈরি করেন আব্দুল্লাহ আল মামুন। ২০০৭ সালের ৩রা আগস্ট সেই জাল পাসপোর্টটি নবায়নও করা হয়েছে। সুত্রমতে,  দুবাইয়ে শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ,  মামুনের ছত্রছায়ায় আস্তানা গেড়েছিলেন।  দেশ থেকে পালিয়ে এইড মার্ডারের আসামী ‘বেলাল উদ্দিন মুন্না’ যোগ দিয়েছিলেন তাদের সাথে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের মতে , ২০১২ সালে ভারতে আটক হয়েছিলেন সাজ্জাদ। তবে ভারতের কারাগার থেকে জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর সাজ্জাদের ‘চাঁদাবাজির উৎপাত’ আরও বেড়ে যায়। আব্দুল্লাহ আল মামুনই মুলত সাজ্জাদের হয়ে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন  বায়েজিদ থানার ওয়াজেদিয়া, চালিতাতলী, হাজীরপুল, চান্দগাঁও এলাকার শমসের পাড়া, পাঁচলাইশ থানার বিবিরহাট এলাকায়।চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে  তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ আলীর অন্যতম সহযোগী মো. এনাম গ্রেফতার হবার পর আবারও প্রকাশ্যে আসে আবদুল্লাহ আল মামুনের নাম।

জানা গেছে, বায়েজিদ, চান্দগাঁও ও পাঁচলাইশ থানার বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি নির্মাণ থেকে শুরু করে জমি ক্রয়-বিক্রয়, জমি ভরাট, সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, শিল্পকারখানা থেকে ভাসমান দোকান ও পরিবহন স্ট্যান্ড কেন্দ্রিক বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে সক্রিয় বিদেশে পলাতক ইন্টারপোলের রেড নোটিশধারী শিবিরের  শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ বাহিনী। বিভিন্ন ব্যবসায়ী, নির্মাণাধীন ভবন মালিক ও শিল্পকারখানার মালিকদের ফোন করে চাঁদা দাবি করেন তিনি ; মামুন নিজের কিশোর গ্যাং দিয়ে সংগ্রহ করে চাঁদা। তার কথামতো চাঁদা না দিলে টার্গেট করা ব্যক্তির বাসাবাড়ি কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গুলিবর্ষণ, পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ ও অগ্নিসংযোগ করে মামুনের নেতৃত্বাধীন তিন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।

পুলিশের তথ্যমতে,  ২০১১ সালের ৪ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের বিশ্বরোড চৌরাস্তার মোড় থেকে চট্টগ্রামের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ও শিবির ক্যাডার সরওয়ার এবং ম্যাক্সনকে ( বর্তমানে মৃত) গ্রেপ্তার করে নগরের বায়েজিদ বোস্তামি থানার তৎকালীন ওসি এ কে এম মহিউদ্দিন সেলিম। পরে গ্রেপ্তার দুজনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পুলিশ সেই বছরের ৬ জুলাই ভোর ৪টায় বায়েজিদ থানার ওয়াজেদিয়া হামিদপুর এলাকায় তাঁদের সহযোগী শিবির ক্যাডার মানিকের বাড়ির পেছনে পুকুরপাড় থেকে এক বস্তা অস্ত্র উদ্ধার করে।অস্ত্রগুলোর মধ্যে ছিল একটি একে-৪৭ রাইফেল ও ২৭ রাউন্ড গুলি, একটি বিদেশি পিস্তল ও তিন রাউন্ড গুলি, দেশে তৈরি একটি বন্দুক, একটি দেশি ওয়ান শুটার গান এবং একটি এলজি।

২০২১ সালে ৬ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানার নয়াহাট এলাকায় এক গাড়ির যন্ত্রাংশ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চাঁদা দাবির পর তার বাড়িতে বোমা ছোড়া হয়েছিল। ওই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে ২০২২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সাজ্জাদের আরেক সহযোগী সরোয়ারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায় মামুন। গ্রেপ্তার হওয়া সরওয়ারও মামুনের মতো দুবাই থেকে দেশে ফিরেছিল। সাম্প্রতিক সময়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আরেকটি সন্ত্রাসী গ্রুপ দলবল নিয়ে গিয়ে সাজ্জাদের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেন। আগুন নিভিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বুড়ির নাতি সাজ্জাদ , সোহাগপাড়ার খোকন , সৈয়দ পাড়ার সাব্বিরসহ কিশোর গ্যাং লিডারদের নিয়ে সাজ্জাদের বাড়িতে  অবস্থান নেয়  আবদুল্লাহ আল মামুন।

মহানগর গোয়েন্দা উত্তর বিভাগের একটি টিম গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত বছরের ৩রা আগস্ট বায়েজিদ থানাধীন ভক্তপুর এলাকায় অভিযান পরিচালনা চালিয়ে  বেলাল উদ্দিন মুন্না(৪৩), মোঃ নাজিম উদ্দিন হিরুকে (৩৪) গ্রেফতার করে পুলিশ। অনুসন্ধানে জানা যায় ভারতের পাঞ্জাবে শিবির ক্যাডার সাজ্জাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন বেলাল উদ্দিন মুন্না ও আব্দুল্লাহ আল মামুন। প্রতিবেদকের হাতে আসা ছবিতে বরবেশে সাজ্জাদের সাথে দেখা যায় বেলাল উদ্দিন মুন্না ও মামুনকে। পাঞ্জাবের সেই বিয়ের আসরে শিবির ক্যাডার সাজ্জাদের বউসহ মামুনের বেশকিছু  ছবিও মিলেছে অনুসন্ধানে। বিয়ের একটি ছবিটি দেখা যায় আবদুল্লাহ আর মামুন ও শীর্ষ সন্ত্রাসী  সাজ্জাদ পাঞ্জাবি নাচে মত্ত। এছাড়া একাধিক ছবিতে ‘ জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদের  বিতর্কিত মনির খান ওরফে দর্জি মনিরের সাথে দেখা গেছে এই আবদুল্লাহ আল মামুনকে।

দীর্ঘ বিশ বছর ধরে শিবিরের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী  সাজ্জাদের সাম্রাজ্য পাহারা দেয়া বিভিন্ন সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের পর কারাগার থেকে ছাড়িয়ে নেবার দায়িত্বও পালন করে আসছেন ‘আবদুল্লাহ আল মামুন’। নথি অনুযায়ী ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি সাজ্জাদ গ্রুপের  দুই সন্ত্রাসী ফারুক ও মইনুল হোসেনের জামিননামায় স্বাক্ষর করেছেন মামুন। দুইজনই ২০১৪ সালে একনলা বন্দুক, গোলাবারুদ ও মোটর সাইকেলসহ পুলিশের  গ্রেফতার হয়েছিলেন।

মামুনের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বর্ণনা দিতে গিয়ে মোহাম্মদ আলমগীর ও রুবেল নামের দুই ব্যবসায়ী জানান,  ‘ আবদুল্লাহ আল  মামুনই মুলত সাজ্জাদের হয়ে চট্টগ্রামে চাঁদাবাজি, জমিদখল, ফরমায়েশি খুনের সমন্বয় করেন। শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে সাজ্জাদ  ফোন করে চাঁদার ফরমায়েশ জানান। পরে মামুন নিজের বাহিনী ব্যবহার করে সেই চাঁদা আদায় করে সাজ্জাদের কাছে পাঠান। মামুনের কিশোর গ্যাংয়ের ভয়ে কেউই মুখ খুলেন না। নতুন বাড়ি নির্মান, জমি ক্রয়- সবকিছুতেই এলাকার প্রতিটি বাড়ি মালিককেও গুনতে হয় চাঁদা।  ‘

যেভাবে সাজ্জাদের সাথে সখ্যতা :

সাজ্জাদের ঘনিষ্ঠ সুত্রমতে ১৯৯৯ সালের ২ জুন স্থানীয় কাউন্সিলর লিয়াকত হত্যা এবং ২০০০ সালের ১২ জুলাই শহরের বহদ্দারহাটে ব্রাশ ফায়ারে ছাত্রলীগের ৮ জন কর্মীকে হত্যার দুটি ঘটনার আগেই  শিবিরের সাজ্জাদ ও ফাইভস্টার জসিম, মামুনের বাসায় অস্ত্র মজুদ রাখা হয়েছিলো।

পরবর্তীতের তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে ২০০০ সালের ১০ জুন মামুন পাড়ি জমায় দুবাইতে। সেখানে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তার ভিসা বাতিল করে দেশে ফেরত পাঠায় দুবাই সরকার। পরে দেশে এসে তথ্য গোপন করে মো: আব্দুল্লাহ নামে নতুন একটি পাসপোর্ট তৈরি করে ২০০৩ সালের দিকে আবার দুবাই পাড়ি জমায় মামুন। পরে দেশে থাকা শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ ২০০৪ সালের শেষের দিকে র‌্যাবের অভিযানে টিকতে না পেরে দুবাই গিয়ে মামুনের আশ্রয়ে ওঠে। সেখানেই পুনরায় সংগঠিত হয় সাজ্জাদের বাহিনী।

দুবাই প্রবাসীদের সাথে কথা বলে জানা  যায়, সেখানে গিয়ে মামুন ও সাজ্জাদ নামমাত্র টাইলসের ব্যবসা শুরু করলেও সেখানে বসেই চট্টগ্রামের চাঁদাবাজি ও অস্ত্রের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতো একসাথে।  দুবাইয়ে সাজ্জাদের সাথে ভারতের পাঞ্জাবের জাকৌজে নামে একটি মেয়ের সম্পর্ক হলে ২০১০ সালে দুবাইর হায়াত এজেন্সিতে ছোট পরিসরে বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়।  কিছুদিন পরে ভারতের পাঞ্জাবে পাঞ্জাবি রীতি অনুযায়ী বিয়ের অনুষ্ঠান হয় শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদের । সেখানে সাজ্জাদের জমজমাট বিয়ের আয়োজনে আবদুল্লাহ আল  মামুন মোটা অংকের টাকা খরচ করে। ওই বিয়েতে মামুন ও সাজ্জাদকে পাঞ্জাবি সাজে একসাথে দেখা যায়।

পাঞ্জাবে বিয়ের আসরে সাজ্জাদের সাথে মামুন।

জানা যায়,  ২০১২ সালের ৭ নভেম্বর সাজ্জাদ ভারতে গ্রেফতার হওয়ার পর তার জামিনের ব্যাপরে মামুন ৩০ লাখ টাকার  ব্যয় করেছিলেন। সাজ্জাদের মা বেঁচে থাকাকালীন বেশ কবার মামুনের সাথে নিয়ে  ভারতে গিয়ে ছেলে সাজ্জাদের সাথে দেখা করেছিলেন। বিদেশে অবস্থান করা শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদের পরিবারের দেখভালের দায়িত্ব পড়ে মামুনের উপর।

অনুসন্ধানে জানা যায়,  রাউজানের ছাত্রদলের খোকন নামে এক সন্ত্রাসী  বিভিন্ন সময়ে পুলিশের হাতে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়ে অস্ত্রের মূল মালিক ‘মামুন ‘ বলে স্বীকারোক্তি দেয়। মামুনের চাচাতো ভাই রবিন নগরীর কালারপুল এলাকায় অস্ত্রসহ গ্রেফতার হলে ওই অস্ত্রও মামুনের কাছ থেকে সংগ্রহ করা বলে পুলিশকে জানায় রবিন।

হিন্দু সম্প্রদায় লোকের জায়গা দখল করতে গিয়ে ব্যর্থ হবার পর ওই জায়গা সংক্রান্ত ইস্যুতে উজ্জল কুমার দেয়ানজী নামে একজন জানান, জায়গাটি দখল করতে না পেরে শিবির ক্যাডার সাজ্জাদকে দিয়ে ফোনে হুমকি ও চাঁদা দাবি করায় মামুন। পরে জায়গার মালিকসহ কয়েকটি সংগঠন মিলে প্রেসক্লাবের সামনে মামুনের বিরুদ্ধে মানববন্ধনও করেছিলো।

অনুসন্ধানে পাওয়া কল রেকর্ড অনুযায়ী, ভারতে ম্যাক্সন মারা যাবার পর ‘সরওয়ার’কে সাথে নিয়ে মামুন সাজ্জাদের  সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ পুন:প্রতিষ্ঠা করেছেন। মামুনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন, আইসিটি এ্যাক্ট, মারামারি ও জায়গা দখল, চাঁদাবাজির অভিযোগে সাধারণ ডায়েরীসহ বেশ কয়েটি মামলা রয়েছে।

বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন বকসুনগর এলাকার মৃত ইউনুসের ছেলে আব্দুল্লাহ আল মামুন বর্তমানে নগরীর আন্ডারওয়ার্ল্ডে নিজের পতাকা উড়িয়ে রাজত্ব করলেও প্রশাসনের নিরবতায় হতাশা জানিয়েছেন এলাকাবাসী । সাজ্জাদের চাঁদাবাজির হাতিয়ার হিসেবে মামুন ব্যবহার করে চলেছেন এলাকায় গজিয়ে উঠা  উশৃংখল কিশোর গ্যাংকে। আর এভাবেই দীর্ঘ সময় ধরে গুরু সাজ্জাদের সাম্রাজ্য পাহারা দিচ্ছেন অনুগত শীর্ষ আবদুল্লাহ আল মামুন।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেন, ‘ পালিয়ে থাকা  সাজ্জাদের নামে চাঁদাবাজির বিষয়ে বিভিন্ন সময় পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে। এই বাহিনী সদস্যদের ছদ্মবেশের কারনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেক সময় বিভ্রান্ত হয়। সাজ্জাদের শিষ্য মামুন সম্পর্কে  তথ্য দিলে পুলিশ অবশ্যই কার্যকর  ব্যবস্থা নেবে। ‘

এইবাংলা /তুহিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

সবশেষ খবর