নিজস্ব প্রতিবেদক :::
চট্টগ্রামে এক যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে একটি ভবন দখলের অভিযোগ উঠেছে। ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রামের গোলপাহাড় মোড়ে। অভিযুক্ত যুবলীগ নেতার নাম আরশাদুল আলম বাচ্চু ; তিনি উমর গণি এমইএস কলেজ ছাত্রসংসদের সাবেক জিএস। ভবন দখলে নিতে বাচ্চুকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেন কে বি আব্দুল জলিল ওরফে বাহাদুর নামের আরেক ভূমিদস্যু।
নগর যুবলীগের শক্তিধর নেতা ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহীবুল হাসান নওফেলের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত এরশাদুল আলম বাচ্চু, চট্টগ্রামের স্কুল ছাত্র ‘জাকির হোসেন সানি’ খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন সময় মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, নিউমার্কেট, জিইসি এলাকায় ছাত্রজনতার উপর অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন বাচ্চু বাহিনীর সন্ত্রাসীরা।
জানা গেছে, দখলকৃত ভবনে গত ১৯ বছর ধরে এমএফসি নামক একটি রেষ্টুরেন্ট (বর্তমানে র্যাবসন কেয়ার নামে) ব্যবসা করে আসছিলেন। হঠাৎ করে বাচ্চু ও আব্দুল জলিল বাহাদুরের লোকজন এসে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ব্ন্ধ করে চলে যেতে হুমকি প্রদান করেন। পরবর্তীতে বাচ্চুর লোকজন ভবনের সামনে লোকজন জড়ো করে কলাপসিবল গেট স্থাপন করেন। সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ করে ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের ভবনে প্রবেশে বাধা দেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অস্ত্রসহ কিছু যুবক এসে চালু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান র্যাবসন কেয়ার বন্ধ করে দেন। এরা এম এইচ কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক জিএস আসাদূল আলম বাচ্চু ও স্থানীয় ভূমিদস্যু কে বি আব্দুল জলিল ওরফে বাহাদুরের অনুসারী নিশ্চিত করেন স্থানীয়রা। আরশাদুল আলম বাচ্চুর বিরুদ্ধে ২০২১ সালে চাদাঁবাজির অভিযোগ এনে চট্টগ্রাম কোতয়ালী থানায় দন্ডবিধির-১৪৩, ৪৪৮, ৩২৩, ৩০৭, ৩৮০, ৩৮৫, ৪২৭, ৫০৬ এবং ৩৪ ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন জনৈক সোহেল রানা। যিনি এশিয়ান কমপ্লেক্সের নিচ তলায় অটো জন-২ নামে একটি মোটর পার্টস ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। রাজনেতিক প্রভাবের কারণে তখনও বাচ্চুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নি পুলিশ।
এছাড়াও যুবলীগ নেতা বাচ্চুর বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। বাচ্চু চট্টগ্রামের বিলবোর্ড সিন্ডিকেটের হর্তাকর্তা হিসেবে গড়ে তুলেন নিজের বলয় ‘ বাচ্চু বাহিনী ‘। গোলপাহাড় এলাকার শীর্ষ ভুমিদস্যু জলিল ওরফে বাহাদুরের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গেও সখ্যতা গড়ে বানিয়েছেন দখলদারিত্বে নজিরবিহীন সাম্রাজ্য । এছাড়া চট্টগ্রামের পটিয়া আসনের সাবেক সংসদ ও হুইপ শামসুল চৌধুরীর পুত্র শারুনের ব্যবসায়ীক পার্টনার আরশাদুল আলম বাচ্চু। শারুন আলোচিত মুনিয়া আত্নহত্যার পর দেশজুড়ে আলোচনায় আসেন। অভিযোগ আছে হুইফ পুত্র শারুন মুনিয়া হত্যার প্ররোচনার জড়িত ছিলেন।
উচ্ছেদের শিকার হওয়া ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত কর্মচারী আব্দুল হক জানান, আরশাদুল আলম বাচ্চুর ব্যবসায়ী অংশীদার নাজমুল করিম শারুনও এমএফসি ভবন দখলে জড়িত ছিলেন। বাচ্চু বাহিনী স্টাফদের বের করে দিয়ে সিসিটিভি ক্যামেরা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ‘
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শারুন এবং আরশাদুল আলম বাচ্চু চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে সোনা চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন গত দশ বছর যাবত। এছাড়া ব্যাংক কর্মকর্তা মোরশেদ আত্নহত্যার প্ররোচনাকারী হিসাবেও গণমাধ্যমের শিরোনাম হন দুই গুরু শীর্ষ।
যেভাবে দখল হলো ভবন
চট্টগ্রামের গোলপাহাড় মোড় এলাকার এমএফসি ভবন দখলের ঘটনাটি ঘটেছে পুলিশের নিরবতায় মধ্য দিয়ে। গত ১৪ মার্চ আরশাদুল আলম বাচ্চুর অনধিকার প্রবেশ ও ব্যবসায় প্রতিবন্ধকতা তৈরীর অভিযোগ এনে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন এমএফসির কর্নধার ও র্যাবসন কেয়ারের ( অন্য ফ্লোরে অবস্থিত) পার্টনার শরফুল হক।
অভিযোগপত্র অনুযায়ী, ভবনটির মালিকের সাথে রেজিষ্টার্ড ভাড়াটিয়া চুক্তির পাশাপাশি জমি বিক্রয় সংক্রান্ত চুক্তি করেছিলেন শরফুল হকের বড়ভাই । ২০১২ সালের ১৭ জানুয়ারি বাড়ির মালিকের সঙ্গে রেজিস্টার্ড ভাড়াটিয়া চুক্তি (দলিল-১১৫৬) সম্পাদন করা হয়েছিল। আর বিক্রয় সংক্রান্ত রেজিস্টার্ড চুক্তিনামা সম্পাদিত হয় ( দলিল নং-৮২৫৯) ২০২১ সালের ২৯ শে জুন ।
খোজঁ নিয়ে জানা গেছে, ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর যুবলীগ নেতা আরশাদূল আলম বাচ্চু বাড়ির মালিকের ছেলের সঙ্গে অবৈধ আরেকটি বায়না চুক্তি করেন। যদিও একটি চুক্তি বলবৎ থাকা অবস্থায় অনেকটি চুক্তির আইনগত ভিত্তি নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বাচ্চুর অনুকূলে করা চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। এরপরও রাজনৈতিক প্রভাব ও সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে পুরো ভবনটি দখল করে নেয় আরসাদুল আলম বাচ্চু ও বাহাদুর।
আদালত ও পুলিশের কাছে অভিযোগ তোয়াক্কা না করে অবস্থায় চালু ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে পুরো ভবন দখল করে নেয়ার বিষয়টি ‘কব্জির জোর’ ছাড়া আর কিছু নয়, বলছেন ভুক্তভোগীরা।
আদালতের নথি অনুযায়ী এই ভবন নিয়ে চট্টগ্রামের ২য় যুগ্ম জজ আদালতে মামলা নং ১০১/২৩ চলমান রয়েছে। ভাড়াটিয়া চুক্তির পাশাপাশি ভবন মালিকের সাথে ভূমি বিক্রির বায়না চুক্তিও রয়েছে ভাড়াটিয়া পক্ষের। এই বিষয়ে আদালতে প্রতিকার চেয়ে ভুক্তভোগী বিজ্ঞ ৫ম সিনিয়র সহকারী জজ আদালত চট্টগ্রামে অপর মোকদ্দমা নং – ৫৮/২৪ দায়ের করেন এবং বিজ্ঞ আদালতে ভুক্তভোগের নালিশর বিষয়ে সন্তুষ্ট হয়ে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেন।
৫৮/২৪ মামলায় অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশের সময় বাড়ানোর আবেদন করলে বিজ্ঞ আদালত অস্থায়ী আদেশের সময় বর্ধিত করে ১লা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বলবৎ রাখেন। এরপরও বাচ্চু -বাহাদুর ও শারন গোষ্ঠীর জবরদখলের তান্ডব থামানো যায় নি । তারা আদালতের নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিনে দুপুরে ভবনটি দখল করে নেয় ; স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে জানা যায়।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী শরিফুল হক বলেন, আমি অসুস্থতার কারণে ভারতে ছিলাম। শুরুতে দলবল নিয়ে কোন ধরনের আলাপ আলোচনা ছাড়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে গেট নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ বাড়ি মালিকের সঙ্গে আমার ভাড়াটিয়া চুক্তি বলবৎ রয়েছে। এবং আমি প্রতি মাসে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে ভাড়া প্রদান করে রশিদ গ্রহণ করে আসছিলাম। এছাড়া একই জমির বিষয়ে বিক্রয় চুক্তিনামাও আছে আমাদের।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগীর শ্যালক সাংবাদিক তানভীর হাসান গত ১৬ মার্চ চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন। অভিযোগে অনধিকার প্রবেশ ও ব্যবসায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি অভিযোগ আনা হয়েছিলো আরশাদুল আলম বাচ্চু ও তার অন্যতম সহযোগী কেবি আব্দুল জলিল বাহাদুরের বিরুদ্ধে।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সন্তোষ চাকমা।
তিনি বলেন, অভিযোগ পেয়েছিলাম। তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় তারা ভবনটি দখল করে নেয় বলে জানতে পেরেছি । ‘
স্থানীয়দের ভাষ্য, সন্ত্রাসী আরশাদুল আলম বাচ্চু ও কেবি আব্দুল জলিল বাহাদুর আদালতের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গত ২৭ মার্চ সকাল সাড়ে ৮টায় জোর করে প্রবেশ করে পুরো ভবন দখল নেন।
ভুক্তভোগীর ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ব্যবসা চালু অবস্থায় ভবনের মূল ফটোকে কলাপসিবলগেট নির্মাণ ও সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ করে আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদর্শন করে জোরজুলুমের রাজত্ব ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পুরো ভবনটি জবরদখল করছে। তাদের যুক্তি বায়না চুক্তি দলিল যদি ভূমির মালিকানা নির্দেশ করে তাহলে ভবনটির মালিকানা তো ভাড়াটিয়ার।
দখলের প্রক্রিয়া চলাকালীন ২৭ মার্চ সকালের ঘটনায় ভুক্তভোগীরা ৯ই এপ্রিল পাঁচলাইশ থানায় মামলা দায়ের করতে গেলে পুলিশ মামলা নিতে রাজি হন নি।
এরপর গত ১০ এপ্রিল ভুক্তভোগীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালায়। এতে প্রতিষ্ঠানের চেয়ার-টেবিল ভাঙচুরসহ স্টাফদের মারধর করে বের করে দেয় যুবলীগ নেতা বাচ্চু ও তার দলবল।
জানা যায়, এ ঘটনায়ও আদালতে মামলা করেন ভুক্তভোগী শরফুল হক। ( মামলা নং ২৯/২৪)।
ঢাকা জজ কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট হাসিনা বেগম বলেন, যে সম্পত্তির নামজারি নেই সেই সম্পত্তি সাব কবলা অথবা বায়না চুক্তি বৈধতা নেই।
ভবন দখলের বিষয় জানতে চেয়ে আরশাদুল আলম বাচ্চুর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তার মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত, ৫ই আগস্ট ছাত্র জনতার তুমোল আন্দোলনে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার পর গা ডাকা দিয়েছেন নগরের আলোচিত যুবলীগ নেতা বাচ্চু বাহিনীর প্রধান আরশাদুল আলম বাচ্চু।