25.3 C
Dhaka
Thursday, October 2, 2025

ইয়াবা সাম্রাজ্যের ডন সাইফুলের টাকায় শিল্পপতি জসিম

আরও পড়ুন

রাহাত আহমেদ ::

কক্সবাজারের ইয়াবা সিন্ডিকেটের সেকেন্ড ইন কমান্ড বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়া সাইফুলই কপাল খুলে দিয়েছিলো চন্দনাইশ উপজেলা চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিনের। ২০১৯ সালের ৩১ মে বন্দুকযুদ্ধে নিহত টেকনাফের ইয়াবার গডফাদার সাইফুল করিমকে কৌশলে দেশে পাঠিয়েছিলেন জসিম উদ্দিন। দেশের সাবেক এক শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা ও চট্টগ্রাম রেন্জের তৎক্ষালীন ডিআইজির সাথে বিশ কোটি টাকা দফারফা করে দেশে ফেরার পরপরই কথিত বন্দুক যুদ্ধে নিহত হন সাইফুল করিম।

সাইফুল করিমের ঘনিষ্ঠ একটি সুত্রে জানিয়েছে, সাইফুল টেকনাফ সদর ইউনিয়নের শীলবনিয়া পাড়া এলাকার হানিফের ছেলে। বন্দুক যুদ্ধে নিহত হওয়ার আগে তিনি দুবাই ছিলেন। দুবাইয়ে স্বর্ণ চোরাচালান, ইয়াবা ও হুন্ডির ব্যবসায় জড়িত ছিলেন সাইফুল করিম। সেই সুত্রে জসিম উদ্দিনের সাথে পরিচয় তার।

বন্দুক যুদ্ধে নিহত সাইফুল করিম

একই সুত্র জানিয়েছে, সাইফুল ইয়াবা বিক্রির টাকা দিয়ে কাজীর দেউড়ি ভিআইপি টাওয়ারসহ একাধিক স্থানে অভিজাত অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছিলেন জসিমের মাধ্যমে। পরে আত্নসমর্পণের কথা বলে সাইফুলকে দেশে এনে পুলিশের কব্জায় তুলে দেন ২০১৯ সালে ২৩ শে এপ্রিল। দেশে ফেরার পর চট্টগ্রামের খুলশি এলাকায় রাখা হয় সাইফুল করিমকে।

সুত্রমতে, ২০১৯ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি টেকনাফে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের উপস্থিতিতে সাইফুল করিম আত্মসমর্পণ করার কথা ছিলো। কিন্তু দুবাই থাকার কারনে আত্নসমর্পণ করতে ব্যর্থ হন।

জসিম উদ্দিনের মধ্যস্ততায় ২০১৯ সালের ২৭ শে মে সাইফুল দেশে ফিরলেও তাকে শেষ পর্যন্ত  আত্নসমর্পণ করার সুযোগ দেয়া হয় নি। পুলিশের নথি অনুযায়ী ৩০শে মে’র রাতে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং সেই রাতেই তিনি নিহত হন।

আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম  বিবিসি বাংলা’কে  সাইফুল করিমের পরিবার সে সসময় একই ধরনের তথ্য দিয়েছিলেন।  তারা জানান, আসন্ন একটি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তাকে যোগ দিতে দেয়া হবে বলে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আশ্বাসের পর তিনি দেশে ফিরতে রাজি হন। তারা বিবিসিকে জানান,  ৩০শে মে নয়, ২৭শে মে’র রাতে এক ফ্লাইটে মি. করিম ঢাকায় আসেন। ‘

সুত্রমতে, সাইফুল করিম দেশে ফিরে আসলে তার পরিবারের দুজন সদস্য, জসিম উদ্দিন ( বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান)  এবং কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। সেফ হাউজে নেবার কথা বলে সাইফুলকে সরিয়ে নেয়া হয় বিমানবন্দর থেকে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নথি অনুযায়ী,২০১৮  সালের মে মাসে  তৈরি ৭৩ জন শীর্ষ ইয়াবা চোরাকারবারি ও ব্যবসায়ীর তালিকায় সাইফুল করিমের নাম ছিল দ্বিতীয়। পরের বছর টেকনাফে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উপস্থিতিতে  ১০২ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করে। সাইফুল করিমও আত্নসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা পরিকল্পনা করে। কিন্তু জসিমের মধ্যস্ততায়  পুলিশের সাথে দফারফা করেও পরবর্তী  আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আত্নসমর্পণ করতে পারেন নি। পরিকল্পনা মতো তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। যদিও পুলিশ বন্দুক যুদ্ধে সাইফুল করিম নিহত হয়েছেন বলে প্রচার করে। চট্টগ্রাম জেলার শীর্ষ  পুলিশ কর্মকর্তার সহযোগিতায়  কৌশলে সাইফুল সরিয়ে দেন জসিম। এরপর থেকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি এখন সময়কার খাবার হোটেলের এই ক্যাশিয়ারকে । বাবার মালিকানাধীন খাবার হোটেলে শুরুতে ম্যাসিয়ারের কাজও করেছিলেন জেসিকা ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন।

সাইফুল করিম ইয়াবা ডন হয়ে ওঠার পেছনে যার নামটি সবসময় আলোচনায় ছিলো সেটি হচ্ছে সৈয়দ করিম। সৈয়দ করিমের বাড়ি মিয়ানমারে। পরে তিনি টেকনাফে স্থায়ী হন। ২০০৮ সালে সাইফুলকে চট্টগ্রাম শহর থেকে নিয়ে গিয়ে টেকনাফে একটি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্সিতে চাকরি দেন তিনি। মূলত সেই চাকরির  আড়ালে ইয়াবার ডিলার হিসেবে তাকে নিয়োগ করা হয়েছিলো। চাকরির কারনে প্রায় সময় তাকে মিয়ানমার যাওয়া-আসা করতে হতো। এভাবে দেশের শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী বনে যাওয়া সাইফুল করিমের ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটে জসিম উদ্দিনের হাত ধরে।

সাইফুল করিমের টাকায় চট্টগ্রামের লালদিঘি পাড় এলাকার খুরশিদ মহল নামের একটি মার্কেট কিনে নেন জসিম উদ্দিন। সেই মার্কেটটি বন্ধক রেখে পদ্মা ব্যাংক নিতে লোন নেন জসিম। সুত্রমতে, পদ্মা ব্যাংকের খাতুনগন্জে শাখা থেকে  লোন পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেন সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ।

পারিবারিক সুত্রমতে, জসিম উদ্দিনের বাবা মফজল আহমদ চট্টগ্রাম শহরের পুরাতন গীর্জা এলাকার একটি ছোট খাবার দোকানের মালিক ছিলেন। হোটেলটির মুল মালিক থেকে ভাড়া নিয়ে চালাতেন তিনি। ভাগ্য ফেরাতে ১৯৯৩ সালে জসিম উদ্দিনকে সৌদি আরব পাঠান তার বাবা মফজল আহমদ। এরআগে বাবার হোটেলের ম্যাসিয়ারের কাজ করতেন জসিম। বাবার অনুপস্থিতিতে সামলাতেন হোটেলের ক্যাশবাক্স।

সেই জসিম উদ্দিন কিভাবে শিল্পপতি হলেন সেই ঘোর কাটছে না তার পরিচিতজনদের। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা জসিম কোথায় পেলেন, তা নিয়ে জনমনে সৃষ্টি হয় বিস্ময়ে । জসিম উদ্দিনের উত্থান দেখে হতবাক তার গ্রামের লোকজনেরও।

দেরা দুবাইয়ে জসিম উদ্দিনের সাথে একই বাড়িতে ব্যাচেলর ভাড়া থাকতেন এমন তিন ব্যক্তি তার সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, সৌদি আরবে সুবিধা করতে না পরে সেখান  থেকে আরব আমিরাতে পাড়ি জমান জসিম উদ্দিন। সেখানেই ইয়াবা ব্যবসায়ী  সাইফুল করিমের সাথে সখ্যতা তৈরি হয়। পুলিশের এক প্রভাবশালী কর্মকর্তার সাথে তার সম্পর্ক আছে জানার পর সাইফুল করিম তাকে দুবাইয়ে নিজের সাথে সাথে রাখতেন।

ওই পুলিশ কর্মকর্তার আশির্বাদে সাইফুল করিমের টাকা বিনিয়োগ করেন আবাসন খাতে। একসময়  কক্সবাজার ও দুবাইয়ে আন্তর্জাতিক চেইন হোটেল ‘হোটেল রামাদা’ গড়ে তুলতে বিনিয়োগ করেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রামের খুলশীর অভিজাত এলাকায় ‘জসিম হিল’ নামে গড়ে তোলেছেন অভিজাত বাড়ি। গ্রামের বাড়িতেও কয়েক কোটি টাকায় নির্মাণ করেছেন বিশাল প্রাসাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

সবশেষ খবর