25 C
Dhaka
Thursday, October 2, 2025

ফেসবুকে ‘দারাজ অনলাইন’ চক্র, ফার্নিচারের নামে প্রতারণার ফাঁদ

আরও পড়ুন

নাদিরা শিমু ||

পূজা উপলক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পণ্য বিক্রির কথা বলে অভিনব পদ্ধতিতে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। ‘ দারাজ অনলাইন বিডি ‘নামের ফেসবুক পেজ খুলে  পঞ্চাশ শতাংশ ছাড়ে ফার্নিচার বিক্রি করার কথা বলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পণ্যের অগ্রীম সংগ্রহ করছে চক্রটি। ফার্নিচার ডেলিভারির নামে পণ্যের পুরো টাকাই যাচ্ছে প্রতারক চক্রের পকেটে।

অনুসন্ধানে জানা যায়,  বিভিন্ন ফার্নিচারের ছবি তুলে পেইজ রাখা হলেও প্রকৃতপক্ষে প্রতারণা করার জন্যই সেই পেইজ খুলে রাখা হয়েছে। এসব ছবি উপর পণ্যের কোড রয়েছে। ফটো ফরেনসিক করে পণ্যের ছবিগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে প্রতিবেদক। গ্রাহকদের পণ্য বুকিং করার সময় পনের শত টাকা বিকাশ করার জন্য বলা হয়। পরের দিন হোম ডেলিভারির জন্য তাদের নিজস্ব কুরিয়ার থেকে কল করে ‘চালান’ চাওয়া হয়। আর চালানের জন্য ভুয়া প্রতিষ্ঠানটির কাছে ফোন দিলে পুরো বকেয়া টাকা পরিশোধ করার জন্য বলে হাতিয়ে নিচ্ছে গ্রাহকের টাকা। প্রশিক্ষিত প্রতারকরা কৌশলে বিকাশে পুরো টাকা পরিশোধ করার পর ওটিপি আসবে এমন  কথা বলে গ্রাহকদের ফাঁদে ফেলছেন।

টাকা পরিশোধ করার পর পণ্যের জন্য ফোন করলে ‘গালাগাল ‘ ছাড়া কিছুই মেলে না। বিকাশের অগ্রিম আর পণ্য ডেলিভারির চালানের ওটিপি বাবত দেয়া টাকার পুরোটাই যাচ্ছে প্রতারক চক্রের পকেটে।

চট্টগ্রাম থেকে আসাদ নামের এক গ্রাহক দারাজ শপিং বিডি নামের ফেসবুক পেজটি থেকে পণ্য কিনতে গিয়ে খুইয়েছেন ত্রিশ হাজার টাকা। জানতে চাইলে তিনি বলেন, পেজে মেসেজ দেবার পর বিকাশে অগ্রীম টাকা পরিশোধ করার জন্য ০১৬১৯৮০১১৭৪ নাম্বার ঘেকে মুঠোফোনে কল দেয় এক ব্যক্তি। বলা হয় পণ্যের কোড নাম্বার নিয়ে ১৫০০ টাকা বিকাশ করেন। ০১৮৫১ ৬৫৭৪৪৯  বিকাশ নাম্বার দেয়া হয়। পরবর্তী দিন পণ্য ডেলিভারীর নিজস্ব ভ্যান চট্টগ্রামে এসেছে বলে ওটিপি’র কথা বলে পুরো টাকা হাতিয়ে নেয়। ওই নাম্বারে কল দেবার পর মুলত গালিগালাজ করছে। ‘

প্রতারিত এক গ্রাহক জানান, সকালে কুরিয়ার পরিচয়ে ০১৮১৮ -৫২১৬০৩ ( মফিজুল মুন্নি নামে রেজিস্ট্রার করা) নাম্বার থেকে কল করে পণ্যের চালান নম্বর সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। ঢাকায় ফোন করে চালান নাম্বার চাওয়া হলে বলা হয় পুরো টাকা বিকাশে পাঠাতে ; তারপর ‘ওটিপি ‘ পাঠানো হবে। সেই ওটিপি কুরিয়ারম্যানের কাছে বলতে হবে। পণ্য না দেখে গ্রাহকরা টাকা দিচ্ছেন। তবে আমি কুরিয়ারের অবস্থান জানতে চাওয়ার পর বলা হয় চট্টগ্রামের বেপারিপাড়ায়। সেখানে ড্রাইভার পাঠানোর পর থেকে মুঠোফোনে গালাগাল করা হয়েছে। ‘

একই কৌশলে রাজশাহী থেকে আব্দুল আলিম, খোকন, শারিন আহমেদ, সিলেটের শর্মিলি খান, রাজ আহমেদ, আয়ান চক্রবর্তী, চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার হারুন আহমেদ, ইয়াসমিন, নওশিন আহমেদ – এমন শত শত গ্রাহকের কাছ থেকে ফার্নিচার বিক্রির কথা বলে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।

আব্দুল আলিম নামের এক গ্রাহক জানান, ‘ আমি একটি পণ্যের জন্য বুকিং দিয়েছিলাম। সর্বমোট ছয় হাজার আটশ টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। তবে পরিচিত এক দরিদ্র পরিবারের আড়াই লাখ টাকা খোয়া গেছে এই চক্রের ফাঁদে পড়ে। মেয়ের বিয়ের ফার্নিচার বুকিং দেবার একই কৌশলে টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। ‘

সাইবার পুলিশের কাছে কিংবা পুলিশের কাছে কেন অভিযোগ করা হলো না সেই প্রশ্নের জবাবে তিনজন গ্রাহকই জানিয়েছেন কোন লাভ হবে না। সরকার মোবাইল ফোন রেজিষ্ট্রেশন করিয়েছেন, জাতীয় পরিচয় পত্র ডিজিটাল করা হয়েছে – তারপরও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মুঠোফোন, বিকাশ/নগদ ব্যবহার করে এমন প্রতারণা প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়েই করা হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভুয়া জাতীয় পরিচয় পত্র ব্যবহার করে কেনা হয়েছে  রেজিস্ট্রার্ড সিম, সেই নাম্বার ব্যবহার করে বিকাশ একাউন্ট খোলা হয়েছে। এসব একাউন্টেই নিরাপদে ডুকছে প্রতারণার টাকা।

দারাজ ফার্নিচার বিডি নামের আরেকটি পেজে পূজা উপলক্ষে  ফার্নিচারের উপর ষাট শতাংশ ডিসকাউন্ট অফার করে প্রতারণা চলছে একই কৌশলে। এই পেজেও পণ্য বুকিং দেবার সময়  পনের শ টাকা অগ্রীম নেয়া হচ্ছে। আর পণ্য ডেলিভারির আগে পণ্য পৌঁছানোর কথা বলে বাকি টাকা। ফেজটির বেচাকেনায় বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরির জন্য গ্রাহকদের পণ্য ডেলিভারি দেয়া হচ্ছে এমন কিছু ছবিও রাখা হয়েছে।

দারাজ ফার্নিচার নামের একটি দোকানের নাম ব্যবহার করে চলছে এমন প্রতারণা। পেজে দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী ঢাকার উত্তর বাড্ডা এলাকার বীর উত্তম রফিকুল ইসলাম এভিনিউর হোসেন মার্কেটের পাশের গলিতে ফার্নিচারের দোকান রয়েছে দারাজ ফার্নিচারের। শুরুতেই পণ্যের কোড লিখে পাঠাতে বলা হচ্ছে। ফার্নিচার বুকিং দেবার পর  ০১৮৪৬২২১০০৮  নাম্বারে বিকাশে পাঠাতে হবে পনের শ টাকা। অগ্রীম বাবত  কোন চালান বা রিসিটও দেয়ার নিয়ম নেই। ০১৮৪৬২২১০০৮  নাম্বারটি আন রেজিস্ট্রার্ড নাম্বার। তবে এই নাম্বারে খোলা হয়েছে বিকাশ।

তবে অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, অনলাইনে ডিসকাউন্ট অফার করা ‘ দারাজ শপিং বিডি’ ‘ দারাজ ফার্নিচার ‘- একই প্রতারক চক্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

এডভোকেট রেজাউল করিম বলেন, ‘ প্রতারণার শিকার হলে দেওয়ানী ও ফৌজদারী দুই ধরনের মামলাই করতে পারেন যে কেউ। এ ছাড়া ভোক্তা অধিকার আইন এবং ১৮৭২ সালের কনট্রাক্ট আইনে প্রতিকার পেতে পারেন। এ ছাড়া দ্য সেল অব গুডস অ্যাক্ট রয়েছে। এছাড়া পণ্য কেনা-বেচার ক্ষেত্রে টাকা পয়সা নিয়ে প্রতারণা করলে দণ্ডবিধিতে শাস্তির বিধান রয়েছে।

তিনি বলেন, এরা আসলে ব্যবসায়ী নন, প্রতারক। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে  কনট্রাক্ট আইনে দুই জনের মধ্যে চুক্তি থাকে। যখনই পণ্য কেনার ক্ষেত্রে কনফার্ম হয়ে গেলে দুই জনের মধ্যে কনট্রাক্ট হয়ে গেল। এ ক্ষেত্রে চুক্তি ভঙ্গ হলে যে কোনো পক্ষকে আইনের আওতায় আনা যাবে।

বিশেষতদের মতে  অনলাইনে পণ্য কেনার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। যে পেইজ থেকে পণ্য কেনা হচ্ছে তার জনপ্রিয়তা, রিভিউ কেমন এটা দেখার দরকার। রিভিউটা দেখা খুব জরুরি, এ ক্ষেত্রে প্রতারিত হলে দেওয়ানী মামলা করা যায়। সাইবার পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে প্রতারক চক্রকে আইনের আওতায় আনা জরুরি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

সবশেষ খবর